রাজধানীতে আলোচনা সভায় আইনমন্ত্রী

কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা শ্রমিকের আইনগত অধিকার

দেশব্যাপী জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি দিবস পালিত

প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে নানা আয়োজনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি দিবস পালিত হয়েছে। গতকাল শুক্রবার দিবসটি উপলক্ষ্যে বর্ণাঢ্য র‌্যালির পাশাপাশি রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।

আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘কল কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা এবং সুরক্ষা প্রত্যেক শ্রমিকের আইনগত অধিকার। এ অধিকার বাস্তবায়নে নিরাপদ ও শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিতের কোনো বিকল্প নেই। শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে বাংলাদেশ শ্রম আইন এবং শ্রম বিধিমালার যথাযথ প্রয়োগ সব অংশীজনের সম্মিলত উদ্যোগের বাস্তবায়নে আবশ্যক।’ আনিসুল হক বলেন, ‘কল কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে নিরাপদ শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণের কোনো বিকল্প নেই। এই উদ্যোগ সরকারের পাশাপাশি কল কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের মালিক, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, শ্রমিক সংগঠন, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা সম্মিলতভাবে সুর্নিদিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং কর্মক্ষেত্রে তা যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।’

আইনমন্ত্রী বলেন, ‘টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষাবিধি পালন ও শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে পেশাগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা বর্তমান সরকার এবং মালিকপক্ষের ইচ্ছার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণের বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ নেই। এটি এখন কারখানার মালিকপক্ষের জন্য দায়বদ্ধতায় পরিণত হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন ও শ্রম বিধিমালার ভিত্তিতে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং শোভন কর্মপরিবেশ বজায় রাখা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বাংলাদেশ যেভাবে উন্নত বিশ্বের অভিমুখে যাত্রা করছে, সেখানে পেশাগত সুরক্ষার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা পালনকে জাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকল্পে গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের আয়োজিত সকল কর্মসূচি প্রশংসার দাবি রাখে।’

আনিসুল হক বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর তৎকালীন বাংলাদেশের সব কল-কারখানা জাতীয়করণ করেন। এর প্রধান কারণ ছিল- কল-কারখানার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং শ্রমজীবী মানুষের পেশাগত সুরক্ষা ও আইনগত অধিকার নিশ্চিত করা। বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শকে অনুসরণ করেই তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার দেশের সকল খাতের শ্রমজীবী মানুষের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নানাবিধ কল্যাণমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ ও উন্নত দেশের কাতারে সামিল হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে সরকার ব্যাপক উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচি বাস্তবায়নে সকলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে দেশের মেহনতি ও শ্রমজীবী মানুষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এজন্য শ্রমিকদের জন্য শোভন কর্মপরিবেশে কাজ করার বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে।’

দেশে শিল্প কারখানা বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ এমন মন্তব্য করে আনিসুল হক বলেন, ‘তৈরি হয়েছে অসংখ্য নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র। এদেশের রপ্তানি বাণিজ্য আজ বিশ্বব্যাপী বিকাশ লাভ করেছে। রপ্তানি বাণিজ্যের বাজার ধরে রাখার পাশাপাশি আর বিস্তৃত করার লক্ষ্যে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমমান অনুযায়ী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও কর্মক্ষেত্র কল্যাণমূলক ব্যবস্থাসমূহ নিশ্চিত করাসহ উৎপাদনে প্রতিটি ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হবে।’

আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার আগামী প্রজন্মের জন্য স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে যেতে চায়। ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রম প্রকল্পের আওতায় এ বছর এক লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে। শিশু শ্রম মুক্ত নিরাপদ সকল কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সকলের সহযোগিতায় ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে পারব বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’

শ্রমিকদের পেশাগত কারণে অনেক রোগ হয় এমন মন্তব্য করে মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, পেশাগত রোগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ও রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সম্পর্কে গবেষণা করা হচ্ছে। এই লক্ষ্যে কারখানার মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ ও কর্মবৃদ্ধি প্রণয়নের লক্ষ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় রাজশাহীতে ‘জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট’ স্থাপন করেছে। এই ইনস্টিটিউটে ৪২টি ট্রেডে পেশাগত স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও গবেষণার জন্য প্রকল্পের সিডিউল তৈরি করা হয়েছে। খুব শিগগিরই ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম চালু হবে।

শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, শ্রম মন্ত্রণালয় সারা দেশের প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সকল শ্রমিককে ডাটাবেজ এর অন্তর্ভুক্ত করার কাজ শুরু করেছে, গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য ইনজুরি স্কিম চালু করেছে এবং শ্রমিকদের সর্বজনীন পেনশন চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, শ্রমিকদের পেশাগত রোগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা, প্রতিরোধে গবেষণা, মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ প্রদানের লক্ষ্যে রাজশাহীতে ‘জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা এবং প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হয়েছে, খুব শিগগিরই এ ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম চালু হবে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘শ্রম বিধিমালা-২০১৫’কে সম্প্রতি যুগোপযোগী করে সংশোধন করা হয়েছে। শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশ শ্রম আইন আবারো সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সংশোধিত এই শ্রম আইন অর্থনৈতিক অঞ্চলেও কার্যকর হবে। ইপিজেড এলাকায় শ্রমিকদের জন্য শ্রম বিধিমালা কার্যকর করা হয়েছে। সরকারের এসব কার্যক্রমে শ্রমজীবী মানুষের পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি নিশ্চিত হবে বলে তিনি আশাবাদী।

মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, আমরা শ্রমিকদের যে কোনো সমস্যার সমাধান, তাদের কল্যাণ এবং জীবনমান উন্নয়নে রাত-দিন কাজ করছি। তারপরও কতিপয় শ্রমিক নেতা দেশের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে আইএলওতে অভিযোগ দেন। তাদের কঠোর সমালোচনা করে শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, আপনারা যেকোনো সমস্যা আমাদের জানান, ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদ আছে তাদের জানান, শ্রমিক বান্ধব প্রধানমন্ত্রীকে জানান, শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষায় যে কোনো সমস্যার সমাধান করা হবে। অযথা দেশের বিরুদ্ধে আইএলওসহ অন্য কোনো সংস্থার কাছে অভিযোগ দেবেন না। দেশের ক্ষতি করবেন না।

আলোচনা সভার সভাপতির বক্তব্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. এহছানে এলাহী বলেন, ‘শ্রমিক, মালিক ও সরকার মিলে আমরা শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে ইতোমধ্যে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছি। শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে আমরা উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হব। বাংলাদেশে পেশাগত স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা বিষয়ে আন্তরিক অবদান রাখায় আইএলও, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক ও জার্মানিসহ উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র ও সংস্থার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন শ্রম সচিব। স্বাগত বক্তব্যে কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কারখানার সংস্কার কাজ তদারকি ও ত্বরান্বিতকরণে স্ট্রাকচারাল, ফায়ার ও ইলেকট্রিক্যাল সেইফটি বিষয়ে দক্ষ পরিদর্শকদের সমন্বয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেইফটি ইউনিট গঠন করা হয়েছে কারখানার সেইফটি নিশ্চিতকরণে ৬ হাজার ৫৯২টি সেইফটির কমিটি গঠন করা হয়েছে। নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র নিশ্চিতকরণে ৬ হাজার ৪৯৭টি কারখানায় শিশুকক্ষ স্থাপন করা হয়েছে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. এহছানে এলাহীর সভাপতিত্বে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক মো. নাসির উদ্দীন আহমেদ, শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী, কানাডিয়ান হাইকমিশনের হেড অব কো-অপারেশন জো গুডিংস, আইএলও-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর তোমো পুটিআইনেন, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি আরদাশির কবির, বিজিএমইএ-এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি খসরু চৌধুরী, বিকেএমইএ’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মানসুর আহমেদ, জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি নুর কুতুব আলম মান্নান বক্তব্য দেন। এর আগে সকালে শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেলুন আর পায়রা উড়িয়ে জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি দিবস উপলক্ষ্যে এক বর্ণাঢ্য র‌্যালির উদ্বোধন করেন। র‌্যালিটি বিজয়নগর শ্রম ভবনে শুরু হয়ে পল্টন, জিরো পয়েন্ট দিয়ে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে গিয়ে শেষ হয়। এ বছর ৮ বারের মতো ‘নিশ্চিত করি শোভন কর্মপরিবেশ, গড়ে তুলি স্মার্ট বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে জাতীয় পর্যায়ে দিবসটি পালন করা হয়।