ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শেকড়ের টানে ছুটছে মানুষ

* মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটে ভোগান্তি * যানজট নিরসনে তৎপর হাইওয়ে পুলিশ
শেকড়ের টানে ছুটছে মানুষ

ঈদকে কেন্দ্র করে শেকড়ের টানে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে মানুষ। কর্মব্যস্ত শহর ছেড়ে নিজ নিজ বাড়িতে ছুটে চলেছেন নগরবাসী। ট্রেন, দূরপাল্লার বাস ও লঞ্চে উপচেপড়া ভিড়। ঈদের টানা ৫ দিনের ছুটির আগে শেষ কর্মদিবস গত মঙ্গলবার থেকেই অনেকেই রাজধানী ছাড়ে। তবে ঈদে ঢাকা ছাড়া মানুষের ভোগান্তি গতকাল ছিল আগের দিনের তুলনায় অনেক বেশি। যারা ট্রেনে গেছেন তারাও ব্যাপক দুর্ভোগে পড়েন। মঙ্গলবার ট্রেন যাত্রা স্বস্তির হলেও গতকাল ছিল দুর্ভোগময়। দেরিতে ট্রেন ছেড়েছে। তবে গার্মেন্ট, শিল্প-কারখানা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা সেভাবে ছুটি পাননি। গতকাল ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ ও সিলেটগামী যাত্রীদের বিভিন্ন স্থানে ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়। নরসিংদীর মাধবদী থেকে পাঁচদোনা পর্যন্ত যানজটে ঢাকা-সিলেট, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশপাশ জেলার মানুষ আটকে পড়েন। রাজধানীর উত্তরা থেকে আশুলিয়া হয়ে বাইপাইল পর্যন্ত যানজট প্রতিদিনের চেনা চিত্র। টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়া জেলায় উন্নয়ন কাজের জন্য সড়ক সরু হওয়ায় ধীরে চলতে থাকে গাড়ি। পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা জানান, গত মঙ্গলবার সরকারি অফিস ছুটি হওয়ার পর পথে মানুষের ঢল নামতে শুরু করে। এতে অন্যান্য মহাসড়কে গাড়ির চাপ বাড়তে থাকে। তবে গার্মেন্ট, শিল্প-কারখানা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছুটি শুরুর পর যানজটের ভোগান্তি আরও বাড়বে।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যানবাহন ও ঘরমুখো যাত্রীর চাপ বেড়েছে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ অংশে কাঁচপুর-আউখাবর ১৫ কিলোমিটার সড়কে তীব্র যানজট দেখা দিয়েছে। ঈদের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে মহাসড়কে দূরপাল্লার যানবাহন ততই বাড়ছে। ফলে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কাঁচপুর থেকে বরপা পর্যন্ত তিনটি পয়েন্টে প্রতিনিয়তই যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। বরপা বাসস্ট্যান্ডে লোকাল চারটি গাড়ির স্ট্যান্ড আছে। এসব স্ট্যান্ডের গাড়ির অবাধ বিচরণে হরহামেশায় তৈরি হচ্ছে যানজট। অন্যদিকে মহাসড়কের রূপসী ও বরাবতে উভয় দিকের লিংক রোডের মুখে লেগুনা, ইজিবাইক ও রিকশার অভয়ারণ্য হওয়ায় যানজট হচ্ছে। রোকন মিয়া নামের এক যাত্রী বলেন, শিমরাইল মোড় যাওয়ার উদ্দেশ্যে আধাঘণ্টা আগে বরপা থেকে বাসে উঠেছি। কিন্তু যানজটে এখনো তারাব বিশ্বরোড পার হতে পারিনি। আগে এ পথ পার হতে ছয়-সাত মিনিট লাগতো। কখন গন্তব্যে পৌঁছাব বলতে পারছি না।

ঢাকা-সিলেট সড়কে চলাচলকারী যাতায়াত পরিবহণের যাত্রী অসিফুর রহমান বলেন, ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ যেতে তিন ঘণ্টা সময় লাগার কথা। তবে বরপা আসতেই লেগেছে দুই ঘণ্টা। কখন গন্তব্যে যেতে পারব কে জানে না। গ্লোরি পরিবহনের চালক জোবায়ের আকন্দ বলেন, মহাসড়কের বরপা, রূপসী, বরাব এলাকায় থেমে থেমে যানজট নিত্যনৈমিত্তক ব্যাপার। ঈদে যানবাহনের চাপ বাড়ায় এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। পথে ভোগান্তি বেড়েছে। এভাবে যানজট লেগে থাকলে ঈদে বাড়তি আয় তো দূরের কথা সংসারের খরচ জোগানোই কঠিন হবে।

এ বিষয়ে ট্রাফিক পুলিশের ইন্সপেক্টর (টিআই) ফারুক বলেন, ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের চাপ বাড়ায় যানবাহনেরও চাপ বেড়েছে। তবে আমাদের সদস্যরা যানজট নিরসনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ঈদ উপলক্ষে ভুলতা হাইওয়ে পুলিশ ক্যাম্পের জন্য ২৬ জন অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন হয়েছে। একযোগে আমাদের পিকেট ডিউটি টিম ও মোটরসাইকেল মোবাইল টিম কাজ করছে। যানজট তৈরি হওয়া স্পটগুলোর যানজট নিয়ন্ত্রণে পুলিশ তৎপর আছে।

মহাসড়কে গাড়ি চলেছে থেমে থেমে। তবুও ঘরমুখো মানুষের ভিড় ছিলো অনেক বেশি। মানুষের জনস্রোত ছিল স্টেশন, দূরপাল্লার বাস ও লঞ্চ টার্মিনালের দিকে। কারও লক্ষ্য ছিল কমলাপুর রেলস্টেশন বা সদরঘাট টার্মিনাল, কেউবা সায়েদাবাদ, গাবতলী বা মহাখালী টার্মিনালের দিকে গেছেন। যাত্রীর তুলনায় পরিবহণ কম। তাই বাস মিলছে না। সায়েদাবাদ টার্মিনালে কয়েকটি কাউন্টার ঘুরে টিকিট জোগাড় করতে না পেরে হতাশ ফজলু মিয়া। তিনি বলেন, সাধারণত লঞ্চে পটুয়াখালী যাই। এবার বাসে যাব। কিন্তু টিকিট নেই। সায়েদাবাদ টার্মিনালে দেখা গেছে ঘরমুখী যাত্রীদের ভিড়।

বাস কাউন্টারে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের রুটের বাসগুলো জড়ো হয়েছে সায়েদাবাদ টার্মিনালে। এতে ছোট এ টার্মিনালে যানজট লেগে রয়েছে। টার্মিনাল থেকে গাড়ি ছাড়তে সময় লাগছে।

পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় অন্য রুটের বাসও এসে জড়ো হয়েছে। আবার অন্য রুটের যাত্রীর চাপ অনেক বেশি। ফলে সায়েদাবাদ টার্মিনালে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। পটুয়াখালী, বরিশাল, বরগুনার বহু যাত্রী সায়েদাবাদ টার্মিনালের বাস কাউন্টারে টিকিট পাননি। তবে ভিন্ন চিত্র সদরঘাটে। লঞ্চ টার্মিনালে যাত্রীদের চাপ কম। অধিকাংশ মানুষ বাসে টিকিট অগ্রিম কেটেছেন। গতকাল গাবতলীতে দেখা যায়, বাস না পেয়ে মানুষ বাইক ও পিকআপে করে গাবতলী থেকে নবীনগর যাচ্ছেন। সাভারের ভাড়া নেয়া হচ্ছে তুলনামূলক অনেক বেশি। গণপরিবহণ না পেয়ে অনেক যাত্রী বাধ্য হয়ে এসব বাহনে চড়ছেন।

সদরঘাটে গতকাল সকালে ঘরমুখো মানুষের ভিড় কম ছিল। তবে দুপুরের পর থেকে যাত্রীদের চাপ বাড়তে থাকে। গতকাল সন্ধ্যায় অন্তত ৩০টি লঞ্চ ছেড়ে গেছে। অন্য সময়ে এ সংখ্যা ৬৫টির বেশি। পদ্মা সেতু চালুর পর তা কমে দাঁড়ায় ৫০ এর নিচে। এদিকে অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল সংস্থার কয়েকজন কর্মী বলেন, ঈদের ৩ থেকে ৪ দিন আগে থেকে টার্মিনালে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় থাকে। পদ্মা সেতুর কারণে এবার টার্মিনালে ভিন্ন চিত্র। টার্মিনালে যাত্রীদের তেমন চাপ নেই।

ঈদের আগে শেষ কর্মদিবস ছিল গত মঙ্গলবার। শেষ কর্মদিবসে অফিস শেষ করে গ্রামের বাড়ি ফিরতে থাকে মানুষ। ফলে বিকেলের পর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সড়কে গাড়ির চাপ বেড়ে যায় ও যানজটের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে রাজধানীর বাস টার্মিনাল ও শহর থেকে বের হওয়ার রাস্তাগুলোতে প্রচুর যানজট দেখা গেছে। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই যানজটের পরিমাণ আরও বাড়ছে। রাজধানীর বাড্ডা লিংক রোড, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী ও মিরপুর এলাকায় ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল থেকে রাজধানীর এসব এলাকায় যানচলাচল মোটামুটি স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু অফিস ছুটি হওয়ার পরপরই যানচলাচল বেড়ে যায়। এবারের রমজানে প্রতিদিন ইফতারের আগে রাস্তায় গাড়ির চাপ পরিলক্ষিত হয়েছে। ঈদের আগে শেষ কর্মদিবস হওয়ায় অফিস শেষ করে সবাই বাস, ট্রেন ও লঞ্চ টার্মিনালমুখী হওয়ায় যানজটের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়।

যাত্রাবাড়ী এলাকায় মঙ্গলবার বিকালে থেকে যানজট শুরু হয়। যাত্রবাড়ীর হানিফ ফ্লাইওভার ও এর নিচ দিয়ে যানবাহনে চড়ে ঢাকা ছাড়ছে ঘরমুখো মানুষ। ফলে ফ্লাইওভারের ওপর ও নিচ দিয়ে অসহনীয় যানজটের সৃষ্টি হয়। বিকেল ৪টার দিকে যাত্রাবাড়ী হয়ে বাড়ি ফিরছিলেন জাফর আহম্মেদ। তিনি বলেন, বিকেল ৪টায় বাসে উঠলাম। কিন্ত এখনো হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে বাস আটকে আছে। এই গরমে এভাবে যানজট বসে থেকে অস্বস্তি লাগছে। কখন যে যানজট কমবে।

ঈদুল ফিতরে পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত মঙ্গলবার একনেকের সভা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল করতে দেওয়া হবে। তবে মূল সেতুতে নয়, সার্ভিস লেন দিয়ে মোটরসাইকেল চলবে। সেতুতে মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ গতিসীমা হবে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার। পরীক্ষামূলকভাবে এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নিয়ম ভাঙলে পুনরায় পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হবে।

ঈদযাত্রা ভোগান্তি কমাতে মহাসড়কে দায়িত্ব পালন করছে হাইওয়ে পুলিশ। উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের ২২টি জেলার কয়েক হাজার মানুষ ও যানবাহন বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম মহাসড়ক দিয়ে প্রতিনিয়ত যাতায়াত করে। কিন্তু ঈদ এলেই এ সড়কের ব্যস্ততা বাড়ে কয়েকগুণ। পাশাপাশি যাত্রী ও চালকদের ভোগান্তিও বাড়ে। এবার মহাসড়কের প্রায় ৫১ কিলোমিটার জুড়ে দুর্ঘটনা ও চাঁদাবাজি রোধসহ শৃঙ্খলা বজায় রাখতে তৎপরতা বাড়িয়েছে হাইওয়ে ও জেলা পুলিশ।

হাটিকুমরুল হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মহাসড়কে ১০টি মোটরসাইকেল মোবাইল টিম, ১৪টি পয়েন্টে ১৪টি পিকেট টিম, দুটি পিকআপ টিম ও একটি অ্যাম্বুলেন্স টিমসহ মোট ১৪১ জন পুলিশ সদস্য কাজ শুরু করেছেন। সচেতনতায় মাইকিং ও ডিজিটাল সাইনবোর্ড লাগানো হচ্ছে। পাশাপাশি ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে ওয়াচ টাওয়ার থেকে সবকিছু মনিটরিং করা হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম কড্ডার মোড় এলাকায় দায়িত্বরত উপ-পরিদর্শক (এসআই) নাজমুল হোসাইন বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমে যানজট দূর করতে কাজ করে যাচ্ছি। তবে পরিবহনের চাপ বাড়ায় দায়িত্ব পালনে আমাদেরও কিছুটা চাপে থাকতে হচ্ছে। যাত্রাবাড়ী এলাকায় দায়িত্বরত ট্রাফিক পরিদর্শক (টিআই) মো. মাহবুব বলেন, ঈদের ছুটিতে রাস্তায় গাড়ির প্রচুর চাপ। সেই কারণে ফ্লাইওভারের ওপরে ও নিচে অনেক যানজট লাগছে। গত মঙ্গলবার থেকে ঈদযাত্রা শুরু হয়েছে, তাই গাড়ির চাপ বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। ঈদযাত্রা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই চাপ থাকবে। অসহনীয় গরমে যানজটের কারণে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত