ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

এবারের ঈদযাত্রা

দরিদ্রের ট্রেন ছিল ধনীদের বাহন

অনলাইনভিত্তিক টিকিট বিক্রির সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি : সুজন
দরিদ্রের ট্রেন ছিল ধনীদের বাহন

এবারের ঈদ যাত্রায় ট্রেনের টিকিট প্রত্যাশীদের ভিড় ও কালোবাজারি ঠেকাতে শতভাগ অনলাইনভিত্তিক টিকিট ব্যবস্থা চালু করে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এই উদ্যোগটি সুনামের পাশাপাশি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। ফলে আগামী মাসেই ট্রেনের টিকিট ব্যবস্থাপনা সেই আগের নিয়মেই ফিরছে বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রত্যেক বছর ঈদের আগে-পরে ট্রেনে যাত্রীদের চাপ সামাল দিতে হিমশিম খান রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কমলাপুর, এয়ারপোর্ট, চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুরসহ দেশের সব স্টেশনে টিকিটপ্রত্যাশীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটতে হয়েছে। টিকিট কালোবাজারি হয়েছে। যার ফলে ভোগান্তিতে পড়ে লাখ লাখ মানুষ। এই ভোগান্তি ও কালোবাজারি ঠেকাতে এবারের ঈদ যাত্রায় অনলাইন টিকিটিংয়ের ব্যবস্থা করে রেল কর্তৃপক্ষ। তবে ট্রেনের টিকিট শতভাগ অনলাইন করায় স্বল্প আয়ের মানুষ, যাদের হাতে স্মার্টফোন নেই কিংবা স্মার্টফোন থাকলেও অনলাইন সম্পর্কে খুব একটা ধারণা নেই তাদের টিকিট পেতে সমস্যায় পড়তে হয়েছে।

বাস, মাইক্রো, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেলের তুলনায় দূরপাল্লার যোগাযোগের জন্য স্বস্তি ও নিরাপদ বাহন হচ্ছে ট্রেন। দৈনিক বহু যাত্রী ট্রেনে চলাচল করেন। ট্রেন স্বস্তির পরিবহন হলেও টিকিট কালোবাজারি হওয়ায় অস্বস্তিতে পড়তে হয় যাত্রীদের। সেই অস্বস্তি কাটিয়ে উঠতে ট্রেন ভ্রমণে অনলাইন ব্যবস্থা চালু করে রেল। ‘টিকিট যার, ভ্রমণ তার’- এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে ঈদযাত্রায় আন্তঃনগর ট্রেনে অনলাইন ব্যবস্থা চালু করা হয়। এতে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) অথবা জন্ম নিবন্ধন সনদ ও মোবাইল নম্বর দিয়ে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে রেলওয়ে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কালোবাজারিরা ট্রেনের টিকিট কাউন্টার থেকে বিভিন্ন নামে কেটে রাখে, ট্রেন ছাড়ার আগ মুহূর্তে টিকিটগুলো দ্বিগুণ দামে যাত্রীদের কাছে বিক্রি করে আসছে। এই কালোবাজারি বন্ধ করতে শতভাগ অনলাইন ব্যবস্থা চালু করা হয়।

ট্রেনের টিকিট সংগ্রহের নিয়ম অনুযায়ী, একটি জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে চারটি টিকিট সংগ্রহ করা যায়। যা সপ্তাহে দুবার টিকিট নেয়া যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে টিকিট কেনা যায়, আর যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই তারা জন্মনিবন্ধন সনদ বা পাসপার্ট দিয়েই টিকিট কিনতে পারেন। বিদেশি নাগরিকরাও একইভাবে পাসপোর্টের মাধ্যমে টিকিট কিনতে পারেন।

রেলওয়ের কর্তৃপক্ষ বলছে, ঈদুল ফিতরে যাত্রীদের ভোগান্তি ও টিকিট কালোবাজারি বন্ধ করতে শতভাগ অনলাইন ব্যবস্থা করা হয়। তবে আজকের পর স্টেশন ও অনলাইন উভয় সিস্টেমে টিকিট কাটতে পারবেন যাত্রীরা।

রেল কর্তৃপক্ষের দূরদর্শিতার অভাবে টিকিট ব্যবস্থায় শুরুতেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। অনলাইন নিবন্ধনের মাধ্যমে টিকিট কেনার পদ্ধতিতে একজনের এনআইডি নম্বর এবং একটি মোবাইল ফোন প্রয়োজন হয়, অনেকেই প্রথম দিকে তাদের আন্তঃনগর ট্রেন ভ্রমণের জন্য টিকিট ঠিকমতো কিনতে পারেননি।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ট্রেনে যাত্রীর চাপ কমাতে টিকিট সিস্টেম শতভাগ অনলাইনে করে রেলওয়ে। এতে বহু প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ট্রেনে যাতায়াত করতে পারেনি। আবার বাসে ভাড়া বেশি হওয়ায় বহু মানুষ এবারের ঈদে গ্রামে যাননি। দ্রব্যমূল্যের ভয়াবহ ঊর্ধ্বগতির মধ্যে দরিদ্র মানুষের জন্য ট্রেনের টিকিট অনলাইন করায় বেশি কষ্টে পড়েন।

বদিউল আলম মজুমদার আরও বলেন, টিকিট অনলাইন করায় রেল কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা হয়তো সঠিক ছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য সঠিক হয়নি। আর এসব সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে খুব একটা পর্যালোচনাও করা হয়নি। কারণ ভোট ছাড়াই যখন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন, তখন মানুষের কাছে জবাবদিহিতার কিছু থাকে না। রেল কর্তৃপক্ষ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটির জবাবদিহিতা নেই।

যারা মোবাইল সেট ব্যবহারে পুরোপুরি অভ্যস্ত নন, তাদের জন্য এটি একটি কষ্টকর কাজ হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ট্রেন ব্যবস্থাপনা টিকিয়ে রাখতে বছরের পর বছর বিপুল অঙ্কের অর্থ ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। ভর্তুকির অর্থ শুধু ধনাঢ্য শ্রেণির মানুষ পাবেন, সেটি মোটেও কাম্য নয়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেন ভর্তুকি সুবিধা পান, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে বাংলাদেশ রেলওয়েকে।

রেল গণ মানুষের বাহন, এটি যাতে এলিট শ্রেণির বাহন না হয়, সেজন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করবে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। অনলাইনে টিকিট কাটতে চার্জের নামে বাড়তি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে যাত্রীদের, এ ব্যাপারেও আলোচনা করা হবে বলে জানান মোজাম্মেল হক।

ঈদের আগমুহূর্তে ট্রেনে শতভাগ অনলাইন টিকিটিং ব্যবস্থাটি সুদূরপ্রসারী চিন্তা না করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফলে শুরুর দিকে যাত্রীদের বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে যেসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এখনো জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন সনদ বা পাসপোর্ট নেই তাদের জন্য বিকল্প পন্থা বের করা উচিত ছিল। এখনো অনলাইনে টিকিট পদ্ধতিতে সব যাত্রী অভ্যস্ত হতে পারেনি। ঈদে ঘরমুখো মানুষ যেন ঠিকমতো রেলসেবা গ্রহণ করতে পারেন, সেদিকেও নজর রাখা হয়নি।

ট্রেনের টিকিট অনলাইনভিত্তিক করায় সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছেন এ ব্যাপারে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপ-প্রধান তথ্য কর্মকর্তা মো. শরিফুল আলম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, এবার ঈদুল ফিতরে যাত্রীদের ভোগান্তি ও কালোবাজারি বন্ধে ট্রেনের টিকিট অনলাইনে করা হয়েছে। তবে আজকের পরে আগের নিয়মেই স্টেশন ও অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কাটতে পারবেন যাত্রীরা।

ঈদুল ফিতরে ট্রেন যাত্রায় টিকিটে কালোবাজারি ও সিন্ডিকেট ঠেকাতে টিকিটের সিস্টেম শতভাগ অনলাইনভিত্তিক করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ফলে একশ্রেণির মানুষের মাঝে স্বস্তি দেখা গেলেও নিম্নআয়ের মানুষের মাথায় খরচের বোঝা বাড়ছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর থেকে ঘরমুখো নিম্নআয়ের মানুষের যাত্রায় নিরানন্দের সুর ধ্বনিত হয়। কারণ নিম্নআয়ের অনেকের কাছে স্মার্টফোন নেই, কোনো কম্পিউটারের দোকানে টিকিট কাটতে গেলেও বাড়তি টাকা গুনতে হয়।

এ বিষয়ে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুদ সারওয়ার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ট্রেনের টিকিট শতভাগ অনলাইনভিত্তিক করা হয়েছে। এখানে কারা নিম্ন-মধ্য ও উচ্চবিত্ত সেটি দেখার সুযোগ নেই। অনলাইনে টিকিটপ্রাপ্তি সবার জন্য সমান।

তিনি আরও বলেন, নিম্নআয়ের যেসব মানুষ অনলাইনে টিকিট কাটতে পারেনি, তাদের জন্য লোকাল ট্রেন আছে। লোকাল ট্রেন ছাড়ার আগেই স্টেশন থেকে টিকিট কাটতে পারবেন যাত্রীরা।

জানা গেছে, ঈদ যাত্রায় ট্রেনের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি ভাড়া নেয় বাসগুলো। দূরপাল্লার বাসে ৯০০ টাকা ভাড়া। একই দূরত্বে ট্রেনের ভাড়া সাড়ে ৪০০ টাকা। একই অবস্থা রাজশাহী, রংপুর ও সিলেটসহ বিভিন্ন এলাকার বাসের ভাড়া। বাসের চেয়ে ট্রেনের ভাড়া কম এবং যানজটমুক্ত হওয়ায় অধিকাংশ মানুষ ট্রেনে চলাচল বেশি পছন্দ করে। কিন্তু ট্রেনের টিকিট অনলাইভিত্তিক করায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

সারা দেশে ঈদ যাত্রায় নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষের কাছে যানজটমুক্ত ও নিরাপদ বাহন হিসেবে পছন্দের তালিকায় রয়েছে ট্রেন। তবে গত কয়েক বছর ট্রেনের টিকিট পেতে কমলাপুরসহ বিভিন্ন রেলস্টেশনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়েছিল টিকিট প্রত্যাশীদের। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে মানুষকে। তবে এবার লাইনে দাঁড়িয়ে ভোগান্তিতে পড়তে না হলেও অনলাইন ভোগান্তিতে পড়েন টিকিট প্রত্যাশীরা।

নীলফামারীর মানিক মিয়া গত পাঁচ বছর ধরে কমলাপুর রেলস্টেশনের আশপাশেই রিকশা চালান। তিনি এর আগে কমলাপুর স্টেশনে লাইনে দাঁড়িয়ে ঈদের টিকিট কেটেছেন, এবার অনলাইনে টিকিট কাটতে গিয়ে বিড়ম্বনার পড়েন মানিক মিয়া।

লালমনিরহাট থেকে রিকশা চালাতে রাজধানীতে আসেন আক্তার হোসেন। তিনি বলেন, টিকিট পেতে অনলাইনে কোথায়? কীভাবে? দরখাস্ত করতে হয় তা জানি না। ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি লাগবে, বিভিন্ন ঝামেলা। আমরা তো লেখাপড়া জানি না। আরেকজন বলেন, যারা সাধারণ মানুষ, প্রত্যন্ত অঞ্চলের তাদের কাছে অনলাইনে রেলের টিকিটপ্রাপ্তি কঠিন। অনলাইন টিকিট পদ্ধতি চালু করায় আমরা যারা নিম্নআয়ের মানুষ অনলাইনে টিকিট কাটতে পারব না, তাদের বাধ্য হয়েই বেশি ভাড়া দিয়ে বাসে চড়ে গ্রামে যেতে হবে। সিন্ডিকেট দূর করতে গিয়ে, এখন গরিবের ঈদযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক যাত্রী লিখেছেন, সার্ভার জটিলতায় অনেকে রেলসেবা অ্যাপে প্রবেশ করতে পারেননি। অনেকে অ্যাপে প্রবেশ করতে পারলেও টিকিট বুকিং অপশনে ক্লিক করার পর দীর্ঘক্ষণ আটকে থেকেছে। পরবর্তী ধাপে সিলেক্ট হলেও টিকিট সংগ্রহ করা যায়নি। সার্ভার জটিলতার কথা স্বীকার করে সহজ ডটকমের ভাইস প্রেসিডেন্ট জুবায়ের আহমেদ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ঈদের সময়ে সার্ভারে লোড পড়ে। তবে সার্ভার ডাউন হয়নি, স্লো হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত