রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ

রণক্ষেত্র পেরিয়ে প্রেসিডেন্ট ভবন

প্রকাশ : ০৫ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  শাহিনুর রহমান

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কেন যেন নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে। এতদিন ধরে রুশ সৈন্যরা ইউক্রেনের সৈন্যদের বিরুদ্ধে সে দেশের মাটিতেই লড়াই করে আসছে। রুশ সৈন্যদের হাতে ইউক্রেনের অনেক সৈন্য নিহত হয়েছে। আবার পাল্টা হামলার ঘটনায় কয়েক হাজার রুশ সৈন্য হতাহত হয়েছে বলেও দাবি করা হয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে লক্ষ্য করে রুশ সৈন্যদের হামলা চালানোর কোনো খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি রুশ হামলার লক্ষ্যবস্ত নয়- এটা মোটামুটি ধরে নিয়েছে সারা বিশ্ব। গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি মস্কো কিয়েভের বিরুদ্ধে তাদের ভাষায় সামরিক অভিযান শুরু করা বিশ্বের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয়েছে। ভেঙে পড়েছে অর্থনীতির লাইফলাইন। বিশ্ব মন্দার কবলে পড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিও নড়বড়ে হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণ্ণতায় বাংলাদেশ এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠার সক্ষমতা অর্জন করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন লড়াই রণক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ না থেকে বেসামরিক পর্যায়ে চলে আসলেও প্রেসিডেন্ট পর্যায়ে হত্যার চেষ্টার অভিযোগ এই প্রথম শোনা গেল।

প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সরকারি অফিস ক্রেমলিনে গত বুধবার ড্রোন দিয়ে হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি করেছে রাশিয়া। ক্রেমলিনের দাবি, প্রেসিডেন্ট পুতিনকে হত্যার উদ্দেশে ইউক্রেন দু’টি ড্রোন পাঠিয়েছে। তবে এসব দাবি অস্বীকার করেছে ইউক্রেন। ফিনল্যান্ড সফরে থাকা দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, ‘আমরা পুতিন বা মস্কোর ওপর হামলা চালাই না। আমরা আমাদের নিজ দেশে লড়াই করি। আমরা আমাদের নিজস্ব শহর গ্রাম রক্ষা করছি।’

আসলে কিয়েভ ড্রোন হামলা চালিয়েছে কি না সে ব্যাপারে আন্তর্জাাতিক অঙ্গনের কোনো গণমাধ্যম নিশ্চিত করতে পারেনি। কেবল পরস্পরের দাবির ওপর ভিত্তি করে রাশিয়া ও ইউক্রেন বক্তব্য দিচ্ছে। রাশিয়ার দাবি ইউক্রেন ড্রোন হামলা করেছে। আর ইউক্রেনের দাবি তারা এই ধরনের কোনো হামলা চালায়নি। তৃতীয় নয়নে বিশ্বের মানুষ কার কথা বিশ্বাস করবে। তবে রাশিয়া ইউক্রেনের ড্রোন হামলার ঘটনাকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে মস্কোর পক্ষ থেকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সরকারি বাসভবন লক্ষ্য করে হামলা চালানোর কথা জানানো হয়েছে। রণক্ষেত্র ছেড়ে এখন যদি প্রেসিডেন্ট ভবন হামলার লক্ষ্যবস্ত্র হয় তাহলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কোন দিকে মোড় নেবে তা নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন মিত্র দেশের সামরিক সহায়তা নিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধ চালাতে গিয়ে কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েছে। অন্যের ওপর নির্ভর করে কিয়েভ কতদিন মস্কোর আগ্রাসন মোকাবিলা করবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ড্রোন পাঠিয়ে পুতিনকে হত্যা করার সাহস ও মনোবল ইউক্রেন কোথায় পেল তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। প্রকৃত ঘটনা যাই হোক না কেন রাশিয়া ড্রোন হামলার অভিযোগ তুলে আগামী দিনগুলোতে কী ধরনের পাল্টা ব্যবস্থা নেয় তা দেখতে হয়তো অপেক্ষা করতে হবে। তবে ড্রোন হামলা চেষ্টার বিষয়টি নিয়ে রাশিয়ার ভেতর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ ‘জেলেনস্কিকে নিশ্চিহ্ন’ এবং পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ডুমার স্পিকার ভায়াচেসলাভ ভোলোদিন ইউক্রেনের বর্তমান সরকারকে ‘ধ্বংস’ করে দেয়ার কথা বলেছেন। এছাড়া জেলেনস্কির সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা করা যাবে না বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

এমন উত্তপ্তকর পরিস্থিতিতে রাশিয়া ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের দপ্তরে হামলার নির্দেশ দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পাভেল ফেলগেনহাওয়ার নামের এক সামরিক বিশেষজ্ঞ। তিনি সোভিয়েত একাডেমি অব সাইন্সেস-এর একজন সিনিয়র গবেষক ছিলেন। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে এ সামরিক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ‘রাশিয়া যে অভিযোগ করছে এটি যদি সত্যি হয়, তাহলে কেন ড্রোন ব্যবহার করে হামলার ঘটনা ঘটেছে সেটি খুঁজে বের করা কঠিন হবে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘রাতের বেলা, পুতিন ক্রেমলিনে থাকেন না, তিনি সেখানে কাজের জন্য যান, বসবাস করেন না।’ এ সামরিক বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, রুশ কর্মকর্তারা যে প্রতিশোধ নেয়ার কথা বলছেন, সেটি হতে পারে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভবনে হামলার জন্য নিজ সেনাদের নির্দেশ দিতে পারে রাশিয়া।

এর আগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় জানায়, ক্রেমলিনে রাতে দুটো ড্রোন দিয়ে হামলার চেষ্টা করা হয়েছে, তবে রুশ প্রতিরক্ষা বাহিনী সে রাতেই ড্রোন দুটো আকাশে ধ্বংস করে দিয়েছে। হামলার অভিযোগ করে রাশিয়া হুমকি দিয়েছে, সময় অনুযায়ী তারা এর উপযুক্ত জবাব দেবে।

বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ে তাতে দেখা যায়, ক্রেমলিনের আকাশে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলি উপরের দিকে উঠছে। যেখানে দেখা যায় একটি বস্তু মস্কোর কেন্দ্রস্থলে বড় একটি সরকারি কমপ্লেক্সের উপর উড়ছে এবং তারপরই বিস্ফোরণ ঘটে।

দ্বিতীয় একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ওই এলাকার সিনেট বিল্ডিংয়ে ছোট বিস্ফোরণ, সেখানে আগুনও জ্বলতে দেখা গেছে। সে সময় দুজন ব্যক্তিকে ওই ভবনের গম্বুজের দিকে উঠতেও দেখা যায়। ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, কয়েক মিনিটের ব্যবধানে দুটি ভিন্ন দিক থেকে দুটি ড্রোন এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ইউক্রেনের হামলার চেষ্টার ঘটনাকে ক্রেমলিন ‘পরিকল্পিত সন্ত্রাসী আক্রমণ এবং প্রেসিডেন্টকে হত্যার চেষ্টা’ হিসেবে দেখছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইলেকট্রনিক র‌্যাডার অ্যাসেট ব্যবহার করে ড্রোন দুটো নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। হামলার সময় পুতিন ক্রেমলিনে ছিলেন না ও হামলায় ভবনেরও কোনো ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছে মস্কো।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক যুদ্ধবিষয়ক পর্যবেক্ষক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ) জানিয়েছে, রুশ প্রেসিডেন্ট দপ্তরে ইউক্রেন ড্রোন হামলা চালাতে পারবে এ নিয়ে তাদের যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ কয়েকদিন আগে মস্কো ক্রেমলিনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও জোরদার করেছে। আর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কয়েক ধাপ পার হয়ে ক্রেমলিনের এত কাছে ড্রোন পৌঁছানো সম্ভব নয়। আইএসডব্লিউ আরও জানিয়েছে, ড্রোন ভূপাতিত করার খুব সুন্দর ছবি প্রকাশ করেছে রাশিয়া। এমন সময় সুন্দর ছবি তোলাটা অনেকটা অসম্ভব।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে বিশ্বের সবচেয়ে সুরক্ষিত নেতাদের একজন বলে মনে করা হয়। মস্কোতে পুতিনের সমাবেশে অত্যন্ত কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। ব্যাপক তল্লাশির পাশাপাশি আশপাশে রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ থাকে তখন।

এ কারণে ক্রেমলিনের দাবি সত্য হলে প্রেসিডেন্ট পুতিনের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন প্রশ্নের জন্ম দেবে। বিমান প্রতিরক্ষার কার্যকারিতা নিয়েও নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে রাশিয়াকে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মস্কোর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবনের ছাদে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন হতে দেখা গেছে। রাশিয়ার আশঙ্কা, বিমান হামলার শিকার হতে পারে মস্কো।

ক্রেমলিনে ড্রোন হামলার সঙ্গে ইউক্রেনের জড়িত থাকার অভিযোগ মানতে নারাজ ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, ইউক্রেন ভূখণ্ডে ব্যাপক হামলার বিষয়টিকে বৈধতা দিতে এমন গল্প ফাঁদছে মস্কো। আর যুক্তরাষ্ট্র বলছে, রাশিয়ার দাবিগুলোকে অনেকটা সতর্কতার সঙ্গে খতিয়ে দেখছে ওয়াশিংটন।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, রাশিয়ার অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত নন। বিষয়টি অবশ্যই যাচাই করা হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপ-সহকারী প্রতিরক্ষা সচিব এবং সিআইএ কর্মকর্তা মিক মুলরয় বলেছেন, যদি ঘটনা সত্য হয় তবুও সেখানে হত্যা প্রচেষ্টার কোন লক্ষ্য ছিল না। কারণ পুতিনের গতিবিধি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট। আর ঘটনার সময় পুতিন মস্কোতে ছিলেন না।

তিনি বলেন, ‘রাশিয়ান জনগণকে দেখানোর জন্য এটি হতে পারে। রুশ সরকার হয়তো জনগণকে এটা বিশ্বাস করাতে যায় যে ইউক্রেন যে কোনো স্থানে হামলা চালাতে পারে। মানে যুদ্ধের পক্ষে সাধারণ মানুষের সমর্থন পেতে চাইছে ক্রেমলিন’। মুলরয় আরও বলেন, ‘এমনও হতে পারে যে, রাশিয়া হয়তো প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে টার্গেট করার অজুহাত হিসেবে এ ঘটনাকে ব্যবহার করতে চাইতে পারে। আগেও তারা এমন চেষ্টা করেছে’। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মাইখাইলো পোডোলিয়াক বলেছেন, রাশিয়া ইউক্রেনে বড় পরিসরে সন্ত্রাসী উসকানির প্রস্তুতি নিচ্ছে। ক্রেমলিন লক্ষ্য করে ড্রোন হামলার এই ঘটনাটি তার ইঙ্গিত দেয়। এদিকে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভসহ বেশ কয়েকটি শহরে গতকাল ভোরের দিকে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এরপর শহরগুলোতে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর জাপোরিঝিয়া ওডেসার কৃষ্ণসাগর বন্দরে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে।