বছরে ৩১ লাখ ৪২ হাজার কনটেইনার হ্যান্ডলিং

প্রকাশ : ০৭ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  সাইফুদ্দিন তুহিন, চট্টগ্রাম

দেশের বৃহত্তম রাজস্বের জোগানদার চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার ধারণ ক্ষমতা বেড়ে ৫৫ হাজারে (প্রতিটি ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে) উন্নীত হয়েছে। গেল এক বছরে ৩১ লাখ ৪২ হাজার কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। জাহাজের গড় অবস্থান সময়সহ নানা ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে বদলে গেছে সক্ষমতার চিত্র। যার সুফল ভোগ করছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। আন্তর্জাতিক বিশ্বেও বেড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের সুনাম। বন্দরে সব ধরনের সূচকে অগ্রগতির এ ধারা আগামীতে আরো জোরদার হবে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

বন্দর সূত্র জানায়, বিশ্বের যে কোনো বন্দরে জাহাজের গড় অবস্থানকাল গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দেশক। বর্তমানে কনটেইনারবাহী জাহাজ বহির্নোঙরে পৌঁছার এক থেকে দুই দিনের মধ্যে জেটিতে ভিড়ছে। ক্ষেত্র বিশেষে অন-অ্যারাইভাল বার্থিং প্রদান করা হচ্ছে। ২০২২ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ৩১ লাখ ৪২ হাজার (প্রতিটি ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে)। জেনারেল কার্গো বা সাধারণ পণ্য ওঠানামা হয়েছে ১১ কোটি ৯৬ লাখ মেট্রিক টন। জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছে ৪ হাজার ৩৬১টি। ক্রমবর্ধমান হ্যান্ডলিং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন শুরু করা হয়েছে।

আমদানিকৃত পণ্য দ্রুত খালাস ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য দ্রুত জাহাজীকরণে নির্মাণ করা হচ্ছে নতুন একাধিক টার্মিনাল। ইতিমধ্যে ৫৮৪ মিটার দীর্ঘ জেটিসহ পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। কক্সবাজার জেলার মহেশখালীতে ‘মাতারবাড়ি পোর্ট ডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্প কাজ দ্রুত এগোচ্ছে। বে টার্মিনাল এবং মাতারবাড়ি পোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প শেষ হলে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়বে চারগুণ। ২৫ এপ্রিল মাতারবাড়ি বন্দরে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ জাহাজ ভিড়েছে। ৬৩ হাজার টন কয়লাবাহী জাহাজটি ২৩০ মিটার দীর্ঘ। ১৩ মিটার ড্রাফটের মাদার ভ্যাসেলটি জেটিতে ভেড়ার মাধ্যমে সক্ষমতার নতুন ইতিহাস রচনা করেছে। মাতারবাড়ি টার্মিনাল বাস্তব রূপ লাভ করলে ১৬ মিটারের বেশি ড্রাফটের বেশি জাহাজ ভিড়তে পারবে। এতে দেশের নৌ বাণিজ্যের ইতিহাসও পাল্টে যাবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বে টার্মিনাল প্রকল্পের ৬৭ একর জমির দখল বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে ২০২১ সালের অক্টোবরে বুঝিয়ে দেয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। আরো প্রায় ৮০৩ একর জমি প্রতীকী মূল্যে বরাদ্দের প্রক্রিয়া চলছে। বে টার্মিনাল প্রকল্পের আওতায় দুটি কনটেইনার টার্মিনাল, একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল, ব্রেকওয়াটার এবং নেভিগেশনাল এক্সেস চ্যানেল নির্মাণ করা হবে।

টার্মিনালটি নির্মাণের প্রস্তুতি কাজও এগিয়ে চলছে। কর্ণফুলী নদীর মোহনার সুরক্ষিত তীরবর্তী স্থানে ২০০ মিটারের অধিক বৃহদাকার যাত্রীবাহী টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। টার্মিনাল নির্মাণ শেষ হলে হজ্জ যাত্রী ও পর্যটকবাহী জাহাজ বার্থিং সুবিধা পাবে।

পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল বা পিসিটি নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। এই টার্মিনালে বছরে ৪ লাখ ৫০ হাজার কনটেইনার হ্যান্ডেল সক্ষমতা রয়েছে। বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে টার্মিনালটি। এটির

জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় এক হাজার ২২৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।

টার্মিনালের ৫৮৪ মিটার দীর্ঘ জেটিতে একসঙ্গে ২০০ মিটার দীর্ঘ এবং ১০ মিটার ড্রাফটের দুটি কনটেইনারবাহী জাহাজ এবং ২২০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ডলফিন জেটিতে একটি তেলবাহী জাহাজ ভেড়ানো যাবে। গত ১৫ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে প্রথমবারের মতো ২০০ মিটার দীর্ঘ এবং ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ এমভি কমন এটলাস ভেড়ানো হয়। এতে বন্দরের সক্ষমতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। গেল বছরের ১১ সেপ্টেম্বর ইউনাইটেড ট্যাঙ্ক টার্মিনাল জেটিতে ‘এমটি ডা নাংগ গ্যাস’ নামে গ্যাসবাহী জাহাজ ভেড়ানো হয়। জাহাজটি অত্যন্ত নিরাপদে বার্থিং করা হয়। এতে চট্টগ্রাম বন্দরে এলপিজি জাহাজ বার্থিংয়ের এক নবযুগের সূচনা হয়। এখন নিয়মিত গ্যাসবাহী টাঙ্কার জাহাজ ভিড়ছে এই জেটিতে।

চট্টগ্রাম বন্দরের অটোমেশন প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। বিভিন্ন বিভাগের কার্যক্রমকে অটোমেশন করার জন্য ৫০টি সফটওয়্যার মডিউল তৈরি করা হচ্ছে। অটোমেশন প্রক্রিয়ার আওতায় কেন্দ্রীয় ডাটাবেস, ওয়েব পোর্টাল, আইটি অবকাঠামো একত্রীকরণের সুবিধা রয়েছে। যার মাধ্যমে বন্দরকে একটি পেপারলেস প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা সম্ভব হবে। ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান সাংবাদিকদের বলেন, সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এক দশকে ৫ লাখ ৮০ হাজার বর্গমিটার ইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়েছে। এতে বন্দরের কনটেইনার ধারণ ক্ষমতা ৫৫ হাজারে উন্নীত হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং এলাকায় ওভারফ্লো কনটেইনার ইয়ার্ড এবং সদরঘাট এলাকায় একটি ৭৫ মিটার লাইটারেজ জেটি নির্মাণ করা হয়েছে। ইতিপূর্বে নির্মিত ৪০০ মিটার লাইটারেজ জেটি ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে সচল করা হয়েছে। এতে লাইটার জাহাজগুলো দ্রুত কার্গো পণ্য খালাস করতে পারছে। তেল খালাসের জন্য আরএম-৪ বা রিভার মুরিং-৪ এর স্থলে ডলফিন জেটি নির্মাণ করা হয়েছে। এতে রিভার মুরিং জেটিতে ভোজ্য তেল খালাস সহজ হয়েছে।

তিনি বলেন, পোর্ট লিমিট ৭ নটিক্যাল মাইল থেকে ৬২ নটিক্যাল মাইলে বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে বন্দরের জলসীমা ৮ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্ধিত পোর্ট লিমিটেডের সম্পূর্ণ এলাকা ডিজিটাল টাইডাল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। ফলে মাদার ভেসেলগুলো রিয়াল টাইম টাইডাল ইনফরমেশনের ভিত্তিতে গভীর সমুদ্র থেকে নিরাপদে বহির্নোঙরে যেতে পারছে। যা মেরিটাইম বিশ্বে চট্টগ্রাম বন্দরের ভারমূর্তি উজ্জল করেছে। পোর্ট লজিস্টিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য চারটি টাগবোট, ২টি মুরিং লঞ্চ, ২টি সাইট স্ক্যান সোনার, ২টি ইকো সাউন্ডার ও একটি হারবার টাগবোট সংগ্রহ করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর আইপিএস কমপ্লায়েন্ট পোর্ট উল্লেখ করে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের আন্তর্জাতিক মানদন্ড নিরূপণের জন্য ‘ইউএসসিজি আইপিএস টিম’ প্রতি বছর বন্দর অডিট করে। গেল ৩০ থেকে ৩১ জানুয়ারি এই টিম ইনফরমাল ভিজিট করে। পরে তারা সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তারা চট্টগ্রাম বন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের যুগোপযোগী একটি বন্দর বলে আখ্যায়িত করে। বন্দরের শতকরা ৯৮ ভাগ এলাকা এখন সিসিটিভি মনিটরিংয়ের আওতায় রয়েছে।

বন্দরের নিরাপত্তায় প্রতিটি গেটে এক্সেস কন্ট্রোল সিস্টেম প্রবর্তন করা হয়েছে। রপ্তানি কনটেইনার স্ক্যান করার জন্য দুটি আধুনিক স্ক্যানার সংগ্রহ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামী জুনেই এসব স্ক্যানার স্থাপন

সম্পন্ন হবে। গেল এক বছর বন্দরের বহির্নোঙর বা বন্দর সীমানায় কোনো ডাকাতি, চুরি, নৌ দুর্ঘটনা কিংবা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ইতিমধ্যে সিঙ্গাপুরভিত্তিক আন্তর্জাতিক নৌ নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ সংস্থা চট্টগ্রাম বন্দরকে জিরো পাইরেসি পোর্ট হিসেবে ঘোষণা করেছে।