মে দিবস পালিত

জাতি স্মরণ করল শ্রমজীবীদের

প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশে যথাযথ মর্যাদায় দিবসটি পালন করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা দিবসটি উপলক্ষ্যে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অর্থাৎ, প্রত্যেক বছরের মতো এবারও জাতি স্মরণ করল শ্রমিকদের। তাদের সম্মানে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে রক্তরাঙা পতাকা হাতে নিয়ে ১৩৭তম মে দিবস পালন করলেন শ্রমিকরা। এ বছর মে দিবসের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি।’

দিবসটি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে কর্মসূচি গ্রহণ করে। কর্মসূচির মধ্যে শ্রমিক সমাবেশ, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল। এছাড়া মহান মে দিবস উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দেন।

জানা গেছে, উনিশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত শ্রমিকদের কোনো মজুরির নিশ্চয়তা ছিল না। শ্রমিকের কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়নি। কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের মালিকরা তাদের খেয়ালখুশি মতো শ্রমিকদের দৈনিক প্রায় ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত খাটাতেন। শ্রমিকরা যুগের পর যুগ মালিকদের অন্যায় মুখ বুঝে ছিলেন। তবে ১৮৭৭ সালে ন্যায্য মজুরি, কর্ম ঘণ্টা ও অন্যান্য দাবি আদায়ের শ্রমিকরা ব্যাপক ধর্মঘট পালন করেছিলেন। এই ন্যায্য আন্দোলনের বিরুদ্ধে পুলিশ লেলিয়ে দেয়া হয়। গুলিতে ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত ৩০০ শ্রমিক আহত হন। এতে পিছু হটেননি শ্রমিকরা। বরং মালিক ও পুলিশের অত্যাচারে বিরুদ্ধে শ্রমিকদের আন্দোলন-সংগ্রাম আরো বেগ পায়, যা ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে ‘হে মার্কেট’ শ্রমজীবী মানুষ নিপীড়নের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছিলেন দুর্বার আন্দোলন। সেদিন যুক্তরাষ্ট্রে সব শিল্পকারখানার কাজ বন্ধ রেখে ৩ লক্ষাধিক শ্রমিক সংগ্রামের লাল ঝান্ডা হাতে নিয়ে রাস্তায় নামে। বিনা উসকানিতে নির্বিচার পুলিশ গুলি চালালে ওই দিনই নিহত হন ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক, আহত হন হাজার হাজার শ্রমিক। এ ঘটনার ২ বছর পর ১৮৮৯ সালে প্যারিসে ফরাসি বিপ্লবের ১০০ বছর পূর্তিতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেসে শিকাগো শ্রমিক আন্দোলনের দিনটিকে ১৮৯০ সাল থেকে পালনের প্রস্তাবনা দেয়া হয়। পরের বছর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কংগ্রেস প্রস্তাবনাটি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। পরে ১৯০৪ সালে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবি আদায় এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যাপী মে মাসের প্রথম দিন মিছিল ও শোভাযাত্রার আয়োজন করতে সব সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল ও শ্রমিক সংঘের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এ আহ্বানের সাড়া হিসেবে বিশ্বের প্রায় সব শ্রমিক সংগঠন ১ মে বাধ্যতামূলক কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক দেশের শ্রমিকরা মে মাসের ১ তারিখ সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালনের দাবি জানান। বিভিন্ন দেশে মে দিবস সরকারিভাবে ছুটির দিন হিসেবে পালিত হতে থাকে। ধীরে ধীরে রাশিয়া, চীন, বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এ দিনটির তাৎপর্য ছড়িয়ে পড়ে।

শ্রমিকদের অধিকার ও দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মে দিবস পালিত হয়। স্বাধীনতার পর মে দিবস রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে মহান মে দিবস উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে মে দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর থেকে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয় মে দিবস।

গত সোমবার রাজধানীর ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে জাতীয় শ্রমিক লীগের আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শ্রমিক নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, মে দিবসে শ্রমিক লীগ ঐক্যবদ্ধ। এই ঐক্যে যেন চিড় না ধরে। এই ঐক্য আরো দৃঢ় করতে হবে।

অন্যদিকে দিবসটি উপলক্ষ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সভ্যতার প্রধান কারিগর শ্রমজীবী মানুষেরা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত। তারা ন্যায্য মজুরি পাচ্ছে না। দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে এই মানুষগুলো দিশাহারা। তারা অমানবিক জীবন কাটাচ্ছে। রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে অস্থায়ী মঞ্চে শ্রমিক সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন। মহান শ্রমিক দিবস উপলক্ষ্যে গত সোমবার এই সমাবেশের আয়োজন করে শ্রমিক দল।

জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এমপি বলেন, শ্রমিক-মালিক সম্প্রীতি স্মার্ট বাংলাদেশের ভিত রচনা করতে পারে। শ্রমিকদের বঞ্চিত করে উন্নয়ন সম্ভব নয়। শ্রমিকরা উন্নয়নের প্রাণ। পোশাক শিল্পের পাশাপাশি ওষুধ শিল্প, নির্মাণ শিল্প, চা উৎপাদন ইত্যাদি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার মাধ্যমে শ্রমিকরা জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে। শ্রমিক-মালিক সম্প্রীতি স্মার্ট বাংলাদেশের ভিত রচনা করতে পারে।

গত সোমবার রাজধানীর পল্টনে সমাবেশ ও লাল পতাকা মিছিল করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। সমাবেশে বক্তারা বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার এবং বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রীয় মালিকানার নীতিতে দেশ পরিচালনার কথা থাকলেও সরকার উল্টো পথে চলছে। লুটেরা পুঁজিপতিরা বারবার রাষ্ট্র ক্ষমতা ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় কলকারখানাকে বন্ধ করছে। ব্যক্তি মালিকানার নামে অনেক ক্ষেত্রে শ্রমজীবী মানুষের ওপর শোষণের মাত্রা বৃদ্ধি করে লুটপাটের নতুন ধারা তৈরি করার হচ্ছে। শ্রমিকদের জীবনে চরম সংকট সৃষ্টি করে নব্য ধনিক গোষ্ঠীকে আরো ধনি করে শোষণ বৈষম্য বৃদ্ধি করছে। সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক এএন রাশেদার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য দেন পার্টির অন্যতম উপদেষ্টা শ্রমিক নেতা মন্জুরুল আহসান খান, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, সাবেক সভাপতি, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম প্রমুখ।

মে দিবসে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। তবে দুই দেশের মধ্যে পাসপোর্টধারী যাত্রী যাতায়াত স্বাভাবিক ছিল। বেনাপোল স্থলবন্দরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আব্দুল জলিল জানান, মে দিবসে সরকারি ছুটি থাকায় বেনাপোল-পেট্রোপোল বন্দরের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। বন্ধের মধ্যে বন্দরে যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সেজন্য বন্দরের নিরাপত্তা জোরদার করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বন্দর সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে প্রায় ৫০০ ট্রাক বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করা হয়ে থাকে। ভারতে রপ্তানি হয় ২০০ ট্রাক পণ্য। আমদানি বাণিজ্য থেকে প্রতিদিন সরকারের রাজস্ব আসে প্রায় ৪০ কোটি টাকা।