তত্ত্বাবধায়কের দাবি আদায়ে এখনো আশাবাদী বিএনপি

শিগগিরই চলমান যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ ঘোষণা

প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  রকীবুল হক

বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটিয়ে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে বিএনপি ও সমমনা বিভিন্ন দল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ বিএনপির এ দাবির সঙ্গে একমত এবং তারা একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারকে চাপ দেবে বলেও দলটির অনেকে মনে করেন।

তবে নির্বাচনের আর মাত্র ৮ মাসের কম সময় বাকি থাকলেও এখনো পর্যন্ত বিএনপির এ দাবি সরকার আমলে নেয়াতো দূরের কথা, তত্ত্বাবধায়ের দাবি নিয়ে বিএনপির সঙ্গে সরকারের আলোচনার কোনো ইচ্ছা নেই বলে আভাস দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভয়েস অব আমেরিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ওদের (বিএনপির) সাথে আর বসতে ইচ্ছা করে না... মনে হয়, ওদের সাথে বসলে যেন সেই পোড়া মানুষগুলোর পোড়া গন্ধটা আমি পাই।’

বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে হবে- বিএনপি ও তার মিত্রদের এই দাবি নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন কি না, সে ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথা বলেন।

অন্যদিকে বাংলাদেশের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে না বলে জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী। বাংলাদেশ দ্রুতই একটি জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এই পরিস্থিতিকে কীভাবে দেখছে, যেখানে একটি দল নির্বাচনে অংশ নিতে চাইছে না। অথচ পরবর্তীতে বলতে পারে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়নি- বাংলাদেশি একটি গণমাধ্যমের ওয়াশিংটন প্রতিনিধির এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র দপ্তরের উপপ্রধান মুখপাত্র বলেন, ‘বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়; যেখানে বাংলাদেশি জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করবে না।’

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক এসব মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির দাবি আদায় বাস্তবে কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে নতুন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

যদিও এসব মন্তব্যকে স্বাভাবিক হিসেবে আখ্যায়িত করে চলমান আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়কের দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করা হবে বলে এখনো আশার কথা জানিয়েছেন বিএনপি সংশ্লিষ্টরা। এরই অংশ হিসেবে আন্দোলনকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিতে এবং শরিকদের নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ ঘোষণার নানা প্রস্তুতি চলছে বলেও সংশ্লিষ্টরা উল্লেখ করেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বিএনপি একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। আর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সে ধরনের নির্বাচনের চিন্তা করা অলীক স্বপ্নের মতো বলে করে বিএনপি। সেজন্য একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করছে দলটি। এটা গণতান্ত্রিক সব দল এবং অধিকাংশ মানুষেরও দাবি। কিন্তু সরকার তাদের ইচ্ছামতো নির্বাচন করতে চাইছে। তারা সংবিধানের বাইরে যাবে না বলছে।

অথচ, এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে না থাকলেও তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং তারা পরে তা বাতিল করে দেয়। একইভাবে সংবিধানে বাকশাল ছিল না, আওয়ামী লীগ বাকশাল অন্তর্ভুক্ত করে, যা পরে বাতিল করা হয়। তাই এখনো সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। তিনি বলেন, বিএনপির দাবির সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশই একমত থাকতেই পারে। কিন্তু তাই বলে তারা বিএনপির সঙ্গে রাস্তায় নামবে- এই ধারণার কোনো সুযোগ নেই। তাই এদেশের নির্বাচনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে না বলে যে মন্তব্য করেছে, তা কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও ভাষারই অংশ। এদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা হস্তক্ষেপের কথা বলতে পারে না। তবে বিএনপির দাবির সঙ্গে এদেশের অধিকাংশ জনগণ এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বের সমর্থন আমাদের জন্য বিরাট শক্তি। আর এই শক্তি নিয়েই বিএনপি বর্তমান সরকারের পতন ও তত্ত্বাবধায়কের দাবি আদায়ের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এ দাবি আদায়ে যা যা করার দরকার, তাই করা হবে। এক্ষেত্রে কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তার দায় সরকারকেই নিতে হবে।

এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে সরকারের বর্তমান অবস্থান প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, সরকারের যদি সুবুদ্ধি হয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়ে একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করে, তাহলে তাদের জন্য ভালো। তিনি বলেন, এ সরকারের অন্য কোনো ওয়ে আউট থাকবে না। সুস্থ হয়ে আউটের জন্য সরকার এখনো পারে একটি উদ্যোগ নিয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষিত অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা, না হলে বাঁচার পথ নেই। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। রিজভী বলেন, ভেতরে ভেতরে সরকার আত্মশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। এখন তাদের বিদায়ঘণ্টা বেজে গেছে। এই সরকার বিভিন্নভাবে ডিজিটাল আইন দিয়ে ভয়ের রাজ্য তৈরি করেছে। কিন্তু সেই আইনের মাধ্যমে তারা নিজেরাই পরাজিত হচ্ছে এটি তারা টের পাচ্ছে না। হয়তো টের পাচ্ছে, কিন্তু বলছে না। ভেতরে ভেতরে তারা আত্মশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ভেতরে ভেতরে শেখ হাসিনা পরাজিত হয়ে গেছে। আমরাই বিজয়ী।

‘নির্বাচন নিয়ে সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই’- আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এ প্রশ্নের জবাবে রিজভী বলেন, আপনারা (সাংবাদিক) তাদের প্রশ্ন করতে পারতেন সুযোগ নেই কেন? এটি কি আটলান্টিক মহাসাগর যে নৌকা ছাড়া পার হওয়া যাবে না। সংবিধানের মধ্যেই সংবিধান সংশোধনের সুযোগ রয়েছে। ওরা গায়ের জোরে কথা বলছে। এটি কোনো রাজনৈতিক পরিভাষা হতে পারে না। তাহলে ১৯৯৫-৯৬ সালে হল কেমন করে?

এদিকে ‘সরকার হটানোর যুগপৎ আন্দোলনে’ করণীয় ঠিক করতে বিএনপি ও শরিকদের লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকের ধারাবাহিকতায় গতকাল গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ২ ঘণ্টার বৈঠক শেষে এক সংবাদ ব্রিফিংএ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বৈঠকে চলমান আন্দোলন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যুগপৎ আন্দোলন অব্যাহতভাবে চলছে; সেটা আপনারা দেখতে পারছেন এবং এই আন্দোলনকে আরো শক্তিশালীভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য যেসব কর্মসূচি নেয়া প্রয়োজন, আমরা সেগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। তিনি বলেন, ‘আমরা সকলে মিলে একটা জয়েন্ট স্টেটমেন্ট (যৌথ ঘোষণা) করব এ ব্যাপারেও আমরা সিদ্ধান্ত দিয়েছি। গণতন্ত্র মঞ্চসহ অন্যান্য যতগুলো দল ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের সাথে যুগপৎ আন্দোলনে আছে, সকলে মিলে আমরা একটি যৌথ ঘোষণা দেব জাতির সামনে। এটা খুব তাড়াতাড়ি হবে।

এ সময় গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম বলেন, অতীতে যেভাবে আন্দোলনে সরকার পরিবর্তন হয়েছে বাংলাদেশে, বর্তমানের আন্দোলন এর চাইতে আলাদা। আমরা কেবলমাত্র সরকার পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন করছি না, আমরা এই সরকার বদল এবং এই যে স্বৈরতান্ত্রিক সরকারগুলো ক্ষমতাসীন হয়, তাদের কাঠামো বদলের জন্য আমরা রাষ্ট্রের সংস্কার কিংবা মেরামতের জন্য সরকার পরিবর্তনে আমরা কাজ করছি। এই লক্ষ্যে আমরা অল্পদিনের মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ, বিএনপিসহ অপরাপর বাংলাদেশকে নিয়ে যারা ভাবেন, বাংলাদেশের জনগণকে নিয়ে যারা ভাবেন তাদের সবাইকে সাথে নিয়ে আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে; সেটার রূপরেখা খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমরা আপনাদের সামনে যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে তুলে ধরব, সেই বিষয়ে আমাদের মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে।