প্রতিশ্রুতি পূরণে অবিচল

পানিতে স্বস্তি মিলেছে রোজায়

প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

ঢাকায় মানুষের বসবাস দ্রুত বাড়ছে। এতে সেবা সংস্থাগুলোর ওপরে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। আর এই চাপ সামাল দিতে গিয়ে বেশকিছু সেবাসংস্থা ন্যূয়ে পরলেও পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে চলছে ঢাকা ওয়াসা। রোজার মাসে নিরবচ্ছিন্নভাবে পানি সরবরাহে প্রতিশ্রুতি পূরণে অবিচল রয়েছে সংস্থাটি। এমনকি রাজধানীতে ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকার পরও বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সুপেয় পানি সরবরাহ করেছে ওয়াসা।

জানা গেছে, ঢাকা ওয়াসা স্বাভাবিক গরমে দৈনিক প্রায় ২৭৫ কোটি লিটার পানি উৎপাদনের সক্ষমতা রাখে। এই সময়ে ঢাকা শহরে দৈনিক পানির চাহিদা থাকে কমবেশি ২৬০ থেকে ২৬৫ কোটি লিটার। অর্থাৎ, পানির চাহিদার তুলনায় পানি উৎপাদনে সক্ষমতা বেশি রয়েছে ঢাকা ওয়াসার। তবে এবার পানি উৎপাদনে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। রাজধানীতে ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা লক্ষ্য করা গেছে, যা ৫৮ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এই তাপমাত্রার মধ্যে পানি উৎপাদনে রেকর্ড গড়ল ঢাকা ওয়াসা। কারণ গতকাল ২৪ ঘণ্টায় ২৯৩ দশমিক ৪ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করেছে সংস্থাটি।

ঢাকা ওয়াসার সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বাভাবিক গরমের মৌসুমে ঢাকা শহরে দৈনিক ২৬০ থেকে ২৬৫ কোটি লিটার পানির চাহিদা রয়েছে, যা বর্ষা ও শীতের মৌসুমে দৈনিক পানির চাহিদা ২১০ থেকে ২২০ কোটি লিটারে দাঁড়ায়। কয়েক দিন ধরে রাজধানীতে সর্বোচ্চ গরম পরায় পানির ওপর চাপ বাড়ছে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তীব্র গরমে পশ্চিম ধানমন্ডির মধুবাজার, আদাবর, মিরপুর কাজীপাড়া, মোহাম্মাদিয়া হাউজিংয়ে কিছুটা পানির সংকট তৈরি হলে সঙ্গে সঙ্গে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে এসব এলাকায় পানির গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়। ঢাকা ওয়াসা এসব এলাকায় পানির পাম্প স্থাপন করতে চাইলেও জমি সংকটে পাম্প স্থাপন করতে পারছে না। তবে পুরান ঢাকা সূত্রাপুরের বাসিন্দা সোহেলী বেগম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, রাজধানীতে সর্বোচ্চ গরম পরলেও এই গরমে পানির হাহাকার থেকে মুক্তি পেয়েছি। কারণ, কিছুদিন আগেই পানি সরবরাহে নতুন পাইপ স্থান করেছে ওয়াসা। পাইপ বসানোর পর মহল্লার সবাই বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছেন। পানির মান নিয়ে কারো কোনো আপত্তি নেই। মুগদা ও বাসাবো এলাকার বাসিন্দারা বলেছেন, আগে বর্ষা ও শীতের মৌসুমেও ওয়াসার লাইনে পানিই পাওয়া যেত না। দিনে একবার যখন পানি দিত, সেই পানিও ব্যবহার উপযোগী ছিল না। কয়েক বছর ধরে এই কষ্ট লাঘব হয়েছে। ঢাকা ওয়াসার পানি নিয়ে এখন হাঁড়ি-পাতিল ও কলসি বাজানো নেই, ঝাড়ু মিছিল কিংবা মানববন্ধনও নেই। সুপেয় পানিতে স্বস্তি মিলেছে।

ঢাকা ওয়াসার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, রোজার মাসে ঢাকা শহরে পানির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বেশকিছু প্রস্তুতি নেয় ঢাকা ওয়াসা। সব পানি শোধনাগার ও পানির পাম্পসমূহ ২৪ ঘণ্টা চালু রাখা হয়। লোডশেডিংয়ের সময় পাম্পগুলো ডুয়েল সোর্স বিদ্যুৎলাইন, ফিক্সড জেনারেটর ও মোবাইল জেনারেটরের মাধ্যমে চালু রাখা হয়। চাহিদাকৃত স্থানে দ্রুত পানি সরবরাহে সব জোনাল অফিসে পর্যাপ্ত পানির গাড়ি প্রস্তুত রাখা হয়। এছাড়া ঢাকার সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তান, ফার্মগেট, মহাখালী, গাবতলী, যাত্রাবাড়ী, কমলাপুর ও সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডের মতো জনসমাগম স্থানে ইফতার ও সাহরির সময় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। রাজধানীর মসজিদগুলোয় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা হিসেবে জরুরি প্রয়োজনে ৪৮টি পানির গাড়ি ও ১৭টি ট্রাক্টর রাখা হয়। লোডশেডিংয়ের সময় ৩৮০টি ফিক্সড জেনারেটর এবং ১৯টি মোবাইল জেনারেটরের ব্যবস্থা রাখা হয়। পানি সরবরাহে কোথাও ব্যাঘাত ঘটলে বা অভিযোগ এলে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ‘ওয়াসালিংক-১৬১৬২’ এবং ১১টি অভিযোগকেন্দ্র ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা হয়। পানির পাম্প মনিটরিংয়ের জন্য বিদ্যমান ১০টি অ্যাডভাইজরি ও মনিটরিং টিম তৎপর আছে।

রাজধানীতে বছরে বছরে জনসংখ্যার ঘনত্ব বাড়ছে। বাড়ছে খাবার পানির চাহিদা। কোটি মানুষের এই চাহিদা মেটাতে যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। ফলে রাত জেগে হাঁড়িপাতিল, ড্রাম কিংবা বালতি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানির জন্য নগরবাসীকে আর অপেক্ষা করতে হয় না। পানির সংকট নিরসনে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। পানির পাইপ লাইন পরিবর্তনের জন্য ডিস্ট্রিক মিটারিং এরিয়া (ডিএমএ) পদ্ধতি চালু করা হয়েছে।

রমজানে পানি সরবরাহের বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘রোজার মাসে পানি ব্যবহারের প্যাটার্ন কিছুটা বদলে যায়। এছাড়া গ্রীষ্মে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় উৎপাদন ক্ষেত্রবিশেষে কমে। কিন্তু রোজায় যাতে পানি উৎপাদনে কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্য আগেভাগেই প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। এই প্রস্তুতিতে ঢাকা ওয়াসা সফল।’

পানি সরবরাহ সেবায় ঢাকা ওয়াসা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছে এমন মন্তব্য করে প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, ‘গত ১৪ বছর ধরেই ঢাকা ওয়াসায় আমূল পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। ঘুরে দাঁড়াও ‘ঢাকা ওয়াসা’ কর্মসূচি গ্রহণ করে ভালো ফল পেয়েছে। পানি উৎপাদনে সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আগের অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগানো হয়েছে ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে পানি অপচয় রোধে মানুষ সচেতন হয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুম সব সময় আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং কারণ, পানির স্তর নিচে নেমে যায়। রমজান মাস আমাদের জন্য আরো বেশি চ্যালেঞ্জিং। কারণ, রমজানে পানি ব্যবহারের প্যাটার্ন পরিবর্তন হয়ে যায়। সর্বোচ্চ তাপমাত্রাও ঢাকা ওয়াসার জন্য চ্যালেঞ্জিং। এরপরও পানি ব্যবস্থাপনা সঠিক জায়গায় ধরে রাখতে পেরেছি। ছোটখাট কোনো কোনো জায়গায় পকেট সমস্যা হয়েছে, তবে মোটা দাগে আমাদের পানি ব্যবস্থাপনা কোনোভাবেই বিঘ্নিত হয়নি।’

ওয়াসার এমডি বলেন, ‘রাজধানীতে পানির চাহিদার তুলনায় ঢাকা ওয়াসার পানি উৎপাদনের সক্ষমতা বেশি। ক্র্যাইসিস ম্যানেজম্যান্ট পারদর্শিতা অর্জন করতে পেরেছি। কোনো এলাকায় পানি সরবরাহে সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে অন্য জায়গা থেকে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। জোন-৩ এর আওতাধীন লালমাটিয়া ও মোহাম্মাদীয়া হাউজিং এলাকায় পানির পাম্প বসানোর জমি দিতে পারছে না। সেজন্য এসব এলাকায় পানি সরবরাহে ওয়াসা চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। রেশনিং করে পানি সরবরাহের চেষ্টা করা হচ্ছে। রোজার সময়ে এই এলাকায় পানির সংকট হয়েছে, সেজন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি।’

রাজধানীতে ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকায় মানুষ গোসল, মুখ বা দাঁত ব্রাশ করার সময় পানির ট্যাপ ছেড়ে দেয়। ট্যাপের মুখে কিছুটা ঠান্ডা পানি এলে তবেই ব্যবহার করছেন। এতে গোসল ও মুখ ধোঁয়ার আগেই ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ আগের তুলনায় দ্বিগুণ পানি খরচ করছেন। অর্থাৎ, ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের জায়গায় এখন কমবেশি ৪ কোটি মানুষের পানি খরচ হচ্ছে। রাতারাতি এত মানুষের পানি সরবরাহ করা অসম্ভব। তবে ব্যাকআপ থাকায় গরমের মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে বলে মনে করেন প্রকৌশলী তাকসিম এ খান।