ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পুলিশের পুরস্কার ঘোষিত গোল্ড মনি ও ৪ কেজি স্বর্ণের চালান! অতপর...

পুলিশের পুরস্কার ঘোষিত গোল্ড মনি ও ৪ কেজি স্বর্ণের চালান! অতপর...

পুলিশ কর্তৃক পুরস্কার ঘোষিত শেখ শফিউল্লাহ ওরফে গোল্ড মনি (৪৭) সাতক্ষীরার প্রসিদ্ধ চোরাকারবারি ও সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে এবার এক স্বর্ণ চোরাচালানির তিন কোটি টাকার অধিক মূল্যের চার কেজি স্বর্ণ লুটের অভিযোগ উঠেছে। অপরদিকে গোল্ড মনি পাল্টা অভিযোগ তুলেছে তার কাছে পাঠানো এ স্বর্ণ দুর্বৃত্তর ছদ্মবেশে স্থানীয় পুলিশ সদস্যরাই লুটে নিয়েছে। এ নিয়ে আলোচনা সমালোচনার মধ্যদিয়ে সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরা থেকে পুলিশ সদর দপ্তর পর্যন্ত সর্বত্রই হৈচৈ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

জানা গেছে, শেখ শফিউল্লাহ মনি সাতক্ষীরা সদরের দক্ষিণ কাটিয়া গ্রামের শেখ মোশারফ হোসেনের ছেলে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সীমান্তবর্তী থানাসমূহে দশটির অধিক মামলা রয়েছে। ২০১২ সাল থেকে রুজু হওয়া মামলাগুলো চোরাচালান ও স্বর্ণ লুটবিষয়ক। এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে তার কাছে চার কেজি স্বর্ণ কেন পাঠানো হয়েছিল, সে প্রশ্নের জবাব মিলছে না। মনি নিজে স্বর্ণ ব্যবসায়ী নন, কোনো জুয়েলারি দোকানও নেই তার। তবে কী তিন কোটি টাকার অধিক মূল্যের এ স্বর্ণ ভারতে পাচার করতেই পাঠানো হয়েছিল তার কাছে? বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকে শফিউল্লাহ মনির অতীত রেকর্ড তেমনই জানান দিচ্ছে। মূলত ঢাকা থেকে জনৈক ব্যবসায়ীর পাঠানো স্বর্ণের চালান তার কাছে পৌঁছানোর আগে তিনি নিজেই তা লুট করেন এবং তা জায়েজ করতেই সাতক্ষীরা পুলিশের ওপর দোষ চাপান বলে অভিযোগ উঠেছে।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শফিউল্লাহ মনি ওরফে গোল্ড মনি সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের এক সদস্যের সঙ্গে আঁতাত করে জেলায় অস্ত্র, স্বর্ণ ও চোরাচালান সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। সাংবাদিক, গোয়েন্দা সংস্থাসহ একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শফিউল্লাহ মনি সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য ডন খ্যাত আল ফেরদৌস আলফা। সে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য।

সাতক্ষীরায় পুলিশ সুপার হিসেবে কাজী মনিরুজ্জামান যোগদানের পর মাদকবিরোধী এক অভিযানে গত বছরের ২৬ নভেম্বর ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার হন আলফা। এরপর থেকে আলফা গোয়েন্দা নজরদারিতে থাকায় দায়িত্ব¡ বেড়ে যায় সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য শফিউল্লাহ মনির। তবে তিন মাস ধরে সিন্ডিকেটের দায়িত্ব পালনের ঘটনায় নতুন করে পুলিশের সামনে আসে গোল্ড মনি।

ডাকাতিতেও উঠে আসে গোল্ড মনির নাম : গত ৫ মার্চ দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কোটার মোড়ে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে পুলিশের সঙ্গে ডাকাত সদস্যদের গোলাগুলিতে চার পুলিশ সদস্য ও এক ডাকাত সদস্য আহত হওয়ার ঘটনায় রিমা- শেষে পাঁচজন ডাকাত সদস্যের মধ্যে তিনজন ডাকাত সদস্য আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। বিচারিক হাকিম মহিদুল ইসলামের কাছে হুমায়ুন কবীর, বিচারিক হাকিম রাকিবুল ইসলামের কাছে শেখ শহীদুজ্জামান প্রিন্স ও বিচারিক হাকিম সালাউদ্দিনের কাছে শহীদুল ইসলাম এ জবানবন্দি দেন।

মামলার বিবরণে জানা যায়, গত ৫ মার্চ রোববার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে সাতক্ষীরা যশোর সড়কের কলারোয়ার কোটার মোড়ে পরিবহনে ডাকাতির প্রস্তুতি নেয় একটি গ্রুপ। সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে গেলে পুলিশের সঙ্গে ডাকাত দলের বন্দুকযুদ্ধে চার পুলিশ সদস্য আহত হন। গুলিবিদ্ধ হয়ে সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পুলিশ প্রহরায় চিকিৎসা নেন ডাকাত সদস্য মিজানুর রহমান। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ দুটি প্রাইভেট কার, একটি নতুন বিদেশি পিস্তল, দুই রাউ- গুলি, দুটি চাপাতি ও তিনটি মোবাইল ফোন জব্দ করে।

এ ঘটনায় ৬ মার্চ কলারোয়া থানার উপ-পরিদর্শক অনিল মুখার্জী বাদী হয়ে গ্রেপ্তারকৃত সাতক্ষীরা শহরের মধ্যকাটিয়া এলাকার শেখ আব্দুল হামিদের ছেলে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য শেখ শাহীদুজ্জামান প্রিন্স (২৮), যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার হাজির আলী গ্রামের বশির আহম্মেদের ছেলে হুমায়ুন কবির (৩৭), যশোর জেলা সদরের মোল্যাপাড়া গ্রামের ফজর আলী উকিলের ছেলে শহীদুল ইসলাম (৬০), একই গ্রামের ধলা ম্য়িার ছেলে মিজানুর রহমান (৫০), যশোর জেলার শার্শা উপজেলার বসতপুর গ্রামের আব্দুল ওহাবের ছেলে আবুল কালাম (৫৫), একই গ্রামের নূর মোহাম্মদের ছেলে আব্দুল্লাহ আল মামুনের (৩০) নামসহ যশোরের শার্শা উপজেলার সেতাই গ্রামের আব্দুল গণি বিশ্বাসের ছেলে কবীর বিশ্বাস (৪৬) ও সাতক্ষীরা শহরের দক্ষিণ কাটিয়ার শেখ মোশারফ হোসেনের ছেলে শেখ শফিউল্লাহ ওরফে মনিরুল ওরফে গোল্ড মনিকে (৪৭) পলাতক দেখিয়ে অজ্ঞাতনামা আরো ২/৩ জনের বিরুদ্ধে ডাকাতির চেষ্টা ও অস্ত্র আইনে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন।

মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা কলারোয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক বাবুল আক্তার ৭ মার্চ গ্রেপ্তারকৃত শেখ শাহীদুজ্জামান প্রিন্স, হুমায়ুন কবীর, শহীদুল ইসলাম, আবুল কালাম ও আব্দুল্লাহ আল মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে সাত দিন করে রিমা- আবেদন করেন। ১২ মার্চ বিচারিক হাকিম রাকিবুল ইসলাম শুনানি শেষে পাঁচ আসামির প্রত্যেককে তিন দিন করে রিমা- মঞ্জুর করেন। এর একদিন আগেই তিনজন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

অপকর্ম করে নানা সম্পদের মালিক : অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাতক্ষীরা শহরে কাটিয়া, নারকেলতলা, দাসপাড়া, ঋশিল্পিসহ শহরের বিভিন্ন এলাকা এবং ঢাকা শহরে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির মালিক বনে গেছেন চোরাকারবারি মনি। চোরাচালান, মাদক ব্যবসাসহ অবৈধভাবে এসব সম্পত্তি অর্জন করেছেন তিনি। শুধু সাতক্ষীরাতেই পৌরসভাধীন নারকেলতলার মোড়ে সাজিদ মটরস, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সামনে সংগ্রাম মটরস, কালীগঞ্জের নলতায় বাজাজ মটরসের শোরুম রয়েছে তার। বিনেরপোতা এলাকায় নির্মিত একটি বিলাসবহুল বাড়িসহ লেটেস্ট মডেলের প্রাইভেট কার ও মালবাহী ট্রাকের মালিকানা রয়েছে তার। নামে বেনামে শফিউল্লাহ মনির নগদ অর্থসহ শত কোটি টাকার সহায় সম্পদ রয়েছে বলে জানা গেছে।

যা বললেন এসপি কাজী মনিরুজ্জামান : এসব বিষয়ে সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান বলেন, ‘শফিউল্লাহ মনি একাধিক মামলার আসামি। তার বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে।’ ‘বর্তমানে পলাতক শফিউল্লাহ মনিকে গ্রেপ্তারের জন্য রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। পালিয়ে থেকেও সে সরকারবিরোধী বিভিন্ন কাজে লিপ্ত রয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধেও নানা প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। তাকে গ্রেপ্তার করার পর তাদের ষড়যন্ত্রের বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।’

এদিকে সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ গত ২০ মার্চ শফিউল্লাহ মনিকে ধরিয়ে দিতে বা তথ্য দিতে পারলে পুরস্কারের ঘোষণা দেয়। তাকে ধরিয়ে দিতে সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান জেলা পুলিশের ফেইসবুক পেজে পোস্ট দেন। সেখানে শফিউল্লাহ মনির সন্ধান পেলে কলারোয়া থানার ফোন নম্বর ০১৩২০-১৪২১৪৪, ০১৩২০-১৪২২০৫, ০১৩২০-১৪৩০৯৮ কল করার জন্য অনুরোধ করা হয়।

এসব বিষয়ে দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রযুক্তির সহায়তায় কথা হয় শেখ শফিউল্লাহ ওরফে গোল্ড মনির সঙ্গে। তিনি নিরাপত্তার ইস্যুতে দেশের ভেতর আত্মগোপনে আছেন জানিয়ে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন- এসব অভিযোগ মিথ্যা বানোয়াট। তিনি পাল্টা অভিযোগ করে বলেন- এসপি ডিবির টিম ব্যবহার করে আমার স্বর্ণ আত্মসাৎ করেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে বলেন- আমার বিরুদ্ধে পুরোনো কোনো মামলা নেই। সব মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছি। নতুন করে এসপি আমার নামে ৩টা নতুন মামলা দিয়েছে। এখন মোট ৫টা মামলা চলমান। তিনি প্রশ্ন রাখেন- এতো বড় বড় আসামি থাকতে আমার মতো একজন সাধারণ ব্যবসায়ীকে ধরতে রেড এলার্ট জারি করতে হয় কেন?

স্বর্ণের পরিমাণ নিয়েও জানিয়েছেন নতুন তথ্য। তিনি বলেন- ২০ পিস স্বর্ণের বার ছিল। যার ওজন ২০০ ভরি বা আনুমানিক আড়াই কেজি। তিনি পুলিশ কর্তৃক তার স্বর্ণ আটকের কথা জানিয়ে তা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার দাবি জানিয়েছেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত