বুকটা মেলে ধরো আরশের পানে

প্রকাশ : ১৮ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

শহুরে জীবনে আমাদের ব্যবহার্য পানি বিশুদ্ধকরণের জন্য পানি শোধনাগার আছে। তেলকূপ থেকে উত্তোলিত তেল পরিশোধন করা হয় তেল শোধনাগারে। দেহের ময়লা-আবর্জনা দূর করতে আমরা প্রায় প্রতিদিন গোসল করি, সাবান ব্যবহার করি, কাপড় কাচি। আমাদের দেহসত্তার ভেতরে যে আত্মা, তার শুদ্ধিসাধনের প্রক্রিয়া সরাসরি নির্দেশিত হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে। বলা হয়েছে, ‘তোমরা যাতে তাকওযা অর্জন করতে পার তার জন্য তোমাদের ওপর রোযা ফরজ করা হয়েছে।’ এই তাকওয়ার অপর নাম বাংলায় আত্মশুদ্ধি। মওলানা রুমি (রহ.) মসনবি শরিফে আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করেছেন চমৎকার উপমার সাহায্যে নানা স্থানে।

ঘনবসতির মধ্যখানে একটি পুকুর গোটা জনপদের প্রাণ। যথেচ্ছ ব্যবহার ও অযত্নে পুকুরটি ভরাট হয়ে কচুরিপানা জমে গেছে। পাড়গুলো অরক্ষিত। পাঁচটি নালা দিয়ে সমানে ময়লা-আবর্জনার পানি ঢুকছে আর বের হচ্ছে। পুকুরটির দূষিত পানি পচা, ব্যবহার অনুপযোগী। জনবসতির দুর্ভোগের শেষ নেই। পাড়ার উঠতি ছেলেরা বার কয়েক কচুরিপানা পরিষ্কার করার উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। পরিষ্কার করার পরের দিনই নতুন করে কচুরিপানা ছেয়ে যায়। পাড়ার বৃদ্ধ মুরব্বি বললেন, ছেলেরা যেভাবে চেষ্টা করছ পুকুরের পানি দূষণমুক্ত হবে না। আমি একটি পথ বাতলে দিচ্ছি, সম্মিলিত একটি কর্মসূচি গ্রহণ কর। প্রথমে পুকুরের নালা পাঁচটি বন্ধ করে দাও, যাতে বাইরের দূষিত পানি ঢুকতে না পারে। এর মধ্যে সবাই হল্লা করে হাজামজা কচুরিপানা তুলে ফেল। তারপর দূষিত পানি সেঁচে বাইরে ফেলে দাও। এক মাস সময় হাতে রেখে সবাই মিলে পুকুরের মাটি খনন করতে থাক। পলিমাটি তোলার পর এঁটেল মাটি পাবে। তারপর বালু মাটি। এখন পুকুরের বুকটা উন্মুক্ত করে রাখ আকাশের পানে। প্রতাপান্বিত সূর্য ঢেলে দিক তার তাপের ঐশ্বর্য। তাপিত হবে পুকুরের তলা। আরো একটু গভীরে যাওয়ার চেষ্টা কর, দেখবে নিচ থেকে পাতালপুরে নির্মল স্বচ্ছ সলিল উৎসারিত হচ্ছে। দেখতে দেখতে সুপেয় পানিতে পুকুর ভরে গেছে। এক মাস যেদিন শেষ হবে সবাই মিলে সাময়িক বন্ধ করা পাঁচটি নালা খুলে দাও। দেখবে এখন আর বাইরের ময়লা পানি ভেতরে ঢুকছে না; বরং ভেতরের স্বচ্ছ নির্মল পানি বাইরে জনপদে প্রবাহিত হচ্ছে নালাগুলো দিয়ে। লোকালয়জুড়ে নবজীবনের গান, প্রাণের বন্যা, ঈদের উৎসব।

রমজানের কৃচ্ছ্রসাধনার ব্যাপারটিও অনেকটা এ রকম। দেহের পঁাঁচটি ইন্দ্রিয় দিয়ে স্বার্থ, লোভ ও কামনা বাসনা, কলুষতার দূষিত পানি আমাদের অন্তরের পুকুরে হরদম ঢুকছে। জাগতিক শিক্ষা ও সতর্কতায় একে রোধ করার চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থতা প্রমাণিত হয়েছে। ধর্মগুরু আমাদের বলছে, পাঁচটি ইন্দ্রিয় সাময়িকভাবে বন্ধ কর। মিথ্যা, অশ্লীলতা, লোভ মোহ সমানে দলিত কর। দিনের বেলা পানাহার, যৌন সংসর্গের মতো বৈধ কাজগুলোও পরিহার কর। এক মাসের সাধনায় আল্লাহর স্মরণ, কোরআন তেলাওয়াত, তারাবি, তাহাজ্জুদ, অসহায় মানুষের জন্য জাকাত সদকা, ইফতারি, ঈদসামগ্রী বিলানোর মাধ্যমে আত্মার গভীরে খননকার্য চালাও। তোমার বুকটা মেলে ধর আরশের পানে। আরশের সূর্যের তাজাল্লির বিচ্ছুরণে তোমার অন্তরের পুড়ে ছাই হয়ে ভেতর থেকে আবহায়াতের প্রস্রবণ উৎসারিত হবে। শবেকদরে সাধনা যখন আরো গভীরে যাবে, দেখবে তোমার চলনে বলনে চিন্তায় মননে খোদায়ি চরিত্রের উদ্ভাস ফুটে উঠেছে। তার ফল্গুধারা প্রবাহিত হচ্ছে সমাজের সর্বত্র। আত্মশুদ্ধির জয়গানে এখন মুখরিত হও আবালবৃদ্ধবনিতা। আল্লাহর শোকর আদায় করো ঈদগাহে, নবজীবনের আনন্দে বুকে বুক মিলাও। ঘরে ঘরে ঈদের শিরনি বিলাও। আসমামী শিরনি লাভ করতে হলে আমাদের সবচেয়ে বড় কর্তব্য বুকটাকে আকাশের পানে মেলে ধরা।