ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রাজউকের ভাষ্য

ঝুঁকিপূর্ণ রাজধানীর মৌচাক মার্কেট : দুর্ঘটনার আশঙ্কা

ঝুঁকিপূর্ণ রাজধানীর মৌচাক মার্কেট : দুর্ঘটনার আশঙ্কা

বঙ্গবাজারের মতোই ঝুঁকিপূর্ণ রাজধানীর একাধিক মার্কেট। তবুও সচেতন নন ব্যবসায়ীরা। রাজধানীর মৌচাক মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। তারা বলছে, দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে প্রায় ৭০ বছর আগে নির্মিত এ মার্কেটের রডের ধারণক্ষমতা কমে গেছে।

ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত মৌচাক মার্কেটটি যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ৭০ বছরের পুরোনো মার্কেটটিতে ঈদের কেনাকাটায় ক্রেতাদের সমাগমে, বিশেষ করে ঈদের আগে ক্রেতাদের ভিড়ে জরাজীর্ণ এই মার্কেটটিতে যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ফলে সাভারের রানা প্লাজার মতো আরেকটি ট্রাজেডির মুখোমুখি হতে পারে ক্রেতা-বিক্রেতারা। দুর্ঘটনা ঘটলে এর দায়বার কে নেবে- এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে দোকান মালিক এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে। রাজউক, ডিএনসিসি এবং মার্কেট মালিকপক্ষ পরস্পরের ওপর দায় চাপিয়ে নিরাপদ থাকতে চাইছে।

এদিকে বঙ্গবাজারের ঘটনার পর রাজধানীর বেশকিছু মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করেছে ফায়ার সার্ভিস ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। রাজধানীর মৌচাক মার্কেটও ঝুঁকিপূর্ণ বলে সেই তালিকায় আবারো চিহ্নিত করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। তারা বলেছে, বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরও মৌচাকে কোনোরকম সচেতনতা ছাড়াই ঈদের কেনাবেচায় ব্যস্ত ব্যবসায়ীরা।

জানা গেছে, মার্কেট মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় সাধারণ দোকান মালিকরা ভয়ে মুখ খুলে কথা বলতে সাহস পাচ্ছে না। যদিও ঈদকে সামনে রেখে এখন আবার মার্কেট মেরামতের নামে নতুন করে বণিক সমিতির মাধ্যমে বিনা রশিদে প্রতিটি দোকান থেকে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা করে চাঁদা উঠানো হচ্ছে। এই টাকা দিয়ে মার্কেট জোড়াতালি ও ধোঁয়া মোছার কাজ না করে মালিক কর্তৃপক্ষ রাজউক, ডিএনসিসি ও প্রশাসনসহ প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করতে মরিয়া বলে বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। আর দোকান মালিকরা টিকে থাকার জন্য অনেকটা ভয় এবং আতঙ্কের মধ্যেও টাকা দিতে বাধ্য হচ্ছেন। দোকান মালিকরা জানিয়েছেন, তারা অনেকটাই জিম্মি হয়ে পড়েছেন। এছাড়া মার্কেটের পার্কিংয়ের জায়গা দখল করে ৬০ থেকে ৭০টি দোকান নির্মাণ করে তা এককালীন বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগও রয়েছে মার্কেট মালিকদের বিরুদ্ধে। তারা মার্কেটের ফুটপাত থেকেও মাসে ৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অথচ ৭০ বছরেও মৌচাক মার্কেটটি বহুতল ভবন কিংবা উন্নয়নের ছোয়াও লাগেনি।

সরেজমিন দেখা গেছে, মৌচাক ভবনটি পাঁচতলা। প্রথম তলায় খাবারের দোকান। দ্বিতীয় তলায় জুয়েলারি সামগ্রী। তৃতীয় তলায় বিক্রি হয় প্লাস্টিক ও অন্যান্য জিনিসপত্র। চতুর্থ তলায় রয়েছে পোশাকের দোকান। পঞ্চম তলায় একটা মসজিদ ও চাইনিজ রেস্তোরাঁ রয়েছে। সব মিলিয়ে ৪৫০টি দোকান রয়েছে মার্কেটটিতে। ২০১৪ সালের ৭ মে রাজউকের ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় নাম উঠে এ মার্কেটের। ওই সময় একটি চিঠিও দিয়ে ছিল মার্কেট মালিকদেরকে।

কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ঈদের আগে মার্কেটটিতে ‘ঝুঁকিপুর্ণ নোটিশ’ দিতে কৌঁসুলি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে রাজউক। আর নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে মার্কেট মালিকরা ডিএনসিসির ওপর দায় ন্যস্ত করেছে। তবে ডিএনসিসির পক্ষ থেকে রাজউকের আ্যসাইন্টমেন্ট রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। সেই রিপোর্ট দেখেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

রাজউকের পক্ষ থেকে ডিএনসিসি ও ফায়ার সার্ভিসকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে ডিএনসিসি এই চিঠি নিয়ে লুকোচুরি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ঈদের আগে ব্যবসায় ধস নামতে পারে এই আশঙ্কা থেকেই তালিকা প্রকাশ করতে অনীহা সংস্থা দুটির। আর এজন্য মার্কেট মালিকরা তাদেরকে ম্যানেজ করতেই দোকান মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা উঠিয়েছে বলে জানা গেছে। তবে তাদের দাবি এই মুহূর্তে মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করলে ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়বেন।

জানা গেছে রাজউকের আরবান রেজিলিয়ান্স প্রকল্পের আওতায় মৌচাক মার্কেটের কারিগরি দিকটি পরীক্ষা করা হয়। কারিগরি পরীক্ষার পর রাজউকের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, মার্কেটটি ৭০ বছর আগে নির্মিত। কংক্রিটের স্ট্রেস্থ পিএসআই থাকার কথা ৩৫০০। কিন্তু বর্তমানে এর চেয়ে অনেক কম পিএসআই রয়েছে। পাশাপাশি ভূমিকম্প সহনীয় রাখতে হলে কমপক্ষে ৬০ গ্রেডের রড থাকতে হবে। কিন্তু রয়েছে ৪০ গ্রেডের। তাছাড়া ৭০ বছর ধরে ব্যবহার করার ফলে ধারণ ক্ষমতা একেবারেই কমে গেছে। যে কোনো সময় মার্কেটটি ভেঙে পড়তে পারে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক দোকানি জানিয়েছেন, বণিক সমিতির মাধ্যমে মার্কেট সংস্কারের নামে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে নেয়া হচ্ছে। এই অর্থ ভাগাভাগি ও লুটপাট করে খাওয়া হচ্ছে। অথচ দোকান মালিকদের সাথে মার্কেট মালিকদের চুক্তি পত্রে স্পষ্ট লেখা আছে বহুতল ভবন নির্মাণ হলে অগ্রিম টাকার ৪০ ভাগ টাকা নেয়া হবে। কিন্তু প্রতি বছরই মার্কেট সংস্কারের নামে টাকা দিতে হচ্ছে।

জানা গেছে, প্রায় ৭০ বছর আগে নির্মিত এই মার্কেটটি ১৯৯৮ সালে সিলেটের আবদুর রহমানের কাছ থেকে স্বপন ৮০ ভাগ, মোতাহার হোসেন ১০ ভাগ ও আবুল হোসেন ১০ ভাগ শেয়ারে ক্রয় করেন। গত ২৫ বছরে বণিক সমিতিতে কোন নির্বাচন হয়নি। তাদের নিজের লোকজন সিলেকশনের মাধ্যমে নির্বাচিত করে সমিতির ব্যানারে একটি সিন্ডিকেট লুটপাট করে খাচ্ছে। ঈদ আসলেই দোকানিদের ওপর খড়গ নেমে আসে। তখন জোড়া তালি ও সংস্কারের নামে টাকা উঠানো হয়। বর্তমানে ঈদের মৌসুম চলছে। প্রতি দিন এক থেকে দেড় লাখ ক্রেতা মার্কেটটিতে ভিড় জমাচ্ছে। ক্রেতারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই কেনাকাটা করছে।

২০১৪ সালের ৭ মে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) মৌচাক মার্কেটের ভবন মালিককে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে বলা হয়, ইমারতটি জীর্ণ ও দৃশ্যত ঝুঁকিপূর্ণ প্রতীয়মান হওয়ায় বুয়েট পুরকৌশল বিভাগ কতৃক পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক কাঠামোগত উপযুক্ততার সনদ গ্রহণ করে চাওয়া তথ্যাদি এই দপ্তরে (রাজউক) দাখিল করার জন্য অনুরোধ করা হল। সেই সঙ্গে ভবনটির কাঠামোগত উপযুক্ততা নিশ্চিত হয়ে ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হলো।

এরপর বুয়েট নিরীক্ষা করে। আর বুয়েটের সুপারিশসহ প্রতিবেদন রাজউকে দাখিল হয়। এর প্রেক্ষিতে রাজউক ভবন মালিককে আরেকটি চিঠি দেন।

ওই চিঠিতে বলা হয়, বুয়েট প্রণীত কাঠামোগত মূল্যায়ন প্রতিবেদনের পরামর্শ ও কর্তৃপক্ষের ওই নির্দেশনা সত্ত্বেও কাঠামোগত ঝুঁকি হ্রাসে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে দায়িত্বহীনভাবে মার্কেট ব্যবহার অব্যাহত রেখেছেন, যা জীবন ও সম্পদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং ইমারত নির্মাণ আইন-১৯৫২ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

মৌচাক মার্কেট বণিক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমাদের এখানে প্রায় ৪০০’র মতো দোকান। অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়ে তাদের সচেতন করি আমরা এবং আমরা প্রয়োজনীয় অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জাম রেখেছি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত