ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রড-সিমেন্টের দাম বৃদ্ধি

ঝিমিয়ে পড়ছে আবাসন খাত

ঝিমিয়ে পড়ছে আবাসন খাত

বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাড়ায় সরকারি-বেসরকারি আবাসন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফলে রাজধানীসহ সারা দেশে অবকাঠামো নির্মাণে ধীরগতি ও ফ্ল্যাট বিক্রিতে ধস নামছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, অবকাঠামো নির্মাণে মূল উপাদন রড ও সিমেন্ট। আর এই দুটি উপাদানের কাঁচামাল আমদানি নির্ভর হওয়ায় দাম বেড়েছে। এতে বিপাকে পড়ছে আবাসন খাতের ডেভেলপার কোম্পানিগুলো। বছরের ব্যবধানে এক লাফে আগের সব রেকর্ড ভেঙে বেড়েছে রড-সিমেন্টের দাম। ঢাকার বাজারে প্রতি টন রড ১ লাখ ২ হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। আর মফস্বল এলাকায় রডের দাম আরও বেশি। অথচ গত এক বছর আগেও প্রতি টন রডের দাম ছিল ৮০ হাজার টাকার কাছাকাছি। এক বছরের ব্যবধানে প্রতি টন রডের দাম বাড়ল অন্তত ২২ হাজার টাকা। অন্যদিকে সিমেন্টের প্রতি বস্তা ৪৯০ টাকা থেকে সাড়ে ৫০০ টাকায় পৌঁছেছে। সিমেন্টের বস্তাপ্রতি ১১০ টাকা বেড়েছে। তবে সিমেন্টের মান ভেদে দাম কমবেশি বিক্রি হচ্ছে। রড-সিমেন্টের দাম বাড়ায় আবাসন ও নির্মাণ খাতে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া প্রতি ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় কাঁচামাল আমদানি পণ্যে সরাসরি প্রভাব পড়ছে। গুনতে হচ্ছে বাড়তি শুল্কহার। যার প্রভাব পড়ছে সর্বত্র।

বহুতল ভবন ও বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে শুষ্ক মৌসুম বেঁচে নেয় ডেভেলপার কোম্পানিগুলো। তবে এবার নির্মাণ মৌসুমেই রড ও সিমেন্টের বেচাকেনা কমেছে। এক বছর আগে যেসব ঠিকাদার সরকারি-বেসরকারি ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন এখনো তারা তা সম্পন্ন করতে পারেনি। রড-সিমেন্টের দাম বাড়ায় এসব ঠিকাদার অনেকটা বিপাকে পড়েছেন। ফলে সরকারি নির্মাণার্ধীন প্রকল্পের কাজ ফেলে রাখছেন ঠিকাদাররা। বেসরকারি নির্মাণকারী বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই নতুন প্রকল্পের কাজ শুরু করতে চাচ্ছে না।

সম্প্রতি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির (বিএসিআই) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এক বছরের ব্যবধানে রডে প্রতি টনে প্রায় ৬০ শতাংশ দাম বেড়েছে, সিমেন্ট প্রতি ব্যাগে ২২ শতাংশ বেড়েছে। কারণ রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপ ও সিমেন্ট উৎপাদনের কাঁচামাল ক্লিংকারের পুরোটাই আমদানি করতে হয়। তাছাড়া পাথর প্রতি ঘনফুটে ২৪ শতাংশ, ইট প্রতি হাজারে ২২ শতাংশ, মোটা বালু প্রতি ঘনফুটে ৫০ শতাংশ, ইলেক্ট্রিক ক্যাবলে (১.৫ বিওয়াইএ) ৯৪ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়েছে।

রড-সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বৈদেশিক মুদ্রা সংকটে বর্তমানে ঋণপত্র (এলসি) খোলা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য রড তৈরির পুরনো জাহাজ আমদানি কমেছে। এছাড়াও পুরনো জাহাজ কাটতে গ্যাস-বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম আগের তুলনায় বেড়েছে। এসব মিলেই মূল্যবৃদ্ধিতে রড-সিমেন্ট উৎপাদন খরচ আগের তুলনায় বাড়ছে, যার প্রভাব এরই মধ্যে দেশের বাজারে পড়েছে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, নিউমার্কেট, উত্তরা, যাত্রাবাড়ীসহ বেশকিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মান ভেদে বিভিন্ন কোম্পানির রড-সিমেন্ট বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে। বিএসআরএম রড প্রতি টন ১ লাখ ২ হাজার, জিপিএইচ ১ লাখ দেড় হাজার, একেএস ১ লাখ ১ হাজার, আরএসএম ৯৯ হাজার ৫০০ টাকা, আকিজ ৯৮ হাজার টাকা এবং আরআরএম প্রতি টন রড ৯৭ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও সিমেন্টের কাঁচামালের দাম বাড়ায় বাজারে ৫০০ টাকার নিচে কোনো ব্র্যান্ডের সিমেন্টের বস্তা বিক্রি হচ্ছে না। স্ক্যান সিমেন্ট বস্তা ৫৬০ টাকা, শাহ স্পেশাল সিমেন্ট ৫৩০ টাকা একই দামে বিক্রি হচ্ছে বসুন্ধরা সিমেন্ট। ক্রাউন সিমেন্ট বস্তা ৫৩০ টাকা এবং বেঙ্গল সিমেন্টের বস্তা ৫২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

রড-সিমেন্টের দাম বাড়ায় দোকানে বিক্রি কমেছে বলে জানান কুড়িল প্রগতি সরণি এলাকায় হেলমি এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাসিন রহমান হেলমি। তিনি বলেন, রড-সিমেন্টের দাম কম থাকাকালীন যে হারে বিক্রি হয়েছে, এখন বেচাকেনা অর্ধেকে নেমেছে। দোকানভাড়া, কর্মচারীদের বেতন, অগ্রিম ট্যাক্স ও ব্যাংক লোন নিয়ে খুবই বিপাকে আছি।

বাড্ডা শাহজাদপুর এলাকার ন্যাশনাল স্টিল করপোরেশনের ব্যবসায়ী মাহবুব আলম বলেন, মাত্রাতিরিক্ত দাম বাড়ায় সরকারি, ডেভেলপার কোম্পানি কিংবা ব্যক্তি পর্যায়ে কেউ নতুন করে কাজ শুরু করার সাহস পাচ্ছে না। যারা পুরনো কাজগুলো চালিয়ে যাচ্ছিল, তারাও এখন কাজ বন্ধ রেখেছেন।

নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এনজাক ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের এমডি মামুর রশিদ বলেন, রড-সিমেন্টের দাম বাড়ায় নতুন করে কাজ শুরু করার সাহস পাচ্ছি না। কারণ পুরোনো প্রকল্পের কাজ নিয়ে বিপাকে আছি। খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে এরই মধ্যে ফ্ল্যাটের দাম ৩০ শতাংশ করে বেড়ে গেছে। আগে যে ফ্ল্যাট এক কোটি টাকায় বিক্রি করেছি, সেটি এখন এক কোটি ৩০ লাখ টাকা বিক্রি করতে হবে।

মামুর রশিদ বলেন, রড-সিমেন্টের মূল্যবৃদ্ধির আগে যেসব ফ্ল্যাট বিক্রি করেছি, খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে এখন আগের দামে ক্রেতাদের বুঝিয়ে দিতে পারছি না। যারা কিনছে তারাও বেশি দাম দিতে চাচ্ছে না। যার কারণে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের মধ্যে নিয়মিত ঝামেলা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।

রড-সিমেন্টের কয়েকজন জানান, বিভিন্ন সময়ে ডলারের দাম বাড়ায় টাকার মান কমলেও এতোটা হেরফের হয়নি। ডলারের সঙ্গে হয়তো দু’এক টাকা এদিক-সেদিক হয়েছে। কিন্তু চলতি বছরে প্রতি ডলার সমান টাকার মান ১১৩ টাকায় পৌঁছেছে। ফলে কোনো সিন্ডিকেট নয়, রডের মূল কাঁচামাল আমদানির খরচ টনপ্রতি ৭০০ ডলার থেকে বেড়ে হাজার ডলার হয়েছে। আবার বিভিন্ন সময়ে ডলার সংকটে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসে দেরি হওয়ায় জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও ডিজেল ও অকটেনের দাম বাড়ায় চট্টগ্রাম থেকে কাঁচামাল কারখানায় আনা এবং তৈরি পণ্য গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। যার কারণে রড-সিমেন্টের দাম বাড়ছে।

এ প্রসঙ্গে আমদানিকারকরা বলছেন, করোনা মহামারির পর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিমণ্ডল পরিবর্তন হয়েছে। সেক্ষেত্রে শুধু রডের কাঁচামাল নয়, সব পণ্য আমদানিতে খরচ বাড়ছে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি শুল্কও বেড়ে যাচ্ছে। ডলারের দাম বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব না হলে আমদানি পণ্যে ব্যয় বাড়তেই থাকবে। এতে করে অবকাঠামো নির্মাণে খরচ বাড়তে থাকবে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ড. গোলাম রহমান বলেন, টাকার বিপরীতে ডলারের দামের অজুহাতে রড-সিমেন্টের দাম কয়েকগুণ বাড়ানো হচ্ছে। ফলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বেসরকারিভাবে যারা অবকাঠামো নির্মাণ করছে তাদের ওপর চাপ বাড়তে শুরু করেছে। তাই সরকারের উচিত দাম বৃদ্ধির বিষয়টি এখনই খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া। যাতে করে রড ও সিমেন্টের দামে লাগাম টানা যায়।

রড-সিমেন্টের দাম বাড়লে সরাসরি আবাসন খাতে এর প্রভাব পড়ে। বহুতল ভবন নির্মাণে ফ্ল্যাটের ব্যয় বাড়লে বিক্রি কমে যায়। ফ্ল্যাটের দাম বাড়ায় অনেক ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে ডেভেলপার কোম্পানিগুলোকে। ক্রেতাদের কাছে বেশি দাম চাওয়া যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে সংকটের মধ্যে রয়েছে ডেভেলপার কোম্পানিগুলো।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএম) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও শাহরিয়ার স্টিল মিলসের এমডি শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ বলেন, ডলারের মূল্য, কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। যার কারণে এর প্রভাব বাজারে পড়েছে। ফলে যা উৎপাদন করছি সেটাও বিক্রি হচ্ছে না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত