এসএসসিতে অনুপস্থিতির পেছনে প্রধান ৩ কারণ

প্রকাশ : ০৫ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  রকীবুল হক

গত দুই বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্ট মহল। নির্ধারিত ফি দিয়ে ফরম পূরণের পরও শিক্ষাজীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রথম এ পাবলিক পরীক্ষায় অনুপস্থিতির কারণ জানার কৌতূহল রয়েছে অনেকের। এ বিষয়ে সরকারিভাবে তেমন কোনো গবেষণা না থাকলেও পরীক্ষার্থীদের অনাকাঙ্ক্ষিত বিভিন্ন সমস্যার কারণেই মূলত প্রতি বছর এ পাবলিক পরীক্ষায় বেশ সংখ্যক শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকলেও সর্বশেষ তিন বছরে এ সংখ্যা অনেক বেড়েছে বলে জানা গেছে।

সূত্রমতে, করোনাকালের আগে ২০২০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অনুপস্থিতির সংখ্যা ছিল মাত্র ১২ হাজার ৯৩৭ জন। অথচ সম্প্রতি শুরু হওয়া ২০২৩ সালের এসএসসি ও সমমানের তিনটি পরীক্ষার মধ্যে দ্বিতীয় দিনে সর্বোচ্চ ৩২ হাজার ৩৫৬ জন পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। মূলত, দরিদ্রতা ও বাল্যবিয়ের পাশাপাশি করোনাকালীন পড়ালেখার ঘাটতির কারণে যথাযথ প্রস্তুতি না থাকায় এ ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে। তবে এ বিষয়ে গবেষণার মাধ্যমে সুস্পষ্ট কারণ বের করে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার এ পথ রোধের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণেরও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

সূত্রমতে, করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর আগ মুহূর্তে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই ২০২০ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। তবে ওই বছর প্রথম দিনের পরীক্ষায় ৯টি সাধারণ এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডের অধীনে এসএসসি, দাখিল ও এএসসি/কারিগরি ভোকেশনাল পরীক্ষায় ১৭ লাখ ৭৯ হাজার ৫৪০ জন শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের কথা থাকলেও উপস্থিত হয়েছিল ১৭ লাখ ৬৬ হাজার ৬০৩ জন। অর্থাৎ ১২ হাজার ৯৩৭ জন পরীক্ষায় সেদিন অনুপস্থিত ছিল।

এর পরের বছর ২০২১ সালে করোনাকালীন পরিস্থিতিতে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস, সময় ও বিষয়ে অনুষ্ঠিত এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার প্রথম দিনে ৯ লাখ ১২৯ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে উপস্থিত হয়েছিল ৮ লাখ ৮১ হাজার ৩০৯ জন। অর্থাৎ ১৮ হাজার ৮২০ জন পরীক্ষার্থী সেবার অনুপস্থিত ছিল। করোনাকালের আমেজে গত বছর তথা ২০২২ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার প্রথম দিন সবচেয়ে বেশি ৩৩ হাজার ৮৬০ জন অনুপস্থিত ছিল। এদিন মোট ১৯ লাখ ৩৯ হাজার ৭১ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে উপস্থিত ছিল ১৯ লাখ ৫ হাজার ২১১ জন।

আর গত ৩০ এপ্রিল শুরু হওয়া এবারের (২০২৩ সাল) পরীক্ষার প্রথম দিনে ৯টি সাধারণ এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মোট ১৮ লাখ ৯৩ হাজার ৫১৬ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে কেন্দ্রে উপস্থিত ছিল ১৮ লাখ ৬২ হাজার ৬৯ জন। অর্থাৎ ৩১ হাজার ৪৪৭ জন এ পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। একইভাবে ২ মে দ্বিতীয় দিনের পরীক্ষায় ১৮ লাখ ৯৩ হাজার ১৮ জনের মধ্যে পরীক্ষায় অংশ নেয় ১৮ লাখ ৬০ হাজার ৬৬২ জন। অর্থাৎ এদিন অনুপস্থিত ছিল ৩২ হাজার ৩৫৬ জন। এছাড়া ৩ মে তৃতীয় পরীক্ষার দিনেও ১১ বোর্ড মিলে ৩০ হাজার ১৮৪ জন অনুপস্থিত ছিল বলে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির দেয়া তথ্যে জানা গেছে।

সূত্রমতে, এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার দ্বিতীয় দিনে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে অনুপস্থিত ছিল ১৭ হাজার ৪২৭ জন এসএসসি পরীক্ষার্থী। এর মধ্যে ঢাকা বোর্ডের ৪ হাজার ৩৪২ জন, রাজশাহী বোর্ডের ১ হাজার ৮২০ জন, কুমিল্লা বোর্ডের ২ হাজার ৩৬৩ জন, যশোর বোর্ডের ১ হাজার ৯২০ জন, চট্টগ্রাম বোর্ডের ১ হাজার ৬১২ জন, সিলেট বোর্ডের ৯৭০ জন, বরিশাল বোর্ডের ১ হাজার ৫২ জন, দিনাজপুর বোর্ডের ২ হাজার ৩৬১ জন এবং ময়মনসিংহ বোর্ডের ৯৮৭ জন পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। অন্যদিকে মাদ্রাসা বোর্ডে ১১ হাজার ৬২৯ জন দাখিল পরীক্ষার্থী এবং কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের ৩ হাজার ৩০০ জন এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনাল পরীক্ষার্থী দ্বিতীয় দিনের পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। এদিন শতকরা হিসেবে মাদ্রাসা বোর্ডে সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ৫০, কারিগরিতে ২ দশমিক ৬২ এবং ৯টি বোর্ডে ১ দশমিক ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল।

এবারের পরীক্ষায় ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতির কারণ সম্পর্কে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. কামাল উদ্দিন গতকাল আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, পরীক্ষায় অনুপস্থিতির সুনির্দিষ্ট কারণ নিয়ে এখনও কোনো গবেষণা করা হয়নি। তবে আমার জানামতে, অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ দরিদ্রতা ও বাল্যবিয়ের কারণেই পরীক্ষায় অংশ নেয়নি।

তিনি বলেন, সারা দেশে একটি মাত্র মাদ্রাসা বোর্ড হওয়ায় এ বোর্ডের অনুপস্থিতির সংখ্যা বেশি মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে এ হার অন্য বোর্ডের মতোই। তাছাড়া অনুপস্থিতির কারণও সব বোর্ডের ক্ষেত্রে অনেকটা একই ধরনের। এক্ষেত্রে গবেষণার মাধ্যমে পরীক্ষায় অনুপস্থিতির প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান এবং শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করতে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলেও এই কর্মকর্তা মনে করেন।

অন্যদিকে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অনুপস্থিতির সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে করোনাকালীন লেখাপড়ার ঘাটতিকে প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন বিশিষ্ট শিক্ষা গবেষক, গণসাক্ষরতা অভিযানের ভাইস চেয়ারপারসন ও উপদেষ্টা ড. মনজুর আহমদ। গতকাল তিনি আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, এডুকেশন ওয়াচের এক স্টাডিতে দেখা গেছে. করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় অনেক ঘাটতি হয়েছে। এখন যারা এসএসসি দিচ্ছে তারা দুই ক্লাসে ঠিকমতো পড়তে পারেনি। এতে পড়ালেখায় তাদের অনেক ঘাটতি হয়েছে। তাদের অনেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ফি দিয়ে ফরম ফিলাপ করলেও ঠিকমতো প্রস্তুতি নিতে না পারায় শেষ পর্যন্ত অংশ নেয়নি।

তিনি বলেন, প্রতিবছর বিভিন্ন কারণ যেমন বাল্যবিয়ে ও অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে কাজে ঢুকে যাওয়ায় অনেকে পরীক্ষায় অংশ নেয় না। তবে এবার এসব সমস্যার সঙ্গে যোগ হয়েছে করোনাকালীন পড়ালেখার ঘাটতি। অবশ্য এ ঘাটতির কথা সরকার স্বীকার করতে চাচ্ছে না। তারা স্বাভাবিক রুটিনে ফিরতে চায়। ঘাটতি পূরণে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। পরীক্ষায় সিলেবাস কমানো হলেও শিক্ষার্থীরা পুরোপুরি প্রস্তুতি নিতে সক্ষম হয়নি।

অবশ্য এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অনুপস্থিতির পেছনে ভিন্ন কারণ দেখছেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃ শিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি তপন কুমার সরকার। তিনি বলেন, প্রতিবছরই দেখা যায়, ১ থেকে ২ শতাংশের মধ্যে পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকে। সুনির্দিষ্ট কারণ জানা না গেলেও অভিজ্ঞতা থেকে তার মনে হয়েছে মূলত, তিনটি কারণে এমনটি হয়ে থাকতে পারে। প্রথমত, কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে শিক্ষার্থীর নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করা থাকলেই এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফরম পূরণের সুযোগ করে দেয়। এটি গ্রামাঞ্চলে বেশি হয়। কিন্তু এসব শিক্ষার্থীর অনেকেই পরে পরীক্ষা দেয় না। আবার কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী আছে ফরম পূরণের পর দেখে পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালো হয়নি। তখন পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকে। কিছু শিক্ষার্থী অসুস্থতার কারণেও পরীক্ষা দেয় না।

সাধারণ নিয়মানুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্বাচনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদেরই এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার সুযোগ দেয়া হয়।

এদিকে পরীক্ষায় অনুপস্থিতির পাশাপাশি নবমে রেজিস্ট্রেশন করেও শেষ পর্যন্ত পরীক্ষার ফরম পূরণ করে না ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষার্থী। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, ২০২১-২২ সেশনে ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মোট ২৪ লাখ ৩৯ হাজার ৭৪৬ জন নিয়মিত শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফরম পূরণ করে ১৮ লাখ ৫৮ হাজার ৭৫৮ জন শিক্ষার্থী। এছাড়া অনিয়মিত ২ লাখ ১১ হাজার ৬৯৮ জন এবং মানোন্নয়নের জন্য এক হাজার ৭০৭ জনসহ এবার মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২০ লাখ ৭২ হাজার ১৬৩ জন।