ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিএসএমএমইউ’র ট্রেজারার ডা. আতিকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ

অস্থায়ী মেডিক্যাল অফিসার থেকে পূর্ণাঙ্গ অধ্যাপক
বিএসএমএমইউ’র ট্রেজারার ডা. আতিকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) অতিরিক্ত বয়সের কারণে প্রায় ২৪ বছর আগে ৩১ বছর ১ মাস ১৯ দিন বয়সে ২ বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার এবং বক্ষব্যাধি বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু মেডিক্যাল অফিসার থেকে পরবর্তীতে অনিয়মের মাধ্যমে নিজের চাকরি স্থায়ীকরণসহ জালিয়াতির মাধ্যমে একাধিক পদোন্নতির অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। পাশাপাশি রয়েছে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও।

এসব বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ হয়েছে। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বাংলাদেশ ও আমেরিকার দ্বৈত নাগরিক। তার সন্তানরা সবাই আমেরিকায় থাকেন। ডা. আতিক মেডিক্যাল অফিসার থেকে নিজ বেতনে সহকারী অধ্যাপক এবং পরবর্তীতে সহযোগী এবং সর্বশেষ অধ্যাপক হওয়ার ক্ষেত্রে একাধিক অনিয়ম করেছেন। এমনকি নিজের চাকরি স্থায়ীকরণে নিয়েছেন জালিয়াতির আশ্রয়। পাশাপাশি ডাক্তার হয়েও তিনি প্রভাব খাটিয়ে পূর্ত কমিটির সভাপতি ও দুই মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ (ট্রেজারার) হিসাবে দায়িত্ব পালনের সুবাধে অর্থ লোপাটের অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগের বিস্তারিত তথ্যাদি দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের নিকট সংরক্ষিত আছে।

এদিকে অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে দুদকের প্রাপ্তি শাখাও। দুদকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দুদকে অভিযোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এখনো ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়নি। তবে একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি তদন্তের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে সহসাই কমিটি গঠন করা হবে।

অভিযোগ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান ১৯৯৯ সালের ৪ জুলাই ৩১ বছর ১ মাস ১৯ দিন বয়সে ২ বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত হন। স্মারক নং বিএসএমএমইউ-৯৯/২৩২৭ মোতাবেক অতিরিক্ত বয়সের কারণে তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। তখন থেকে ছিলেন মেডিক্যাল অফিসার। সেখান থেকে সবেতনে সহকারী অধ্যাপক হন। পরে অতিরিক্ত রেজিস্ট্রারের চিঠিতে পদোন্নতি পেয়ে হয়ে যান নিয়মিত সহকারী অধ্যাপক। সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়মিত হওয়ার ৯ মাস ২৫ দিন পর আগের রেজিস্ট্রারের এক চিঠিতে সহযোগী অধ্যাপক পদেও পদোন্নতি পান। সর্বশেষ পদোন্নতির পর তিনি বর্তমানে অধ্যাপক এবং বক্ষব্যাধি বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

এদিকে অভিযোগ উঠেছে তার সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতিতে মানা হয়নি কোনো নিয়ম। হয়নি সিন্ডিকেট সভাও। বিএসএমএমইউ’র সিনিয়র শিক্ষকরা বলেছেন, তিনি জালিয়াতির মাধ্যমে সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক হলে তার বর্তমানের অধ্যাপক পদটিও অবৈধ। সহকারী অধ্যাপক পদে স্থায়ী না হয়েই মেডিক্যাল অফিসার থেকে তিনি কীভাবে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি নিলেন, সেই প্রশ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকের।

নিয়ম বহির্ভূতভাবে চাকরি স্থায়ীকরণ : অভিযোগ উঠেছে বর্তমানে গ্রেড-২ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান ১৯৯৯ সালের ৪ জুলাই ৩১ বছর ১ মাস ১৯ দিন বয়সে ২ বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত হন। স্মারক নং বিএসএমএমইউ-৯৯/২৩২৭ মোতাবেক অতিরিক্ত বয়সের কারণে তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। গত ৩০-০৮-২০০০ তারিখে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের দশম সভার ৯ (ঘ) ধারা মোতাবেক ‘কোর্সে থাকা ও চুক্তিভিত্তিক রেসিডেন্টদের নিয়মিত করা হবে না’। এবং ৩০-০৬-২০০২ তারিখে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ১২তম সভায় ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমানকে নিয়মিত না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। উপাচার্য তার নেয়া অতিরিক্ত বেতন ফেরত নিয়ে চাকরি স্থায়ীকরণের বিষয়টি সিন্ডিকেটে উপস্থাপনের নির্দেশ দেন। কিন্তু ০৪-০৫-২০০৩ তারিখে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ১৪তম সভায় ডা. আতিকের বিষয়ে আলোচ্য সূচি সুকৌশলে বাদ দেয়া হয়। কিন্তু সব বিধি ভঙ্গ করে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত প্রশাসন কোনো এক অদৃশ্য ক্ষমতাবলে তাকে নিয়মিত (স্থায়ী) করে।

পদোন্নতির ক্ষেত্রে জালিয়াতি : বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, নিয়মিত শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে হলে বহুল প্রচলিত পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞাপ্তি প্রকাশিত হওয়ার পর নিয়োগ নির্বাচনি বোর্ডের সুপারিশ সিন্ডিকেট কর্তৃক অনুমোদিত হতে হয় এবং সিন্ডিকেটের অনুমোদনের তারিখ থেকে এ নিয়োগ কার্যকর হয়। কিন্তু তার সহকারী অধ্যাপক নিয়োগে পত্রিকায় কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি হয়নি এবং কোনো নিয়োগ বোর্ডও হয়নি এবং এ নিয়োগে সিন্ডিকেটের কোনো অনুমোদন নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের পদোন্নতি ও নিয়োগ বিধির ৫(খ) ধারা অনুযায়ী ‘শিক্ষক-কর্মকর্তার ক্ষেত্রে সংবিধি দ্বারা গঠিত নির্বাচনি বোর্ডের সুপারিশক্রমে নিয়োগের ক্ষমতা সিন্ডিকেটের উপর ন্যস্ত থাকবে এবং সিন্ডিকেট অধিবেশনের তারিখ থেকে এ নিয়োগ কার্যকর হবে।

কিন্তু গত ০১-০১-২০০৪ তারিখ থেকে তাকে সবেতনে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয়। অপরদিকে তিনি সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়মিত হন ২৫-০৯-২০০৮ তারিখে। স্মারক নং- বিএসএমএমইউ ২০০৮/৮০৩০। এবং যোগদান করেন ০৭-১০-২০০৮, স্মারক নং-বিএসএমএমইউ ২০০৮/৮২৮১(৬)।

ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমানের নিয়মিত সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পত্রটি (স্মারক নং-২০০৮/৮০৩০, তাং ২৫-০৯-২০০৮) এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে স্বাক্ষর করেন অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার কাজী এবাদুল্লাহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির শর্তাবলী-সংবিধির ৫ (ছ) ধারা অনুযায়ী ‘সকল শিক্ষক/কর্মকর্তা/কর্মচারীর নিয়োগপত্র/চুক্তি (সিন্ডিকেট কর্তৃক অনুমোদিত) রেজিস্ট্রার কতৃক স্বাক্ষরিত হইবে’। এই নিয়োগপত্রে তাকে ০১/০১/২০০৪ থেকে নিয়মিত করা হয়েছে। উক্ত ০১-০১-২০০৪ তারিখে কোনো সিন্ডিকেট মিটিং অনুষ্ঠিত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় ও চাকরি বিধি অনুযায়ী ভূতাপেক্ষ নিয়োগ/পদোন্নতির সুযোগ নেই।

আবার ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান সহযোগী অধ্যাপক (পি পি) হন ০১-০১-২০০৮ তারিখে। সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়মিত না হয়েই সহযোগী অধ্যাপকের পদোন্নতি বাগিয়ে নেন এমন অভিযোগও উঠেছে। আইন অনুযায়ী এটা কখনোই হতে পারে না বলছেন সংশ্লিষ্টরা। মেডিক্যাল অফিসার (সবেতনে সহকারী অধ্যাপক বা মেডিকেল অফিসার) থেকে সরাসরি সহযোগী অধ্যাপক! অথচ সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়মিত হওয়ার পর নির্দিষ্ট মেয়াদে (সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়মিত পদে ৩ বছর ও পিপি এর জন্য ৪ বছর) চাকরি করার পর সহযোগী অধ্যাপকের জন্য বিবেচিত হওয়ার কথা। কিন্তু ০১-০১-২০০৮ তারিখেও সিন্ডিকেটের কোনো মিটিং অনুষ্ঠিত হয়নি।

২৬-০৬-২০০৮ তারিখে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ২৮তম সভার আলোচ্যসূচি-৫ এর সিদ্ধান্ত-৫ অনুযায়ী ‘ব্যক্তিগত পদোন্নতির ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পদোন্নতির সময়কালকে অভিজ্ঞতা হিসেবে গণনা করা হবে।’ এটি সাধারণত অধ্যাপক হওয়ার জন্য প্রযোজ্য। এখানেও ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির কোনো উল্লেখ নেই।

বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী, সবেতনে সহকারী অধ্যাপক মানে মেডিক্যাল অফিসার সমমান এবং সবেতনে সহকারী অধ্যাপকের মেয়াদকাল কখনোই সহযোগী অধ্যাপক হওয়ার জন্য শিক্ষকতার সময় হিসাবে বিবেচিত হবে না। শুধুমাত্র নিয়মিত সহকারী অধ্যাপকের মেয়াদকালই সহযোগী অধ্যাপকের পদোন্নতিতে বিবেচনায় আনা হয়। এভাবে তিনি বিধি বহির্ভূতভাবে, ০১-১-২০০৪ ও ০১-০১-২০০৮ সিন্ডিকেটের অনুমোদন ছাড়াই সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতিতে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।

বিএনপি-জামায়াত সমর্থক ড্যাবের সদস্য : অভিযোগ রয়েছে ডা. আতিক ২০০২ সালে ড্যাবের (ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশান অব বাংলাদেশ) আজীবন সদস্য হন। যখন আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকরা চাকরিচ্যুৎ হয় ও তাদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা হয় তখন ডা. আতিকের প্রোমোশন হয়। ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ সূত্রেও এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, আমিও এমন অভিযোগ জানতে পারেছি। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো পদক্ষেপ বা উদ্যোগ নিয়েছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ভিসি বলেন, এখনো কোনো পদক্ষেপ নেইনি। তবে উদ্যোগ নেব বলে ভাবছি।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহৃত নাম্বারে ফোন দিলে বন্ধ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, তিনি দেশের বাইরে (আমেরিকা) আছেন। তবে প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের হোয়াটসঅ্যাপ মাধ্যমে দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের পরিচয় দিয়ে অভিযোগ সম্পর্কে খুদে বার্তা দিলে পরে তিনি কল করে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।

ডা. আতিক তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বলেন, তার বিরুদ্ধে কেউ ষড়যন্ত্র করছেন। এসব মিথ্যা ও বানোয়াট। তিনি যথাযথ নিয়মে চাকরি স্থায়ীকরণ এবং পদোন্নতি পেয়েছেন। একই নিয়মে বর্তমান ভিসিসহ অনেক সিনিয়র অধ্যাপক স্থায়ী হয়ে পদোন্নতি পেয়েছেন। ২৮নং সিন্ডিকেট সভায় প্রমোশন দিয়ে রেগুলার করা হয় বলেও দাবি করেন তিনি।

ডা. আতিক দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়ে অস্বীকার করে আরো বলেন, আমার ভাই-বোন এবং পরিবারের সদস্যরা আমেরিকায় থাকেন। এজন্য আসা যাওয়া আছে। কিন্তু আমি দ্বৈত নাগরিক নই।

বিএনপিপন্থি সংগঠন ড্যাবের সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন- ঢাকা মেডিক্যালে অধ্যয়ন শেষে ইন্টার্নি অবস্থায় আওয়ামীপন্থি চিকিৎসক সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সহ-সভাপতি ছিলাম। ১৯৯৯ সালে বিএসএমএমইউতে নিয়োগ পেয়ে স্বাচিপের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত