ঈদে চাঙা গ্রামীণ অর্থনীতি

মানুষ গ্রামমুখী হওয়ায় বাড়ছে লেনদেন

প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

করোনা মহামারির থাবা কেটে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে নেমে আসে টালমাটাল অবস্থা। যার প্রভাব দেশের অর্থনীতিতেও পড়েছে। তবে ঈদে অর্থনৈতিক মন্দাভাব কেটে উঠছে। আবার চাঙাভাব দেখা মিলছে শহর ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে।

ঈদুল ফিতরে প্রবাসীদের আয় ও শহরের মানুষ গ্রামমুখী হওয়ায় গ্রামীণ হাটবাজারে টাকার প্রবাহ বেড়েছে। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের বোনাস, গতিশীল অভ্যন্তরীণ বাজারব্যবস্থার সঙ্গে জাকাত ও ফিতরা যোগ হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, ঈদে গ্রামীণ অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ বাড়ছে। ফলে সচল হয়ে উঠে গ্রামীণ অর্থনীতি। ঈদের সময় আর্থিক মানদণ্ডে অর্থনীতিতে কত টাকা প্রবাহিত হয়, তা নিয়ে সরকারিভাবে কোনো তথ্য নেই। তবে বেসরকারি গবেষণা অনুযায়ী ঈদ উৎসব কেন্দ্রিক অর্থনীতিতে দেড় লাখ কোটি টাকার অতিরিক্ত লেনদেন হয়। এ টাকার বড় অংশই যায় গ্রামে। এ সময় নিম্ন আয়ের মানুষের হাতেও টাকার লেনদেন হয়ে থাকে। এতে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। এটি ইতিবাচক দিক। সেক্ষেত্রে বাড়তি টাকার প্রবাহের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। এজন্য ঈদের পর ওই টাকা উৎপাদন খাতে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ থাকা জরুরি।

রেমিটেন্সের ওপর নির্ভর করে গ্রাম কেন্দ্রিক অর্থনীতি শক্তিশালী হয়ে উঠে। গ্রামে ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে বাড়তি মুনাফা যুক্ত হচ্ছে। সব মিলিয়ে চাঙা হয়ে উঠেছে দীর্ঘদিন ঝিমিয়ে থাকা গ্রামের অর্থনীতি। নাড়ির টানে ঈদ উদযাপনে মানুষের গ্রামে ফেরা এবং তাদের পদচারণায় ঈদের আগে-পরের ১৫ দিন মুখরিত থাকে গ্রাম। এতে গ্রামে নিত্যপ্রয়োজনীয়সহ বিভিন্ন ভোগ্য সামগ্রীর চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে বাড়ে জোগান এবং দামও। মূলত এই বাড়তি চাহিদা এবং যোগান সক্ষমতাই গ্রামের অর্থনীতিকে চাঙা করে তুলেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলেছে, রমজান মাসে দেশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেড়েছে। এপ্রিলের প্রথম দুই সপ্তাহে বাংলাদেশ বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ৯৫৮.৬৯ মিলিয়ন ডলার ওয়েজ আর্নার্স রেমিটেন্স পেয়েছে। ৫১টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে ৭৯৪.৩২ মিলিয়ন ডলার ও বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে ৩.৩২ মিলিয়ন ডলার এসেছে। এছাড়া এপ্রিলের প্রথম ১৪ দিনে ছয়টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে ১৩৪.২৩ মিলিয়ন ডলার এসেছে। বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে ২৬.৮২ মিলিয়ন এসেছে। তবে, মার্চে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছে।

ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় পাঠানোর জন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এজন্য এ বছরের শুরুতে প্রবাসী আয়ে যে ভাটার টান লক্ষ্য করা গিয়েছিল, দুই মাস পর থেকেই বাড়তে থাকে। প্রবাসী আয়ের চিত্র বিশ্লেষণ করলে সেটা লক্ষ্য করা যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম (জুলাই থেকে মার্চ) ৯ মাসে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৬৩০ কোটি মার্কিন ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ১ হাজার ৫২৯ কোটি ডলার। এ অর্থ বছরের ৯ মাসে বেশি এসেছে ৭৪ কোটি মার্কিন ডলার।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ঈদুল ফিতরে শহরের বড় একটি অংশ ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে গ্রামে যান। এরা বাড়তি খরচের কথা চিন্তা করে গ্রামে যাওয়ার আগে থেকেই সাধ্য অনুযায়ী সঞ্চয় করে এবং বেতন-বোনাস বাঁচিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে যান। এসব টাকা এখন বিভিন্ন প্রয়োজনে গ্রামেই হাতবদল হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলেন এবারের ঈদে অর্থনীতির আকার, ধরন ও ব্যাপ্তি অনেক বেড়েছে। মানুষ এই উৎসব ঘিরে প্রচুর পরিমাণ অর্থ খরচ করছেন। এতে উৎপাদনকারী, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী প্রত্যেকে কোনো না কোনোভাবে লাভবান হচ্ছেন। ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

ঈদকে কেন্দ্র করে বিনোদনের জন্য মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামেই বেশি যায়। ফলে গ্রামীণ পর্যটন খাতেও যোগ হয় বাড়তি টাকার প্রবাহ। সার্বিক এই কর্মকাণ্ডের কারণে সাধারণত অন্য মাসের তুলনায় এ সময়ে অতিরিক্ত অর্থের ব্যয় হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই টাকার প্রভাব বেড়ে যায়। সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হয় নতুন পোশাক ক্রয়ে। এ সময় অভ্যন্তরীণ পোশাকের চাহিদা ব্যাপক হারে বাড়ে।

প্রতি বছর ঈদ এলেই গ্রামীণ অর্থ স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে গতিশীল হয়ে উঠে।

ঈদের সবচেয়ে প্রিয় খাবার হচ্ছে সেমাই। আর এই সেমাই প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে সেমাইয়ের বার্ষিক চাহিদা ২০ থেকে ২৫ হাজার টন। অর্থমূল্যে এই বাজার প্রায় ২০০ কোটি টাকার। আর গত বছরের তুলনায় এ বছর সেমাইয়ের চাহিদা অন্তত ১৫ শতাংশ বেড়েছে।

মোড়কজাত সেমাই উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অটো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, দেশে ৪০টির বেশি কোম্পানি রয়েছে, যারা তাদের উৎপাদিত সেমাই মোড়কজাত করে বিক্রি করে। এসব কোম্পানির বাইরে অনেক মৌসুমি প্রতিষ্ঠান উৎসবকেন্দ্রিক খোলা ও মোড়কজাত সেমাই উৎপাদন করে।

সেমাই বিক্রেতারা জানিয়েছেন, ঈদের সময় মানুষ অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে অল্প হলেও সেমাই কেনেন। সেমাইয়ের সঙ্গে কিশমিশ, বাদাম ও চিনি বিক্রির পরিমাণও বেড়েছে। বিক্রেতারা জানান, বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি কিশমিশ ৪৮০ থেকে ৫৫০ টাকা, কাজুবাদাম ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা, চিনাবাদাম ২০০-২২০ টাকা এবং কাঠবাদাম ৮০০ টাকার আশপাশে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১৮-১২৫ টাকার মধ্যে।

ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশ (আইসিসিবি) আয়োজিত এক কর্মশালায় আইসিসি বাংলাদেশের সহসভাপতি এ কে আজাদ বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কোভিড-১৯ মহামারি সময় থেকে শক্তিশালী পুনরুদ্ধার হয়েছে। রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সব বাধা অতিক্রম করে দেশের অর্থনীতি সাফল্যের সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে।