পানি সংকটে ফায়ার সার্ভিস

কোথায় গেল রাজধানীর এতগুলো জলাশয়

প্রকাশ : ০৭ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচএম ফারুক

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজধানীতে বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পানির অভাবে ধুঁকতে দেখা গেছে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। বনানী ও বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডে উপায় না পেয়ে বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার ব্যবহার করে হাতিরঝিল থেকে পানি আনতে দেখা গেছে। অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দূরদূরান্তের পুকুর থেকেও পানি নিয়ে আগুন নেভাতে ছুটে যেতে দেখা গেছে। রাজধানীতে যতবারই এমন বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটে, ততবারই আলোচনায় আসে আগুন নেভানোর জন্য পানির উৎস নিয়ে। তবে তারপর সব আলোচনা থেমেও যায়। বিভিন্ন আইন ও নীতিতে পরিবেশবান্ধব নগরীতে পুকুর, জলাধার কী পরিমাণে থাকতে হবে, করণীয় কী, তার নির্দেশনা দেয়া আছে। তবুও পুকুর ও জলাধার ভরাটের মহোৎসব চলছেই। ৪০০ বছরের পুরনো এই শহরে কয়েক হাজার পুকুর ও জলাশয় ছিল। কিন্তু দায়িত্বশীলদের ব্যর্থতা, অযোগ্যতা, দুর্নীতি, প্রভাবশালীদের খাল-বিল-নালা দখলে হারিয়ে যেতে বসেছে সেসব পানির উৎস। গুলশান লেক, ধানমণ্ডি লেক, হাতির ঝিল, রমনা লেক, সংসদ এলাকায় লেখ থাকলেও আড়াই কোটি জনবসতির রাজধানী ঢাকায় সে লেক ও পানির উৎস থাকার কথা তার সিকি ভাগও নেই। বিভিন্ন জরিপ থেকে দেখা যায় দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় খালের সংখ্যা ৪৭। আবার রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা শহরে ৫৬টি খাল। এর মধ্যে দখল হয়ে গেছে ২৬টি। ফলে ইরামতের মহানগরী ঢাকায় খাল-বিল-পুকুর-নালায় পর্যাপ্ত পানি না থাকায় কোথাও অগ্নিকাণ্ড ঘটলে পানির অভাবে আগুন নেভানো যায় না। তার সবশেষ উদাহরণ বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেট। বড় কোনো বিল্ডিং নয়, দোতালা মার্কেট চোখের সামনে আগুনে পুড়ে গেলেও পানির অভাবে সময়মতো আগুন নেভানো যায়নি। এতে করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পথে বসেছে কয়েক হাজার ব্যবসায়ী।

এদিকে সেগুনবাগিচা খাল, নারিন্দা খাল, ধোলাইখাল, গোপীবাগ খাল, সূত্রাপুর খালসহ বিভিন্ন খাল ভরাট হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। খালের পাশাপাশি দখলে-ভরাটে হারিয়ে গেছে রাজধানীর পুকুর। একাধিক সূত্রের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ১৯৮৫ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মাত্র ৩৮ বছরের ব্যবধানে ২ হাজার পুকুর ভরাট হতে হতে এখন ২৯টিতে দাঁড়িয়েছে।

৪ মে ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে বর্তমানে রাজধানীতে পুকুরের সংখ্যা মাত্র ২৯ টি। আর মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় পুকুরের সংখ্যা ছিল প্রায় ২ হাজার। দ্রুত নগরায়নের ফলে মাত্র ৪ বছর পর ১৯৮৯ সালের দিকে সেটা কমে ১ হাজার ২০০তে নেমে আসে।

মৎস্য ভবন থেকে পরিচালিত ২০০৭ সালের এক জরিপের তথ্য বলছে- সে সময় পর্যন্ত পুকুরের সংখ্যা নেমে এসছে ২০০টিতে। বর্তমানে ঢাকা শহরে পুকুরের সঠিক সংখ্যার হিসাব নেই ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছে। তবে ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে ২০১৮ সালের জরিপে শতাধিক পুকুরে অস্তিত্ব থাকলেও বর্তমানে রাজধানীতে পুকুরের সংখ্যা মাত্র ২৯টি।

জানা গেছে এসব শত শত পুকুরের ওপর গড়ে উঠছে কয়েক হাজার বহুতল ভবন ও বিভিন্ন নামিদামি প্রতিষ্ঠান। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ডিটেইল অ্যারিয়া প্ল্যান ২০২২ অনুযায়ী, রাজউকের ১৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৩৪৬৪টি পুকুর আছে। এর মধ্যে ২০৫টি ঢাকার মধ্যাঞ্চলে। ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ব্যক্তি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার এবং অন্যান্য সংস্থার কারণে ঢাকা ৯৫৫৬ একর বন্যা প্রবাহ অঞ্চল, জলধারণ এলাকা এবং জলাশয়ের মধ্যে ৩৪৪০ একরই হারিয়েছে। এদিকে আগুন সেভাতে পানির অভাবে ধুঁকতে হয়, অপর দিকে বর্ষায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের উপায় না থাকায় ভারি বৃষ্টিপাতের সময় তীব্র জলাবদ্ধতা তৈরি হয়।

গত দুই দশকের পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্স (বিআইপি) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত ২০ বছরে ঢাকায় জলাশয় ও খোলা জায়গার পরিমাণ দুই-তৃতীয়াংশ কমেছে।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, একটি ‘আদর্শ শহর’ গড়ে ওঠে কংক্রিট, সবুজ ও পানির সমন্বয়ে। অন্তত ২৫ শতাংশ সবুজ, ১৫ শতাংশ জলাধার থাকবে। বাকি ৬০ ভাগের মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ ভাগ কংক্রিট এলাকা করতে পারে, বাকিটা ভবনের মাঝখানে খালি জায়গা হিসেবে থাকবে। কিন্তু ঢাকায় এখন মোট জমির ৮০ শতাংশের বেশি জায়গাজুড়ে কংক্রিট, ৯ শতাংশের কিছু বেশি এলাকায় সবুজ আচ্ছাদন টিকে আছে। খোলা জায়গা এবং জলাভূমি আছে পাঁচ শতাংশেরও কম। ভরাট হয়ে গেছে ৭০ শতাংশ জলাশয়।

বিআইপির ‘সবুজ এলাকা, জলাশয়, খোলা উদ্যান ও কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার বিদ্যমান অবস্থা সংক্রান্ত’ গবেষণার তথ্য বলছে, ১৯৯৯ সালে ঢাকায় জলাভূমি ছিল ১৯ দশমিক ০৯ বর্গকিলোমিটার, যা শহরের মোট আয়তনের ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। ২০০৯ সালে তা অর্ধেকেরও নিচে নেমে হয় ৭ দশমিক ৬৮ বর্গ কিলোমিটার। শতকরা হিসাবে তা দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। অর্থাৎ ১০ বছরে ভরাট হয়েছে ১১ দশমিক ৪১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা। অথচ এই এক দশকের মধ্যেই ২০০০ সালে জলাধার আইন করেছে সরকার, যার ৫ ধারায় বলা আছে, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। সেই জায়গা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা যাবে না বা ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করা যাবে না।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইনেও (২০১০ সালে সংশোধিত), যে কোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

জলাধার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, কেউ আইনের বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে।

নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারি বিভিন্ন পরিকল্পনায় আছে জলাধার রাখতে হবে, সবুজ এলাকা রাখতে হবে। কিন্তু তারা নিজেরাও রাখতে পারছে না এবং বেসরকারি পর্যায়ে যেসব আবাসন হচ্ছে তাদেরও মানাতে পারছে না। এটা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা।’

তিনি আরো বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের মুনাফার লোভ, ব্যক্তি পর্যায়ে আইন না মানা, সবুজ এলাকা, খোলা জায়গা না থাকার প্রবণতা মারাত্মক। এজন্য সরকারের পাশাপাশি বিশিষ্ট নাগরিকদেরও দায়ী করা যায়, তারা বিষয়টি নিয়ে তেমন কথা বলে না।’

এদিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী জানান, পাঁচ বছর আগে ২০১৮ সালের জরিপে শতাধিক পুকুর থাকলেও ঢাকায় বর্তমানে পুকুরের সংখ্যা ২৯টিতে নেমেছে। পুকুরগুলোর ওপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

গত ৪ মে তিনি বলেন- বর্তমান পরিস্থিতিতে পুকুরগুলো রাষ্ট্রীয় সম্পদে পরিণত হয়েছে। জমির মালিকরা যে যার মতো পুকুর ভরাট করে ফেলবে এমনটা হতে পারে না। একটা পুকুর আশপাশের মানুষের জীবন মাল রক্ষা করছে। ফায়ার সার্ভিস কাজ করতে গিয়ে নানা অসুবিধার মধ্যে পড়ে জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, মার্কেটগুলোতে অধিক দোকান বসানোর প্রবণতা দেখা দেয়। যা বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে অন্য অনেক সেবা নিশ্চিতে পিছিয়ে থাকে। যেখান থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে গঠিত কমিটির আহ্বায়ক তাজুল ইসলাম বলেন, ঢাকা শহরে আমাদের ক্রমাগত জলাশয় কমছে। আমাদের মার্কেটগুলোতে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রাংশের অভাব রয়েছে। এর মধ্যে সস্তায় যন্ত্রাংশ কেনার প্রবণতা রয়েছে। অগ্নিনির্বাপক স্টোম রুম নেই।

ফায়ার সার্ভিসের এই পরিচালক আরো বলেন, ঝুঁকি থাকার পরও মার্কেট মালিক কিংবা দোকানিদের সহযোগিতার মানসিকতা থকে না বা আমরা পাশে পাই না। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও মার্কেটগুলো শনাক্তে জরিপ প্রয়োজন। একটা জরিপ করতে এক বছরের বেশি সময় লেগে যায়। তাই আমরা চিন্তা করছি আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে তিন মাসের মধ্যে জরিপ করার।

এদিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, অগ্নিনির্বাপণ আইন-২০০৩ অনুযায়ী আমরা নোটিশ ও মামলা দিতে পারি। এ আইনের আদলে সর্বোচ্চ সাজা তিন বছর। এটাকে অবশ্যই সংস্কার করা প্রয়োজন আছে, এ কাজটি হাতে নেবো। ৪ মে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন আরও বলেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিল্ডিং কোডের সঙ্গে অগ্নিনির্বাপণ আইন সাংঘর্ষিক। এটিও সংস্কার করা জরুরি। আমরা ছয়তলার উপরের ভবনগুলোকে বহুতল ভবন বলি, কিন্তু রাজউক ১০ তলার উপরের ভবনগুলোকে বহুতল ভবন বলে। এ তথ্য সংস্কার করতে হবে। রাজউক কোনো ভবন তৈরিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। ২০২২ সালে যে আইন পাস হয়েছে সেটি এরই মধ্যে পুরোনো হয়ে গেছে। বিএমডিসি কোড আমাদের মডিফাই করতে হবে।

বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস অফিসে হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মামলা করা হয়েছে। হামলাকারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। আইনের প্রক্রিয়ায় আছে। বিচারাধীন বিষয়ে আমি আর বিস্তারিত বলতে চাচ্ছি না।

তিনি বলেন, হামলায় ১৪টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। যার মধ্যে একটি গাড়ির দাম ৮ কোটি টাকা। এসব গাড়ি নিয়েই আমরা মানুষের পাশে দাঁড়াই।