ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঈদ সালামি ও জন্মভিটায় যেতে না পারার দুঃখবোধ

ঈদ সালামি ও জন্মভিটায় যেতে না পারার দুঃখবোধ

ঈদ সালামি দেয়া ও পাওয়া এখন এক ধরনের সামাজিক রীতিনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছোট-বড় সবাই কেন যেন মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে ঈদের সময় বাড়তি কিছু পাওয়ার। এ ব্যাপারে ছোটদের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। তারা ঈদ ঘনিয়ে আসতে না আসতে ঈদ সালামির জন্য মনে মনে একটা তালিকা করে। এই তালিকা ঈদের দিন পর্যন্ত বাড়তে থাকে। কে কত টাকা ঈদ সালামি পেল, কোনো আত্মীয়স্বজন তাকে ঈদ সালামি দিল সেটা মনের মধ্যে পুষে রাখে। আর কে দিল না সেটা আরো বেশি করে মনে রাখে। কেন না, কেন ঈদ সালামি পাওয়ার যোগ্য হওয়ার পরও কেন ঈদ সালামি দেয়া হল না তার কারণ খুঁজতে থাকে। ঈদ সালামি না দেয়া ব্যক্তির বিরুদ্ধে নানা আলোচনা সমালোচনাও করতে শোনা যায়। ঈদের সময় এখন ঈদ সালামি একটা বাড়তি খরচ হিসেবে যোগ হয়েছে আমাদের পারিবারিক জীবনে। ঈদ সালামি না দিয়ে মাফ পাওয়ার কেন সুযোগ নেই। বিশেষ করে শিশু-কিশোর বয়সি সন্তানরা ঈদের বাড়তি আনন্দ খুঁজে পায় ঈদ সালামি পেয়ে। ঈদ শেষে এই টাকার মোট পরিমাণ অনেক সময় বেশ কয়েক হাজার পর্যন্ত হয়। আর এত টাকা দিয়ে শুধু মজাদার খাবার না খেয়ে অনেক শিশু-কিশোর আগ্রহ ও পছন্দের কোনো জিনিস কিনে নেয়। আমাদের ছোটবেলায় ঈদের দিনে আমরা মুরব্বিদের পা ছুয়ে সালাম করতাম। লেখাপড়ায় যেন ভালো করতে পারি, সেই দোয়া নিতাম। মুরব্বিরাও প্রাণখুলে মহান আল্লাহর দরবারে আমাদের জন্য দোয়া করতেন। ভালোভাবে জীবনযাপন করার উপদেশ দিতেন। আমরা তাদের সেই উপদেশ ও পরামর্শ মেনে চলতাম। কখনো কোনো দিন আর্থিক কোনো কিছু পাওয়ার আশা করতাম না। আসলে সেই সময়ের সামাজিক রীতিতে ঈদের দিনে ছোট কাউকে কিছু দেয়ার মতো সঙ্গতি অনেকেরই থাকত না। মানুষ আয়ের পথ হিসেবে সরকারি চাকুরিকে বোঝাত। একটি পরিবারে একজনের আয়ের ওপর নির্ভর করে পুরো পরিবার চলত। বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ ছিল না। এখন সাধারণ লেখাপড়া জানা মানুষ বিভিন্ন কলকারখানা ও অফিসে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। বিশেষ করে গার্মেন্টে কাজ করে বেতন ছাড়াও অতিরিক্ত সময়ের পারিশ্রমিক এবং দুই ঈদে বেনাস পাচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য ভাতাও পাচ্ছেন। গার্মেন্ট শ্রমিকরাও এখন বেশ ভালোভাবে জীবন যাপন করছেন। তারাও ঈদে আত্মীয়স্বজনের জন্য কেনাকাটা করতে পারছেন। গামেন্ট কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই নারী। বর্তমান সরকার নারীর শিক্ষা, তাদের ক্ষমতায়ন ও কর্মসংস্থানের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়ায় তারা এখন আর কারো মুখাপেক্ষী নয়। সংসারে তাদের একটা ভালো অবস্থান গড়ে উঠেছে। তারাও দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। তারাও কম বেশি আত্মীয়স্বজনের সন্তানদের ঈদ সালামি দিচ্ছে। আসলে মানুষকে দেয়ার মধ্যে অনেক আনন্দ, অনেক তৃপ্তি। মানুষকে কাঁদানো সহজ, কিন্তু হাসানো কঠিন। ঈদ উপলক্ষ্যে কিছু টাকা স্নেহভাজন কাউকে দিতে পারলে নিজের কাছে অনেক ভালো লাগে। তবে কষ্টের কথা হচ্ছে, ঈদ সালামির পরিসর ও ব্যপ্তি দিন দিন বাড়ছে। অথচ আয় তেমন একটা বাড়েনি। সৎ, সততা নিয়ে জীবনযাপন করার সুবিধার্থে ঈদ সালামির ক্ষেত্র সীমিত হলে সুবিধা হতো। ঈদ সালামি দিতে না পারার কষ্ট খুবই বেদনার। সাধ আছে সাধ্য নেই- এমন অবস্থায় নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ধরে রাখার চেষ্টা করতে গিয়ে কষ্ট আরো বাড়ে। তারপরও ঈদ সালামির পরিসর ও পরিমাণ যত কমই হোক না কেন, তা দিয়ে যেমন আনন্দ পাওয়া যায়, তেমনি যে পেল সেও ঈদের দিনের বাড়তি আনন্দ পায়।

ঈদ এলে আরেকটি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলে সবারই জিজ্ঞাসা- ঈদ করবেন কোথায়? এই প্রশ্নটি শোনার পর মনের মধ্যে একটা কঠিন কামড় দেয়। নিজেকে কিছুটা সংবরণ করে বলতে হয়- না কোথাও যাচ্ছি না। পাল্টা প্রশ্ন- তাহলে কি বাড়ি যাবেন না, বিনয়ের সঙ্গে বলি না ভাই, বাড়ি কেউ নেই, যাব কোথায়? অনেক বছর হয়ে গেল বাবা-মা মারা গেছেন। সব ভাই মিলে ঢাকা থাকি। বাড়ি ঈদ করতে যাই না, সেটা জীবনের একটা চরম ব্যর্থতা। কেন না মানুষ গ্রামে গেলে শিকড়ের সন্ধান পায়। শিকড়ের সাথে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে সেই ছোট বেলার মধুর স্মৃতির মধ্যে ডুবে যায়। ছোটবেলায় কত না স্মৃতির কথাই মনে হয়, আত্মীয় বলতে বাবা-মায়ের বাইরে যারা তাদের বয়সি তাদের কেউ এখন আর নেই। ছোট নাম ধরে ডাকার কেউ নেই। কোথায় হারিয়ে গেল সেই আপনজন। তাদের সঙ্গে আর জীবনে কোনো দিন দেখা হবে না। ঈদের দিনে পা ছুয়ে সালাম করে তাদের দোয়া নেয়া হবে না। অধিকাংশ মানুষ ঈদে বাড়ি যান না হয়তো আর্থিক অনটনের কারণে। অর্থনৈতিক কারণে দুটি ঈদ সীমিত আয়ের মানুষের জন্য একটা অসীম দুঃখ, কষ্ট ও বেদনার। কেন না, সংসারের আয়-উপার্জনকারী সদস্য একজন হলে তিনি হাড়ে হাড়ে বোঝেন, ঈদ আসলে তার যন্ত্রণা কতটা বেড়ে যায়। যারা অসৎ উপায় অবলম্বন করে অগণিত টাকা আয় করেন, তাদের হিসাব ভিন্ন। তারা যেভাবে আয় করেন, সেভাবে খরচও করেন। আর যারা সীমিত আয়ের মানুষ, তাদের কাছে হাটবাজার কিংবা শপিং মল যেন যন্ত্রানাগার। ঈদ এলে বার বার খরচের তালিকা পরিবর্তন এবং কাটছাঁট করতে গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। অমুকের সন্তানটাকে তো কিছু দিতে হয়, আপনজনকে দিতে হবে এর সঙ্গে কোনো দ্বিমত নেই কিন্তু সেটা কীভাবে...। মানসম্মানের প্রশ্নটা প্রখর হয়ে উঠে। আমাদের সমাজের এক শ্রেণির মানুষ আছে, যারা পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব করতে থাকে। কেউ কাউকে কিছু না দিলে তার সমালোচনা করা হয়। বিশেষ করে মেয়ের শ্বশুড়বাড়ির লোকজনকে ঈদ উপলক্ষ্যে নতুন কাপড় না দিলে মেয়ের ঈদ মাটি হয়ে যায়। নতুন জামাই পাওয়া না পাওয়ার হিসাব কষতে থাকে। আশানুরূপ না হলে আকার ইঙ্গিতে নানা বাঁকা কথা শোনানো হয় বউকে। সে কারণে মানুষ সামাজিকতা রক্ষা করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। কারো দেবার সামর্থ্য আছে, আবার কারো নেই; সেই হিসাব করেন এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। সারা মাস কাজ করে যে অর্থ আয় করা হয়, তা দিয়ে সংসার খরচ বহন করা কঠিন। তার পর ঈদের মতো উৎসব এলে বোঝা যায় কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে। শিকড়ের সন্ধানে বাড়ি গিয়ে ঈদ করার মতো আনন্দ এখন বেশি স্বাচ্ছন্দ্যময়। গ্রামে বিদ্যুৎ আছে, সিলিন্ডার গ্যাস আছে, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট আছে। আছে নলকূপের সুপেয় পানির ব্যবস্থা। আছে বাড়ির কাছে কমিউনিটি ক্লিনিক। পাকা রাস্তা পেরিয়ে রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কাদামাটির কোনো রাস্তা নেই। পিচঢালা রাস্তা দিয়ে হাটবাজারে কিংবা আত্মীয়স্বজনের বাড়ি সহজেই যাওয়া যায়। তারপরও মানুষ ঈদ করতে বাড়ি যেতে পারে না। নিজ জন্মভিটায় গিয়ে দাঁড়ালে পূর্ব-পুরুষের মুখ খানি ভেসে উঠে। তাদের স্নেহভরা চাহনির কথা মনে করলে মানুষ দুঃখ কষ্ট ভুলে যায়। সেই স্বর্গীয় সুখ লাভ করার মতো সুযোগ কেউ হাত ছাড়া করতে চায় না। কিন্তু সেটি অনেক সময় সম্ভব হয় না। তার পেছনের কারণ, অন্য কারো জন্য কি তা বলতে পারব না। তবে আমার জন্য আর্থিক সংকটই আমাকে রাজধানীর চার দেয়ালের মধ্যে ঈদ করতে বাধ্য করে। ঢাকায় চাকরি করলেই সে অনেক টাকা আয় করে, এমন ধারণা পোষণ করেন- এমন মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। লোকচক্ষু থেকে দূরে থাকতে বাড়িতে ঈদ করার সাহস দেখাতে পারি না। তাই ঈদে যারা বাড়ি যায়, আমার মনে হয় তারা যেন কেনো ‘পুণ্য’ স্থানে গেল। তারা গ্রামের বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফিরে দ্বিগুন উৎসাহে কাজে নামতে পারবে। সেই সঙ্গে নগরজীবনের ব্যস্ততা ও কোলাহল থেকে কয়েক দিনের জন্য হলেও তারা দুরে থেকে ফুরফুরে মেজাজে আবার কর্ম শুরু করতে পারবে। মহান আল্লাহ যেন সবাইকে এমন আর্থিক সক্ষমতা দেন, যাতে তারা অকাতরে ঈদ সালামি দিতে পারে এবং জন্মভিটায় গিয়ে বছরে অন্তত একটা ঈদ করতে পারে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত