আট দিনের রিমান্ডে ইমরান খান

গভীর রাজনৈতিক সংকটে পাকিস্তান

প্রকাশ : ১১ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফ (পিটিআই) চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আট দিনের রিমান্ড আদেশ দিয়েছেন পাকিস্তানের একটি আদালত।

গতকাল রাজধানী ইসলামাবাদের পুলিশ লাইন্স এলাকার একটি জবাবদিহি (অ্যাকাউন্টিবিলিটি) আদালতে ইমরান খানকে হাজির করার পর বিচারক মোহাম্মদ বশির এই আদেশ দেন বলে জানিয়েছে পাকিস্তানের দৈনিক ডন।

পাকিস্তানের অ্যাকাউন্টিবিলিটি আদালতগুলো মূলত দেশটির কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ব্যুরোর (ন্যাব) মামলার বিচারকাজ পরিচালনা করে। গত মঙ্গলবার দুটি মামলার শুনানিতে হাজিরা দেয়ার জন্য ইসলামাবাদ হাইকোর্টে গিয়েছিলেন ইমরান খান। সেখানে পাকিস্তানের আধা সামরিক বাহিনী রেঞ্জার্স এবং ন্যাবের একটি যৌথ দল পিটিআই চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। তারপর গতকাল দুপুরের দিকে ন্যাবের একটি দল তাকে আদালতে হাজির করে।

যে পরোয়ানার ভিত্তিতে ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেটি জারি করা হয়েছিল গত ১ মে। ন্যাবের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাজির আহমেদ বাট স্বাক্ষরিত সেই পরোয়ানা অনুসারে, আল-কাদির ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ইমরান খানের সংশ্লিষ্টতার যে অভিযোগ উঠেছিল, তার সত্যতা পেয়েছে ন্যাব। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এবং ন্যাবের ভাষ্য, ওই মামলার আসামি হিসেবেই গ্রেপ্তার করা হয় পিটিআই চেয়ারম্যানকে।

এদিকে ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর পাকিস্তানজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পিটিআই কর্মীরা ইসলামাবাদ, রাওয়ালপিন্ডি, লাহোর, করাচি, গুজরানওয়ালা, ফয়সালাবাদ, মুলতান, পেশোয়ার এবং মারদানসহ সারা দেশের শহরগুলোতে বিক্ষোভ করেন। এছাড়া গ্রেপ্তারের পর ইমরান খানের সমর্থকরা রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের সেনা সদর দপ্তর এবং লাহোরে সেনাবাহিনীর কর্পস কমান্ডারের বাসভবনে হামলা চালায় বলেও খবর পাওয়া গেছে।

পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে পিটিআইয়ের কর্মী-সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত দুই বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ইসলামাবাদ ও পেশোয়ারসহ বিভিন্ন শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এছাড়া কর্তৃপক্ষ দেশের সব স্কুল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। টুইটার ফেইসবুকসহ সব সামাজিক মাধ্যমে প্রবেশ সীমিত করেছে। পিটিআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মেহমুদ কোরেইশি সমর্থকদের প্রতি বৈধ ও শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইমরান খানের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে দলীয় আইনজীবীরা একাধিক আপিল ও পিটিশান দায়ের করবেন।

ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের তীব্র নিন্দা জানিয়ে এর প্রতিবাদে দেশজুড়ে গতকাল হরতাল পালন করে পিটিআইয়ের নেতাকর্মীরা। ধর্মঘট চলাকালে ‘উদীয়মান ফ্যাসিবাদের’ বিরুদ্ধে দেশবাসীকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান পিটিআইয়ের নেতা। পিটিআইয়ের শীর্ষ স্থানীয় নেতারা ঘোষণা করেছেন, গ্রেপ্তার হওয়ার দুই দিন আগে ইমরান খান দেশব্যাপী জনসভা করার যে সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছিলেন তা অপরিবর্তিত থাকবে। পাকিস্তানের গণমাধ্যম ডন অনলাইন জানিয়েছে, ইমরানের গ্রেপ্তারের কয়েক ঘণ্টা পর পিটিআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান শাহ্ মাহমুদ কুরেইশির আহ্বানে পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও ব্যাপক প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণার উদ্দেশ্যে দলটির ‘জরুরি কমিটির’ একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

পিটিআইয়ের মহাসচিব আসাদ উমর জানান, পাকিস্তানের ‘সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক নেতাকে’ গ্রেপ্তারের পর কুরেশির নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের কমিটি পার্টির কর্মসূচির পরিকল্পনা ঘোষণা করবে। এরইমধ্যে ইমরান খান এই কমিটি গঠন করেছেন। উমর বলেন, সারা বিশ্বকে দেখানো হচ্ছে, দেশে কোনো আইন নেই।

গতকাল ইসলামাবাদের পুলিশ লাইন্স গেস্ট হাউজের সামনে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ আপনাদের সাংবিধানিক অধিকার, এটি বজায় রাখুন। আইন নিজের হাতে তুলে নিবেন না। আপনাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়ার জন্য অজুহাত খুঁজছে তারা, আপনাদের চাপে রাখার অজুহাত খুঁজছে, তাদের সে সুযোগ দিবেন না।’

গ্রেপ্তারের পর ইমরানকে এই পুলিশ লাইন্স গেস্ট হাউজেই আটক করে রাখা হয় এবং সেখানেই গতকাল তার মামলার শুনানি চলে। পাকিস্তানের বিভিন্ন নগরীতে নিরাপত্তা বাহিনীকে উচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের মধ্যে তিনটির কর্তৃপক্ষ জরুরি এক আদেশে সব ধরনের জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে। ইসলামাবাদে লোকজনের চলাচলের জন্য বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ। ইমরান খানের কঠোর সমালোচনা করেছেন দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ। ইমরানকে আটক করার পর টুইটে দীর্ঘ একটি পোস্ট করেন শেহবাজ। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, যেখানে ইমরান খান আছেন সেখানে শত্রুর প্রয়োজন নেই। এছাড়া শেহবাজ শরীফ অভিযোগ করেছেন, ইমরান সেনাবাহিনীকে নিয়ে মিথ্যাচার ও আক্রণাত্মক কথা বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করেন এবং বিচার ব্যবস্থাকে নিজের ইচ্ছামতো ব্যবহারের চেষ্টা করেন। অনেকটা নাটকীয়ভাবে ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাঞ্জার্সের সদস্যরা। পুরোনো মামলায় হাজিরা দিতে গত মঙ্গলবার ইসলামাবাদ আদালতে যান তিনি। তিনি যখন আদালত চত্বরে নিজের বায়োমেট্রিক দিচ্ছিলেন তখন রেঞ্জার্সের সদস্যরা দরজা-জানালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে একটি গাড়িতে করে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে যায়।

ইসলামাবাদ হাইকোর্ট ইমরান খানের গ্রেপ্তারকে ‘বৈধ’ বলে রায় দিয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর এ রায় দেয়া হয়। তিনি লাহোর থেকে ফেডারেল রাজধানী ইসলামাবাদে আসার পরই গ্রেপ্তারের মুখোমুখি হন। ৭০ বছর বয়সি ইমরান খান গত বছরের এপ্রিলে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে বেশ কয়েকটি মামলার আসামি হয়েছেন। তিনি এসব মামলাকে ক্ষমতাসীন জোটের রাজনৈতিক প্রহসন উল্লেখ করে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। বর্তমানে সন্ত্রাস, ধর্ম অবমাননা, খুন, সহিংসতা এবং সহিংসতার পৃষ্ঠপোষক সম্পর্কিত ১৪০টিরও বেশি মামলা রয়েছে। ইমরান খানের পর একই জায়গায় থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন পিটিআইয়ের মহাসচিব আসাদ উমর। ইসলামাবাদের আদালতের প্রাঙ্গণ থেকে গ্রেপ্তার করেছে কাউন্টার টেরোরিজম ডিপার্টমেন্ট (সিটিডি)। ইসলামাবাদের হাইকোর্টের বার রুম থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় সিটিডির কর্মকর্তারা। পাকিস্তানের সাবেক এই অর্থমন্ত্রীকে কোন মামলায় আটক করা হয়েছে তা এখনো জানা যায়নি। তাকে আটকের সময় সঙ্গে ছিলেন পিটিআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মাহমুদ কুরেশি, সিনেটর সাইফুল্লাহ সারওয়ার খান এবং গুলাম সারওয়ার খান। পিটিআইয়ের তিন নেতা বার রুমে ফিরে এলেও উমরকে সঙ্গে করে নিয়ে যায় পুলিশ। তাকে আটকের ঘটনায় টুইট বার্তায় নিন্দা জানিয়েছেন তেহরিক-ই-ইনসাফের আরেক নেতা শিরিন মাজারি।

তুমুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ‘অবৈধভাবে আল-কাদির ট্রাস্টকে জমি বরাদ্দ দেয়ার’ একটি দুর্নীতি মামলায় আটক করা হয়। ইমরানের বিরুদ্ধে এ মামলাটি করেছিল ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরো (ন্যাব)। তবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইমরানকে গ্রেপ্তারের জন্য ন্যাবকে শুধুমাত্র ব্যবহার করা হয়েছে। মূলত এসব কিছুর পেছনের কলকাঠি নেড়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। এতসব করা হয়েছে ইমরান যেন ‘অদূর ভবিষ্যতে’ কোনোভাবে ক্ষমতায় না আসতে পারেন।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে পাক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বেনজির শাহ বলেছেন, এর আগেও দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ন্যাবকে দিয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দমনের চেষ্টা চালিয়েছে দেশটির সামরিক বাহিনী। এখন ইমরান খানের বেলাতেও সেই একই কাজ করা হয়েছে।

তিনি বলেছেন, ‘এই ঐতিহ্য এখনো চলছে বলে মনে হচ্ছে। ন্যাব যে দুর্নীতির তদন্ত করছে এর সঙ্গে ইমরান খানের গ্রেপ্তারের খুব বেশি সংশ্লিষ্টতা নেই। গ্রেপ্তারের সঙ্গে বেশি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, ইমরান খান গত কয়েকদিন ধরে সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করে আসছেন সেটির সঙ্গে।’

মোহাম্মদ ফয়সাল নামে রাজধানী ইসলামাবাদের এক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলেছেন, ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের কারণে, দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এমন পর্যায়ে চলে যেতে পারে যা পরবর্তীতে স্থিতিশীল করা নাও যেতে পারে। এই পর্যবেক্ষকের মতে, সেনাবাহিনীর ইন্ধনে গ্রেপ্তার হওয়ায় ‘ইমরানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা কমে এসেছে।’ তিনি বলেছেন, ‘এটি দেখা যাচ্ছে, দুটি বড় শক্তির মধ্যকার রাজনৈতিক সংঘাত পাকিস্তানের অসংখ্য সমস্যার ওপর আঘাত হেনেছে। পিটিআই এবং সেনাবাহিনী আক্রমণাত্মক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে।’ তিনি যোগ করেন, ‘আমার মনে হয় খানকে ক্ষমতায় ফিরতে দেখব না’ লম্বা সময়ের জন্য। কয়েকদিন ধরেই সেনাবাহিনীর ‘অতিরিক্ত ক্ষমতা’ চর্চার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন ইমরান। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সেনাবাহিনীর সঙ্গে কিছু বিষয় নিয়ে তার দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল। এসব কারণে সামরিক বাহিনী তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। তবে এর আগে ন্যাবকে দিয়ে যেসব রাজনৈতিক নেতাকে দমনের চেষ্টা করা হয়েছিল- তাদের চেয়ে ইমরানের বিষয়টি আলাদা। কারণ অন্যদের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে এত বড় পরিসরে আন্দোলন করতে দেখা যায়নি। কিন্তু ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিতে নাম লেখানো ইমরানকে গ্রেপ্তারের পরপরই পুরো দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে যান।

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের গ্রেপ্তার হওয়াকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সহিংসতা শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের শীর্ষ কূটনীতিকরা গত মঙ্গলবার একসঙ্গে দেশটিতে ‘আইনের শাসন’ মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন।

ওয়াশিংটনে এক যৌথ বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘আমরা শুধু নিশ্চিত করতে চাই যে, পাকিস্তানে যা কিছু ঘটুক তা আইনের শাসন ও সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।’ ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লিভারলি উল্লেখ করেন যে, কমনওয়েথ সদস্য দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে ব্রিটেনের ‘দীর্ঘদিন ধরে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক’ বজায় রয়েছে। ক্লিভারলি বলেন, ‘আমরা পাকিস্তানে শান্তিপূর্ণ গণতন্ত্র দেখতে চাই। আমরা দেশটিতে আইনের শাসন মানা দেখতে চাই।’ উভয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। এদিকে ক্লিভারলি বলেন, তাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত করা হয়নি। হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি কারিন জিন-পিয়েরি পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমরা আগেই বলেছি, কোনো রাজনৈতিক প্রার্থী বা কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নেই।’