ধনীর সম্পদে গরিবের হক

প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

ইসলামের সৌন্দর্যের অন্যতম অলঙ্কার সদকা। সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে একমাত্র আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে কাউকে কিছু দান করার নাম সদকা। আরবি সদকা শব্দটি এসেছে সিদক থেকে। সিদক মানে সত্য, সততা। নিজের কষ্টার্জিত সম্পদ অন্যকে দান করার পেছনে নানা উদ্দেশ্য থাকতে পারে। অধিক মুনাফা অর্জন, কোনো স্বার্থ হাসিল বা নামধাম কুড়ানো। এ জাতীয় উদ্দেশ্য হাসিলের চিন্তা মাথায় না রেখে নিজের কষ্টার্জিত সম্পদ শুধু ওইসব মানুষই দান করতে পারে, যারা আল্লাহকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এবং দান-সদকাকে আল্লাহর ভালোবাসা লাভের উপায় বলে মনে করে। ধন-সম্পদ আল্লাহই দিয়েছেন, তার সন্তুষ্টির পথে তা ব্যয় করতে হবে, এ বিশ্বাস যাদের নেই তারা কোনো দিনও নিঃস্বার্থভাবে দানখয়রাত করতে পারবে না। কাজেই সদকা ঈমান, ইসলাম ও আল্লাহর ভালোবাসার সত্যায়ন।

প্রশ্ন জাগতে পারে, মানুষ তো নিজের মেধা, যোগ্যতা ও পরিশ্রমের বলে ধন-সম্পদের মালিক হয়। সম্পদ আল্লাহর দান- এ কথা কেন বলা হবে? কোন যুক্তিতে গরিবদের বিলাতে হবে? মক্কার কাফেররাও বলেছিল, যাদের স্বয়ং আল্লাহ বঞ্চিত করেছেন, তাদের আমরা খাওয়াতে যাব কেন? তবে আমরা যখন দেখি, শৈশব ও ছাত্র জীবনে দুই বন্ধু বড় হওয়ার পর অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী বন্ধুটি অনেক ধন-সম্পদের মালিক হয়ে গেছে। আর অপেক্ষাকৃত চালাক ও পরিশ্রমী বন্ধুকে সমানে জীবনের ঘানি টানতে হচ্ছে। তখন আমাদের বিশ্বাস করতে হয়, ধন-সম্পদ শুধু বুদ্ধি ও বাহুবলে উপার্জিত হয় না। এর পেছনে ভাগ্যের জোর ও আল্লাহর দানের যোগ অবশ্যই থাকতে হয়।

জীবনযাত্রায় মানুষ একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল। সমাজে বাঁচতে হলে কুলি, মজুর, কামার, কুমার, দর্জি, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী সবার পারস্পরিক সাহায্য দরকার। এর মধ্যে দেখা যায়, সম্পদের বিদ্যমান বণ্টন ব্যবস্থায় কারো কাছে অতিরিক্ত সম্পদ জমা পড়ছে। কেউ তার প্রাপ্য হক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বণ্টন ব্যবস্থা নির্ভুল থাকলে এমনটি হতো না। তবে গরিব লোকটি কী পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, বা ধনী লোকের কাছে কী পরিমাণ অতিরিক্ত সম্পদ জমা হচ্ছে তা নির্ণয়ের জন্য আল্লাহতায়ালা হিসাবের একটি মানদণ্ড দিয়েছেন। তা হলো, কারো মালিকানায় যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ বাদে নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ-রৌপ্য ও নগদ অর্থ এক বছর পর্যন্ত থেকে যায়, তাহলে বুঝতে হবে, তার সম্পদে সমাজের খেটে খাওয়া মানুষের কিছু সম্পদ এসে জমা হয়েছে, যার নিখুঁত অনুপাতটি হলো, শতকরা আড়াই ভাগ বা চল্লিশ ভাগের এক ভাগ। এই পরিমাণ সম্পদ জাকাত হিসেবে প্রদান করতে হবে, তাহলে ধনীর বাকি সম্পদ পবিত্র হয়ে যাবে।

সদকা-জাকাত শুধু সম্পদকেই পবিত্র করে না, দাতার মনকেও লোভ-মোহ থেকে পবিত্র করে। মনের গহিনে লুক্কায়িত লোভ মোহ কৃপণতা দূর করার একমাত্র মহৌষধ আল্লাহর ওয়াস্তে দান, বিশেষত গোপনে। মনকে লোভ আর চরিত্রকে কৃপণতা থেকে মুক্ত করার এই ব্যবস্থার শুকরিয়া ধনীরা আদায় করতে পারবে না। তারপরও আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ কর, তোমাদের প্রতিপালক ঘোষণা করেন, তোমরা যদি শুকরিয়া আদায় কর আমি তোমাদেরকে অবশ্যই বেশি দেব। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও তাহলে আমার শাস্তি হবে অত্যন্ত কঠিন।’ (সুরা ইবরাহিম : ৭) ।

বস্তুত সদকা-জাকাতে গরিবদের উপকার তো আছেই, ধনীদের জন্য সুফল হলো কৃপণতা থেকে মুক্তি লাভ এবং গরিবদের ভালোবাসার সিক্ত হওয়া। তদুপরি আল্লাহর ভালোবাসায় হৃদয়-মন উদ্ভাসিত হওয়া। এ পথেই ধনী-গরিবে হিংসা ও শ্রেণিবৈষম্যের অবসান এবং স্রষ্টার ভালোবাসায় সৃষ্টির সেবায় মানব বাগানে বসন্তের সমীরণ প্রবাহিত হওয়া সম্ভব।