চট্টগ্রামজুড়ে ডায়রিয়ার প্রকোপ

* সিভিল সার্জন কার্যালয়ে তদন্ত কমিটি গঠন * উপজেলায় মেডিক্যাল টিম গঠনের নির্দেশনা

প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  সাইফুদ্দিন তুহিন, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম মহানগরী ও আশপাশের উপজেলায় গাণিতিক হারে বাড়ছে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা। অনেকটা ঘরে ঘরে ডায়রিয়া রোগী। নগরীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি রয়েছে প্রচুর ডায়রিয়া রোগী। উপজেলাগুলোর সরকারি হাসপাতালেও ভর্তি অনেক ডায়রিয়া রোগী। চিকিৎসকরা বলছেন, পানিবাহিত এই রোগ গ্রীষ্ম মৌসুমে কিছুটা বাড়ে। তবে এবার অনেক বেশি রোগী ভর্তি আছেন হাসপাতালে। বেশিরভাগই ঘরে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হঠাৎ করে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন লোকজন। অনেকে মনে করছেন, চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষ নগরীর একটি বড় অংশে দু’মাসের বেশি সময় ধরে লবণাক্ত পানি সরবরাহ করছে। এসব পানি পান করে লোকজন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে নগরীর যেসব এলাকায় লবণাক্ত পানি সরবরাহ হচ্ছে সেখানে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীও বেশি।

তবে চট্টগ্রাম ওয়াসার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বরাবরের মতো দাবি করেছেন, ওয়াসার পানিতে কিছুটা লবণাক্ততা আছে। তবে তা খুবই সহনীয় মাত্রায়। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার মতো লবণাক্ত নয়। তাছাড়া বৃষ্টিপাত শুরু হলে ওয়াসার পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ একেবারেই কমে যাবে। এরপর পানি নিয়ে উৎকণ্ঠার কিছু থাকবে না।

নগরীর হালিশহর, চকবাজার, চান্দগাঁও, খাজা রোড, মোহরা, ষোলশহর এলাকায় ডায়রিয়া রোগী বেশি। এসব এলাকায় চট্টগ্রাম ওয়াসার সরবরাহ করা পানি লবণাক্ত। এই এলাকার সামর্থ্যবান বাসিন্দারা ওয়াসার পানি এড়িয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জারের মাধ্যমে সরবরাহ করা পানি কিনে নিচ্ছেন। প্রতি জার ৪০ টাকার স্থলে এখন ৬০ টাকা থেকে ৭০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এরপরও জারে করে সরবরাহ করা পানি সংগ্রহ করতে হিমশিম খাচ্ছে লোকজন। অভিযোগ রয়েছে, জারের মাধ্যমে সরবরাহ করা পানিও দূষিত। নগরবাসী যাচাই না করেই কিনে নিচ্ছেন। এতে ডায়রিয়া আক্রান্ত হওয়ার পরিবর্তে বেড়েই চলেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল (চমেক) ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, বেসরকারি মা শিশু হাসপাতালে প্রচুর রোগী ভর্তি আছে। নগরীর আগ্রাবাদে মা ও শিশু হাসপাতালে শিশু ডায়রিয়া ইউনিট শয্যা কানায় কানায় পূর্ণ। ইউনিটের ১৩ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধীন প্রায় ৬ মাস বয়সের শিশু কন্যা নাসরিন সুলতানা খাদিজা। তার বাবা সবজি বিক্রেতা খাইরুল ইসলাম ও নাসিমা বেগম বলেন, ডায়রিয়া ও জ্বর নিয়ে কয়েকদিন আগে ভর্তি করি বাচ্চাকে। এখন অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল।

গরম বাড়ার সঙ্গে চট্টগ্রামে গত এক মাস ধরে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ গরমজনিত বিভিন্ন রোগব্যাধি নিয়ে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি বেড়ে গেছে। আক্রান্তদের বেশিরভাগ শিশু ও বয়স্ক।

চট্টগ্রাম নগরীর বাইরে ১৭টি হাসপাতালে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ভর্তি হচ্ছে ডায়রিয়া রোগী। ফৌজদারহাটস্থ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) কেন্দ্রেও প্রচুর ডায়রিয়া রোগী ভর্তি আছে।

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. একেএম রেজাউল করিম বলেন, গরমের মৌসুম শুরুর পর থেকে ডায়রিয়া রোগী বাড়ছে। বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। খোলা ও বাসি খাবার খাওয়া যাবে না। সচেতনতা বাড়লে ডায়রিয়া আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা মিলবে। এদিকে ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব সতর্কতায় কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়েছে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন কার্যালয়। সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরীর স্বাক্ষরে ৪ মে এসব নির্দেশনা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। একই সাথে বেশক’টি উপজেলায় ডায়রিয়া প্রাদুর্ভাবের কারণ অনুসন্ধানে তিন সদস্যের কমিটিও গঠন করা হয়েছে। চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. ওয়াজেদ চৌধুরী অভিকে কমিটির সভাপতি করা হয়েছে। আর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের (এমওডিসি) ডা. নুরুল হায়দার কমিটির সদস্য সচিব। এছাড়া সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা থোয়াইনু মং মার্মাকে কমিটির সদস্য করা হয়েছে। কমিটি ডায়রিয়ার প্রকোপ থাকা (বিশেষ করে বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারা ও চন্দনাইশ) উপজেলাগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করে তিন কর্মদিবসের মধ্যে সিভিল সার্জনের কাছে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। নির্দেশনা প্রদান ও কমিটি গঠনের তথ্য নিশ্চিত করেছেন সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। জনস্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে ডায়রিয়া প্রাদুর্ভাবের বিষয়টি অতি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার জন্য সকল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে প্রদত্ত নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে: সকল স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানে ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগে চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত খাবার স্যালাইন ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী মজুত রাখতে হবে। ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগের চিকিৎসায় জাতীয় গাইডলাইন অনুসরণ করতে হবে।

গাইডলাইন অনুযায়ী কলেরা শনাক্তকরণ কিট ব্যবহার করতে হবে। ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগের চিকিৎসার তথ্য ডিআইএইচএস-২ এর মাধ্যমে রিপোর্ট করতে হবে। ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেলে সিভিল সার্জন অফিস ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অবহিত করতে হবে। ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগের স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে এবং মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত রাখতে হবে। দৈনন্দিন ডায়রিয়া রিপোর্ট সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কন্ট্রোল রুমে প্রেরণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতি ইউনিয়নে ১টি ও প্রতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫টি করে মেডিক্যাল টিম পুনঃগঠন করে প্রস্তুত রাখতে হবে। এজন্য সিভিল সার্জন কার্যালয়ে জেলা কন্ট্রোল রুম (ফোন নাম্বারে ০২৩৩৩৩৫৪৮৪৩) খোলা থাকবে। ডায়রিয়া বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করার জন্য উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য পরিদর্শক ইনচার্জ ও স্যানিটারি পরিদর্শকদের ফোকাল পারসন মনোনীত করে সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা। এছাড়া ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগ থেকে রক্ষা পেতে মসজিদ ও জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে মাইকিংয়ের মাধ্যমে প্রচারণা চালাতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।