ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মহাসড়কের বাঁকে ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং

মহাসড়কের বাঁকে ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং

সারা দেশে মহাসড়কের বাঁক যেন মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন সংকেত ও চিহ্ন থাকার পরও সড়কের বাঁকে চালকদের ওভারটেকিংয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা, ঘটছে প্রাণহানি। এরইমধ্যে মহাসড়কের বিপজ্জনক বাঁক চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব বাঁকের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে অবহিত করেছে হাইওয়ে পুলিশ।

জানা গেছে, নৌপথ সংকুচিত হওয়ায় বেড়েছে সড়ক পথের গুরুত্ব। অলিগলি থেকে শুরু করে মহাসড়কে যাত্রী ও পণ্য নিয়ে লাখ লাখ যানবাহন প্রতিদিন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটছে। যোগাযোগ খাতে সড়ক পথের পরিধি ও সংস্কার বাড়লেও যাত্রীদের নিরাপত্তার ব্যাপারটি উপেক্ষিত।

হাইওয়ে পুলিশ সারা দেশে পাঁচটি রিজিওনে মহাসড়কে ৮৮৩টি বিপজ্জনক বাঁক চিহ্নিত করেছে। দক্ষিণ বিভাগের মাদারীপুর রিজিওনে ২৬৪টি বাঁক, বগুড়ায় ২৪৮, কুমিল্লায় ১৮১, সিলেটে ১২৬ ও গাজীপুর রিজিওনে ৬৪টি বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে। মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে এসব বাঁক সোজা করার সুপারিশ করা হয়েছে। গত ১০ বছরে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে এসব বিপজ্জনক বাঁক চিহ্নিত করেছে হাইওয়ে পুলিশ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সড়ক নির্মাণে সোজা পথকে গুরুত্ব দিতে হবে। এরপরও যদি কোনো সড়কে মোড় পড়ে, সেক্ষেত্রে মোড়ের দুই পাশে গাছ লাগানো যাবে না। আবার মোড়ে গাছ লাগানো হলেও নিয়মিত ডালপালা কেটে দিতে হবে। কারণ মোড়ে গাছ থাকলে, এক প্রান্তের গাড়ি চালক বিপরীতমুখী গাড়ি ঠিক মতো দেখতে পান না। মহাসড়কের মোড়ে বিপরীতমুখী গাড়ি দেখতে না পাওয়ায় দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। মহাসড়কে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় নিহত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। আহত হচ্ছেন অনেকে, আবার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে সারা দেশে অলিগলি ও মহাসড়কের পরিধি বেড়েছে। সেই সঙ্গে পুরোনো সড়কের সংস্কারও করা হয়েছে। সড়ক সম্প্রসারণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ছোট-বড় যানবাহন। এতে প্রতিনিয়ত রাজধানীসহ সারা দেশের সড়কে কোনো না দুর্ঘটনা ঘটছে। আঁকাবাঁকা সড়কে ট্রাফিক সাইন এবং রোড মাকিং থাকার পরও চালকরা ওভারটেকিং এবং দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ছেন।

সড়ক ও জনপদ বিভাগ কর্তৃপক্ষ জানান, সারা দেশে মহাসড়কে এসব ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক চিহ্নিত করা হয়েছে। সড়কগুলোকে ঝুঁকিমুক্ত করতে কিছু বাঁক সোজা করা হয়েছে। আবার কিছু বাঁক সোজা করার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, রাঙামাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমাতে ২০১৯ সালে রাঙামাটি সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রোড ডিজাইন অ্যান্ড সেফটি সার্কেল বিভাগকে একটি চিঠি পাঠানো হয়। এরপরই একই বছরের রোড ডিজাইন অ্যান্ড সেফটি সার্কেল বিভাগের একটি প্রতিনিধি দল স্থানীয় প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট কর্মককর্তাদের নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সড়কগুলো পরিদর্শন করেন। পরে তারা বেশ কিছু সুপারিশ প্রণয়ন করেন। সেইসব সুপারিশে বলা হয়, রাঙামাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুই পাশে অবস্থিত পাহাড়গুলো কাটলে স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে এবং পাহাড় ধসের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। এজন্য পাহাড় না কেটে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকগুলোতে বিআরটিএ এবং ট্রাফিক সাইন ম্যানুয়াল অনুযায়ী সাইন-সিম্বল ও রোড মার্কিং স্থাপন করতে হবে এবং এসব সাইন-সিম্বল ও রোড মার্কিং সঠিকভাবে কার্যকর করতে হবে। তা না হলে রাতে দুর্ঘটনা বেড়ে যাবে বলে সুপারিশমালায় উল্লেখ করা হয়। এছাড়া সড়কের ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকে ‘লুকিং গ্লাস বা কনভেক্স মিরর স্থাপন করতে হবে। পাশাপাশি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকগুলোতে মাটি কেটে সমান করে (ফিলিং করে) রিটার্নিং ওয়াল করে দিতে হবে এবং সঠিক ড্রেনেজের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

তথ্যমতে, দক্ষিণ বিভাগের মাদারীপুর রিজিওনের আওতায় রয়েছে ২৬৪টি বাঁক। এসব বাঁক রয়েছে মাদারীপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, বরিশাল, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, খুলনা, বাগেরহাট, মাগুরা, যশোর ও নড়াইলে। বগুড়া রিজিওনের আওতাধীন বগুড়া, পঞ্চগড়, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, রংপুর, দিনাজপুর, লালমনিরহাট ও গাইবান্ধার মহাসড়কে বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে ২৪৮টি। কুমিল্লা রিজিওনে ১৮১টি ও সিলেট রিজিওনে ১২৬টি বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে। এই মরণফাঁদ সবচেয়ে কম রয়েছে গাজীপুর রিজিওনে। সেখানকার মহাসড়কে বিপজ্জনক বাঁকের সংখ্যা ৬৪টি।

হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি শাহাবুদ্দীন খান বলেন, ‘আমরা ঝুঁকি বিবেচনায় মহাসড়কের বাঁকগুলো চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানিয়েছি। সে অনুযায়ী কাজও হচ্ছে। এসব বাঁকে নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটছে এমনটা নয়। তবে এই স্পটগুলোতে বাড়তি ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। কোনোটাতে কম ঝুঁকি আবার কোনোটাতে বেশি।

তিনি বলেন, দুর্ঘটনা কমানোর জন্য কিছু সড়কে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাজ হয়েছে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে কাজ হয়েছে, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে রোড প্রশস্ত করা এবং সার্ভিস লেন করার মাধ্যমে কাজ হয়েছে। এভাবে মহাসড়কে ঝুঁকি কমানোর কাজ চলছে। সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে পথচারী ও যানবাহনের চালকদের সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। অন্যান্য সংস্থার পাশাপাশি হাইওয়ে পুলিশ এই সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক ও দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘মহাসড়কের এসব বাঁক বছরের পর বছর ধরে আলোচনায় রয়েছে। এর মধ্যে কিছু বাঁক সোজা করা হয়েছে। তবে বেশিরভাগ বাঁকই আগের মতোই বিপজ্জনক অবস্থায় রয়ে গেছে। এ কারণে সড়ক দুর্ঘটনার হার বাড়ছে।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. ইসহাক আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সারা দেশে মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমাতে বাঁকগুলো সোজা করার জন্য বিভিন্ন সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এরইমধ্যে মহাসড়কের বেশকিছু বাঁক সোজা করা হয়েছে। আর বিশেষ করে যেসব সড়কের বাঁক এখনো রয়েছে সেখানে বিভিন্ন সংকেত ও চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। যানবাহন যাতে সহজেই চলাচল করতে পারে সেজন্য বিভিন্ন ধরনের সিগন্যাল বাতিও ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও নিয়মিত বাঁকের আশপাশের গাছপালার ডাল কেটে পরিষ্কার করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত