প্রচণ্ড গরমে অস্থির জীবন

প্রকাশ : ১০ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

সারাদেশে অতিরিক্ত গরমে বাড়ছে রোগব্যাধি। বয়স্কদের পাশাপাশি রেহাই নেই শিশুদেরও। রাজধানীর হাসপাতালগুলোয় ডায়রিয়া-চিকেন পক্সে অসংখ্য রোগী ভর্তি হয়েছে। তাদের সেবা দিতে গিয়ে হিমশিমে পড়েছেন চিকিৎসকরা। স্বাভাবিক অবস্থায় রোগীকে হাসপাতালে আনা হয় না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই যেন বদলে যায়। সেই সঙ্গে পরিবেশেও আসে নানা পরিবর্তন। তাই তো শীতের আমেজ শেষ হতে না হতেই দিনে দিনে বাড়ছে শহরের ‘উষ্ণতা’। অতিরিক্ত গরমে ঘামের চোটে মানুষের শরীর যাচ্ছে শুকিয়ে। শরীরে পানির ঘাটতি দেখা দেয়ায় বাড়ছে বিভিন্ন রোগীব্যাধি। রাজধানীতে প্রচণ্ড গরমে নাকাল বাসিন্দারা।

অতিরিক্ত গরম সব সময়ই শরীরের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে শিশু ও যাদের বয়স ৬৫ বছরের কাছাকাছি বা তার চেয়ে বেশি সেসব মানুষের বেশি ঝুঁকি থাকে। গরমে শারীরিক অস্বস্তি ও নানান রোগব্যাধি দেখা দেয়। ঋতু পরিবর্তনে বিভিন্ন জীবাণুর বংশবৃদ্ধি ও মানবদেহে রোগ সৃষ্টিতে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়। সার্বিক পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন রকম রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। চলমান গরমে নতুন কিছু রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে।

ঢাকা মেডিক্যাল, মিডফোর্ড হাসাপাতালসহ বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, প্রচণ্ড গরমে জ্বর, কাশিসহ দেখা দিয়েছে নানা রোগ। বেড়েছে মানুষের ভোগান্তিও। শুধু তাই নয়, ভ্যাপসা এই গরমে হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে শিশু রোগীর সংখ্যা। বিশেষ করে ৬ বছরের কম শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে জ্বর, সর্দি, ডায়ারিয়াসহ চর্মরোগে। প্রায় মাসখানিক ধরে তীব্র দাবদাহে সারা দেশ থেকেই ডায়রিয়ার রোগী যাচ্ছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি)। ডায়রিয়া শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে রোগীরা।

এ বিষয়ে হাসপাতালের প্রধান বাহারুল আলম বলেন, দৈনিক হাসপাতালে রোগী ভর্তি হচ্ছেন। মানুষ এখন সম্ভবত নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস ছেড়ে দিয়েছে এবং রাস্তার খাবার খাচ্ছে। এ অবস্থায় ডায়রিয়া থেকে নিরাপদে থাকার জন্য বিশুদ্ধ পানি খাওয়ার পাশাপাশি রাস্তার পাশের খাবার খাওয়া বাদ দিতে হবে।

তিনি আরো বলেন, সাধারণত, প্রতিদিন প্রায় ৪০০ ডায়রিয়া রোগী এখানে চিকিৎসা নিতে আসে। বর্ষাকালের আগে রোগী ভর্তির সংখ্যা কিছুটা বাড়ে, যা এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে শীর্ষে পৌঁছায়। কিন্তু এই বছরের চিত্র অনেকটা ব্যতিক্রম। আইসিডিডিআরবির মহাখালী হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, ভর্তি হওয়া রোগীদের সাধারণত ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ছেড়ে দেয়া হয়।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অতিরিক্ত গরমে ঘামজনিত পানিস্বল্পতা, রক্তে লবণের মাত্রা কমে যাওয়া, অতি দুর্বলতা, হাত-পা কামড়ানো, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরানো ও বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া। এছাড়া অতি তাপে হিটস্ট্রোক বা খিঁচুনি থেকে অজ্ঞান হয়ে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বিভিন্ন চর্মরোগ, যেমন ঘামাচি, চামড়ায় ফোস্কা পড়া, লাল হয়ে যাওয়া, চুলকানির মতো সমস্যাও হতে পারে। এছাড়া গরমের বিশেষ রোগগুলো হলো- সর্দি-কাশি, ভাইরাল জ্বর, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাম, বসন্ত, টাইফয়েড, ডায়রিয়া, জন্ডিস, মেনিনজাইটিস, এনসেফালাইটিস ইত্যাদি। এর মধ্যে সর্দি-কাশি এবং ভাইরাসজনিত জ্বরের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। কারো কারো সর্দির সমস্যা থাকলে তা বেড়ে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। সাধারণ আমাশয় এবং রক্ত আমাশয় বেড়ে যেতে পারে। দূষিত পানি ও খাদ্য থেকে কলেরার মাত্রা অনেক বেশি হতে পারে।

গরমে রোগব্যাধি থেকে রেহাই পাওয়ার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রোগ প্রতিরোধে পর্যাপ্ত এবং প্রয়োজনে প্রচুর জীবাণুমুক্ত পানি পান করতে হবে। চিনিযুক্ত পানি, কোমল পানীয় ও অতি ঠান্ডা পানি বর্জন করতে হবে। কারণ, এ ক্ষেত্রে ঘাম বেড়ে গিয়ে পানি স্বল্পতা দেখা দিতে পারে। অতি গরমে ছায়াযুক্ত স্থান অথবা ঘরের মধ্যে অবস্থান করুন। বেশি ঘেমে গেলে পানি দিয়ে শরীর মুছে ফেলুন অথবা গোসল করে ফ্যান ছেড়ে শরীর শুকিয়ে ফেলুন। হালকা ও সুতি জামা পরিধান করুন। রোদের মধ্যে পরিশ্রম না করে সকাল বা বিকালে স্বল্পসময়ে কাজ সেরে ফেলুন। বেশি ঘাম হলে লবণযুক্ত শরবত পান করুন। এ ক্ষেত্রে খাবার স্যালাইন খাওয়া যেতে পারে।

চিকিৎসকরা বলেছেন, গরমে পানিবাহিত ভাইরাসের আক্রমণে ডায়ারিয়াসহ বেড়েছে নানা ধরনের রোগ। তাই শিশুর সুস্থতায় গরম থেকে দূরে রাখাসহ বিশুদ্ধ পানি অত্যন্ত জরুরি। গরম কবে নাগাদ কমবে, তা এখনও নিশ্চিত নয়। কিন্তু এই গরমে শুধু বড়রাই না, শিশুদেরও অবস্থা আশঙ্কাজনক।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের আউটডোরে ছোট্ট শিশুরা মায়ের কোলে ডাক্তারের অপেক্ষায়। বেশির ভাগ ওয়ার্ডেই জ্বর, সর্দি, ডায়ারিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত ভর্তি রোগীরা। এ বিষয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ভাইরাসের সেরোটেপ নানা রকম হওয়ায় শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়। এ সময় শিশুদের দরকার বিশেষ য। শিশুদের সুতি ও হালকা কাপড়ের পোশাকের পাশাপাশি খোলামেলা পরিবেশ দরকার।

হাসপাতালে বাড়ছে ছোঁয়াচে রোগ চিকেন পক্সে আক্রান্ত রোগী ভর্তি। এ রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ২৭০ জন, মারা গেছেন পাঁচজন। অন্য বছরের তুলনায় এ বছর আক্রান্ত বেশি বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

চিকিৎসকরা বলেছেন, সামান্য জ্বর, মাথাব্যথা ও শরীর ম্যাজম্যাজ করলে চিকেন পক্স হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। সাধারণত জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত এই রোগের প্রকোপ বেশি থাকে। তবে চলতি বছর আক্রান্তের হার তুলনামূলক বেশি। হাঁচি, কাশি, থুথুর মাধ্যমে, একসঙ্গে থাকা ও খাওয়ার মাধ্যমেও ছড়াতে পারে। চিকেন পক্সের যে ফোসকায় জীবাণু থাকে, এটি ফেটে গিয়েও রোগ ছড়াতে পারে। সংক্রামক এই রোগের চিকিৎসায় একমাত্র বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান রাজধানীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল। জরুরি বিভাগে চিকেন পক্সের রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি সংকটাপন্নদের ভর্তির জন্য ২৫ শয্যার ওয়ার্ডও রয়েছে হাসপাতালটিতে, যা প্রায় সময়ই পূর্ণ থাকে রোগীতে। সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে প্রতিদিন দুই থেকে তিনজন রোগী ভর্তি হচ্ছেন চিকেন পক্সে আক্রান্ত হয়ে।

সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের দেয়া তথ্য মতে, গত বছর প্রতিষ্ঠানটিতে চিকেন পক্স নিয়ে ৩৫০ জন রোগীকে ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে মৃত্যু হয় ১২ জনের। চলতি বছর ২৯৫ রোগী ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন পাঁচজন। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে শিশু দুজন।

সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের কনসালট্যান্ট ডা. মো. আরিফুল বাসার বলেন, প্রতি বছর এই সময়ে চিকেন পক্সে আক্রান্ত বেশি হয়। তবে এ বছর আক্রান্তের হার গত বছরের তুলনায় বেশি। যাদের অবস্থা সংকটাপন্ন তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেয়া হয়। ’

রোগীদের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক রোগী হাতুড়ে কিংবা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা নেন। এসবের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় অনেক রোগীর চামড়া পুড়ে গিয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ পথ্য সেবন করতে হবে।

এদিকে গতকাল মঙ্গলবার আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগে আজ বুধবার সকাল ৯টা পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণ আন্দামান সাগর এলাকায় অবস্থানরত লঘুচাপটি ঘণীভূত হয়ে একই এলাকায় সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হবে। এটি আরো ঘণীভূত হতে পারে। লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে।

পূর্বাভাসে আরো বলা হয়েছে, অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। তবে, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের দুয়েক জায়গায় বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তাপপ্রবাহের বিষয়ে বলা হয়েছে, রাজশাহী, নেত্রকোনা, খুলনা চুয়াডাঙ্গা এবং কুষ্টিয়া জেলাসমূহের উপর তীব্র তাপপ্রবাহ এবং অন্যত্র মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। এছাড়া সারাদেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে। গতকাল সকাল ৬টায় ঢাকায় বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ছিল ৭৬ শতাংশ। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল যশোর ৪১.০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।