১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত

ঘূর্ণিঝড় মোখা আজ সন্ধ্যা নাগাদ উপকূল অতিক্রম করতে পারে

প্রকাশ : ১৪ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচএম ফারুক

অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা আজ রোববার বিকাল থেকে সন্ধ্যা নাগাদ যে কোনো একটি উপকূল অতিক্রম করবে। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তর ও বিশেষজ্ঞরা ঘুর্ণিঝড়টির গতিপ্রকৃতি পর্যালোচনা করে ধারণা করছেন দেশের কক্সবাজার উপকূল ও সেন্টমার্টিন দ্বীপের উপর দিয়ে তাণ্ডব চালিয়ে মিয়ানমার উপকূলে আছড়ে পড়েবে। এ সময় কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনে ৮ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। কিন্তু অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় জোয়ারের উচ্চতা সবচেয়ে বেশি হয়। তাই সেন্টমার্টিনে জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস একসঙ্গে মিলে উচ্চতা বেশি হয়ে ২০ থেকে ২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হওয়ার শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সেন্টমার্টিনে এ উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হলে পুরো দ্বীপটি পানির নিচে তলিয়ে যাবে। তবে তা ফের জাগবে বলেও জানিয়েছেন তারা।

গতকাল শনিবার বিকালে ঘূর্ণিঝড় মোখার সবশেষ অবস্থান তুলে ধরতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এ সময় সংস্থাটির পরিচালক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান জানান- বাতাসের গতি ১৭০ থেকে বেড়ে ১৯০ কিলোমিটার হয়েছে। এটি রোববারের (আজ) আগে আঘাত হানার সম্ভাবনা নেই। এ মুহূর্তে এটির শক্তি বাড়ার সম্ভাবনা দেখছি না। অতিপ্রবল অবস্থায় এটা অতিক্রম করবে। এখন পর্যন্ত (শনিবার বিকাল) ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখার কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ সর্বোচ্চ ১৫ কিলোমিটার বেড়েছে। বর্তমানে সেখানে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ১৯০ কিলোমিটার। মোখার প্রভাবে কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনে ৮ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। তবে, জলোচ্ছ্বাসের কারণে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে জলাবদ্ধতা ও ভয়াবহ পরিস্থিতি হওয়ার সুযোগ নেই। সেন্টমার্টিন যেহেতু একটা দ্বীপ। সেখানে পানি পশ্চিম পাশ থেকে পূর্ব পাশে চলে যাবে।

ইতিমধ্যে কক্সবাজারে ১০ নম্বর মহা বিপদসংকেত ঘোষণা করা হয়েছে। মোখার কারণে আর কোনো সংকেত বাড়ানো হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, উপকূলে আঘাত হানার আগে আর কোনো সংকেত দেয়া হবে না। বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা এসব জেলায় এর প্রভাব পড়বে। ৫ থেকে ৭ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

হঠাৎ করে সংকেত বাড়ানোর কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ৮, ৯ ও ১০ তিনটাই মহা বিপদসঙ্কেতের আওতায়। কোন অঞ্চল দিয়ে এটা অতিক্রম করবে তার ওপর নির্ভর করে ৮, ৯ ও ১০ নির্ধারণ করা হয়। যেহেতু কক্সবাজারের কাছাকাছি টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন দিয়ে এটি অতিক্রম করার সম্ভাবনা আছে। সেজন্য কক্সবাজারকে মহা বিপদসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

এ আবহাওয়াবিদ বলেন, ঘূর্ণিঝড়টি কেন্দ্রের পরিধি ৭৪ কিলোমিটার। এটি যদি সেন্টমার্টিনের দক্ষিণ দিক দিয়েও প্রবাহিত হয়। কেন্দ্রের পরিধি বেড়ে যাওয়ায় এর প্রভাব সেন্টমার্টিন ও টেকনাফে পড়বে। উপকূলের ঘূর্ণিঝড়ে বড় অংশ আঘাত হানবে বিকাল ৩টা থেকে ৪টা। সন্ধ্যা ৬টার আগে এটার আঘাত হানার সম্ভাবনা প্রায় ৯০ শতাংশ। ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা এর প্রভাব থাকবে। এরপর এটি দুর্বল হয়ে পড়বে।

তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়টির বর্তমান গতিবেগ ঘণ্টায় ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার। গতি আরো বাড়বে। উপকূলের কাছাকাছি এলে গতিবেগ বেড়ে ২০ পর্যন্ত হতে পারে। সিত্রাংয়ের সময় উপকূলে আঘাত হানার গতিবেগ ছিল ৫৬ কিলোমিটার। মোখাও উপকূলে এলে এর গতি ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসবে। ৬০০ কিলোমিটার দূরে থাকলেও আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এটি অতিক্রম করবে।

এদিকে বিশেষজ্ঞ আবহাওয়াবিদদের তথ্য মতে, ঘূর্ণিঝড় মোখা সরাসরি আঘাত হানবে সেন্টমার্টিন ও মিয়ানমার উপকূলে। নীল জলরাশির দ্বীপটিতে ভয়ঙ্করভাবে তাণ্ডব চালাবে মোখা। একই সময়ে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের নিম্ন অঞ্চলগুলোতে ৮ থেকে ১২ ফুটের বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কা করছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। তবে দেশের উপকূলীয় অন্য ১০ জেলায় ৫ থেকে ৭ ফুটের বেশি জলোচ্ছ্বাস হতে পারে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।

কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক গবেষক এবং আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন- সেন্টমার্টিন দ্বীপের মানুষদের জীবন হুমকির সম্মুখীন।

এ গবেষকের পর্যবেক্ষণ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকার পূর্বাভাস মডেলের নির্দেশনা অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় মোখা স্থলভাগের প্রথম যে স্থানটিতে আঘাত করবে তা হলো সেন্টমার্টিন দ্বীপ।

তথ্য বলছে- সেন্টমার্টিন দ্বীপ সমতল ও সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা থেকে ৩ দশমিক ৬ মিটার ওপরে। মূল ভূখণ্ড ও দ্বীপের মধ্যবর্তী নয় দশমিক ৬৬ কিলোমিটার প্রশস্ত প্রণালি দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমের উন্মুক্ত সাগরের তুলনায় অনেক অগভীর। এখানে পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকজুড়ে রয়েছে ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার প্রবাল প্রাচীর। মূল দ্বীপ ছাড়াও এখানে ১০০ থেকে ৫০০ বর্গমিটার আয়তন বিশিষ্ট কয়েকটি ক্ষুদ্র দ্বীপ রয়েছে, যেগুলো স্থানীয়ভাবে ছেঁড়াদিয়া বা সিরাদিয়া (ছেঁড়া দ্বীপ) নামে অভিহিত করা হয়। যার অর্থ বিচ্ছিন্ন দ্বীপ।

ছেঁড়া দ্বীপ হলো বাংলাদেশের মানচিত্রে দক্ষিণের সর্বশেষ বিন্দু। দক্ষিণ দিকে এরপর বাংলাদেশের আর কোনো ভূখণ্ড নেই। সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ২৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ১২০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। এছাড়া রয়েছে ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। ঘূর্ণিঝড় মোখায় প্রবাল এ দ্বীপ ভয়ঙ্কর ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন আবহাওয়াবিদরা।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক বিজ্ঞানী ড. আব্দুল মান্নান বলেন, মোখার প্রভাবে সেন্টমার্টিন দ্বীপ পানির নিচে চলে যাবে, এটা নিশ্চিত। তবে সেটা স্থায়ীভাবে নয়। পাঁচ থেকে সাত ফুট জলোচ্ছ্বাস হলে তো সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভেসে থাকার কথা নয়। সেন্টমার্টিনে গতকাল ছিল ভরা জোয়ার। আজ কিছুটা কমবে। এবার সেন্টমার্টিনের জোয়ার কিন্তু পিক টাইমই ফলো করছে। মানে মোখা উপকূলে আসার সঙ্গে সঙ্গেই জলোচ্ছ্বাস শুরু হবে। এই পিক টাইমে জোয়ারের ওপরের অংশেও জলোচ্ছ্বাস হয়। তাই জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস একসঙ্গে হলে উচ্চতা বেশি হয়। অর্থাৎ সেন্টমার্টিনে আজ ৩.১ মিটার জোয়ার হবে অর্থাৎ ১০ ফুটের মতো। এর বাইরে জলোচ্ছ্বাস হবে আরো পাঁচ থেকে সাত ফুট উচ্চতার। সুতরাং জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস মিলিয়ে ২০ থেকে ২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। আর সেন্টমার্টিনে এ উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হলে পুরো দ্বীপটি পানির নিচে তলিয়ে যাবে। সাধারণত কোনো এলাকার ওপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় গেলে মিনিমাম ওইসব এলাকায় ছয় ঘণ্টা তাণ্ডব চলে। ফলে সব স্থাপনাই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ, ওখানে কিন্তু বড় কোনো বাউন্ডারি করা হয়নি। সুতরাং, সেন্টমার্টিনের বড় ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সাবেক এ আবহাওয়াবিদ আরো বলেন, ‘তবে, ঘূর্ণিঝড় সেন্টমার্টিনের ওপর দিয়ে গেলেও দ্বীপটিতে কিছু সুবিধা আছে। কারণ, আমরা এখন পর্যন্ত যেভাবে দেখছি তাতে ঘূর্ণিঝড়ের বাম পাশে পড়ে যায় সেন্টমার্টিন। এছাড়া, সেন্টমার্টিন তলিয়ে গেলেও কিন্তু পানি বের হয়ে যাবে। কারণ, চারপাশে খোলা বিচ। মানে একপাশে দিয়ে আসলেও আরেক পাশ দিয়ে বের হয়ে যাবে। এটা আবার স্থলভাগে হয় না। তবে, মিয়ানমার উপকূলে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা অনেক বেশি হবে। কারণ, মিয়ানমার ঘূর্ণিঝড় মোখার ডান পাশে হওয়াতে এর ওপর প্রভাবটা বেশি হবে। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড়গুলো ডান পাশে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। সেক্ষেত্রে মিয়ানমারের তুলনায় বাংলাদেশে কিছুটা কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এনভায়রমেন্টাল ওশানোগ্রাফি ও ক্লাইমেট বিভাগের সিনিয়র সাইন্টিফিক অফিসার ও বিভাগীয় প্রধান আবু শরীফ মো. মাহবুব-ই-কিবরিয়া বলেন, বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিল্ডিংগুলো সাইক্লোন সেল্টার আদলে করা। ঘূর্ণিঝড় মোখার জন্য আমাদের অফিসটাও শেল্টার হিসেবে কাজ করবে। এছাড়া, সেন্টমার্টিন তলিয়ে না গেলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে। বিশেষ করে দুর্বল স্থাপনা এবং জেলেদের ক্ষতি হবে।’ তবে, সেন্টমার্টিন তলিয়ে গেলেও খুব দ্রুত সময়েই পানি বের হয়ে যাবে। এটা স্থায়ীভাবে তলিয়ে যাবে না বলেই আমার ধারণা।

সমুদ্রের প্রাণীদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখায় যদি সাগরের কোনো প্রাণী মরে ভেসে আসে তাহলে আমাদের র‌্যাপিড রেসপন্স টিম দ্রুততম সময়ে ব্যবস্থা নেয়। সরকারের অন্যান্য দপ্তরগুলোর সহযোগিতা নিয়েই আমরা কাজগুলো করি। কোনো প্রাণী মরে ভেসে আসলে আমরা প্রথমেই বিজ্ঞানীর টিম পাঠাই এবং তারাই পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তবে, এরকম ঘূর্ণিঝড় সাগরে ফুড চেইনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রোটিনগুলো টার্বুলেন্টের মাধ্যমে নিচ থেকে উপরে আসে এবং ঘূর্ণিঝড়টি চলে যাওয়ার পর প্রচুর পরিমাণে প্রোডাক্টটিভ হয়।

এদিকে আবহাওয়া অফিস আরো জানায়, অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এই দুই জেলার অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১২ ফুটের বেশি উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।

সংস্থাটি জানায়, অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় ১০ জেলা জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হবে। ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫ থেকে ৭ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।

চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশাল বিভাগে ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে। অতি ভারি বর্ষণের প্রভাবে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমিধ্বস হতে পারে।

উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।

আবহাওয়া অফিসের সর্বশেষ বুলেটিন অনুযায়ী, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৭০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছে। এটি আরও উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর ও ঘণীভূত হয়ে আগামীকাল রোববার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে কক্সবাজার-উত্তর মিয়ানমার উপকূল অতিক্রম করতে পারে। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটার এর মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৭০ কিলোমিটার। যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর খুবই বিক্ষুব্ধ রয়েছে। উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

এদিকে গতকাল সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ঘূর্ণিঝড় নিয়ে এক সভা শেষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান জানিয়েছেন- ঘূর্ণিঝড়ের অভ্যন্তরীণ গতিবেগ, উপকূলের দিকে এগিয়ে আসার গতিবেগ এবং উপকূল থেকে দূরত্ব বিবেচনা করে আজকে এই সভা থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, কক্সবাজার জেলার জন্য ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করা হবে। চট্টগ্রাম ও পায়রা সমুদ্রবন্দরের জন্য ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত এবং মোংলা বন্দরের জন্য চার নম্বর বিপদ সংকেত জারি করা হবে।

এর আগে, আবহাওয়া অধিদপ্তরের মিডিয়া সেন্টারে এক ব্রিফিংয়ে সংস্থাটির যুগ্ম পরিচালক মো. আসাদুর রহমান বলেন, সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, উখিয়া অঞ্চলে মোখার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে। এটি যখন তীরে আছড়ে পড়বে তখন বাতাসের গতিবেগ থাকবে ১৬০ কিলোমিটারের বেশি। এর প্রভাবে যে বৃষ্টি হবে, তাতে পাহাড় ধসের শঙ্কা আছে। একটানা আট ঘণ্টার বেশি প্রবল বৃষ্টি হলে পাহাড়ধসের আশঙ্কা থাকে। প্রবল বৃষ্টির হতে পারে বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগে। সিলেটেও প্রভাব থাকবে তবে, ঢাকায় কম হবে।

আসাদুর রহমান বলেন, মোখার প্রভাব সিলেট পর্যন্ত থাকবে। বর্তমানে এর ডায়ামিটার ৫০০-৫৫০ কিলোমিটার। ডায়ামিটার যদি ২৫০ কিলোমিটারও থাকে, তাও তো কম না। তীর থেকে ৪০০ কিলোমিটারের মধ্যে এলে এর গতি থাকবে ১৬০-১৭৫ কিলোমিটার। কিন্তু এটা আরো গতি সঞ্চার করতে পারে। এই গতিতে এগিয়ে এলে কাল (রোববার) সকাল ১০টা থেকে ঝড়ো হাওয়ার পরিমাণ বাড়বে।

আবহাওয়াবিদ ড. মো. আবুল কালাম মল্লিক বলেন, প্রত্যেকটা সাইক্লোনের বৈশিষ্ট্য স্বতন্ত্র। সিডরের সঙ্গে এর তুলনা হলো, যতক্ষণ পর্যন্ত এটা বঙ্গোপসাগরে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত এর শক্তি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে। উপকূলে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এটা শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। বর্তমানে সাগরে অবস্থানকালীন মোখার দমকা বাতাসের সঙ্গে যে ঝড়ো হাওয়া বইছে তার সঙ্গে সিডরের মিল রয়েছে। উপকূল অতিক্রম করার সময় কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্য, গতিবেগ, দমকা বাতাস বা ঝড়ো হাওয়ার ধরন পরিবর্তন হয়। সে কারণে বাতাসের গতিবেগ কম বেশি হয়। তাই সিডরের মতো হবে এ রকম না বলে প্রায় সিডরের সমতুল্য গতিবেগ নিয়ে মোখা মিয়ানমার ও বাংলাদেশের কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে।

সাত অঞ্চলে নৌ হুঁশিয়ারি: এদিকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দেশের সাত অঞ্চলে নৌ হুঁশিয়ারি দিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। এই সাত অঞ্চলের ওপর দিয়ে ৬০ থেকে ৮০ কিলোমিটার বেগে ঝড়ো হাওয়াসহ বজ্রবৃষ্টির আভাসও দিয়েছে সংস্থাটি।

২১ জাহাজ ও হেলিকপ্টার নিয়ে প্রস্তুত নৌবাহিনী: প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলায় সমুদ্র ও উপকূলীয় এলাকায় দ্রুততম সময়ে দুর্যোগ-পরবর্তী জরুরি উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য নৌবাহিনীর ২১টি জাহাজ, হেলিকপ্টার ও মেরিটাইম পেট্রোল এয়ারক্রাফট (এমপিএ) প্রস্তুত রাখা হয়েছে। শনিবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন উপকূলীয় এলাকার বসবাসকারীদের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন নৌবাহিনীর সদস্যরা। এছাড়া জাহাজগুলো ত্রাণসামগ্রীসহ প্রস্তুত করা হয়েছে। পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী উপকূলীয় দুর্গত এলাকাগুলোতে মোতায়েনের জন্য নৌ কন্টিনজেন্ট প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সমুদ্র ও উপকূলীয় এলাকায় উদ্ধার অভিযান পরিচালনায় নৌবাহিনীর এমপিএ ও হেলিকপ্টারের মাধ্যমে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এমপিএ ও হেলিকপ্টারের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জাহাজ ও কন্টিনজেন্টগুলো বঙ্গোপসাগরে অনুসন্ধান ও উদ্ধার তৎপরতা চালাবে।

প্রথম ধাপে উদ্ধার কাজের জন্য বানৌজা সমুদ্র জয় ও ধলেশ্বরী- কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন ও টেকনাফ এলাকায়, বানৌজা শাপলা- কুতুবদিয়া এলাকায় ও বানৌজা হাতিয়া এবং এলসিটি ১০৩-সন্দ্বীপ ও হাতিয়া সংলগ্ন এলাকায়, এলসিডিপি ১১-পটুয়াখালী এলাকায় ও এলসিটি ১০৫- পিরোজপুর ও বরগুনা এলাকায় নিয়োজিত থাকবে।

এছাড়া খুলনার মংলায় বানৌজা শৈবাল, বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা, প্রত্যাশা জরুরি অনুসন্ধান ও উদ্ধারের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জের পাগলায় বানৌজা অপরাজেয়, অতন্দ্র, সুরভী, অদম্য ও পদ্মাকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী দুর্গত এলাকাগুলোতে জরুরি চিকিৎসা সহায়তায় বিশেষ মেডিক্যাল টিম জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, স্যালাইন ও অন্যান্যসামগ্রী নিয়ে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত থাকবে। ঝড়ের তীব্রতা ও আঘাতের প্রকোপ পর্যবেক্ষণের পর দ্বিতীয় ধাপে নৌবাহিনীর অতিরিক্ত জাহাজ এবং কন্টিনজেন্ট মোতায়েন করা হবে।