নির্ঘুম রাত কাটল উপকূলবাসী

প্রকাশ : ১৪ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার

‘অঁবাজি ৮ নম্বর সিগ্যালর হবর পাই, রাইতভর ঘুম না যাই’ প্রতিবেদকের কাছে মুঠোফোনে এই কথা জানিয়েছেন কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলার আলী আকবর ডেইল এলাকার বাসিন্দা মো. ছৈয়দ আলম (৪৫)। তিনি আরো বলেন, শুধু আঁই নয়, আঁরার এলাকার হন মানুষ ঘুম ন যা’। একই কথা জানিয়েছে সেন্টমার্টিনের আবদুর রহমান। বলতে গেলে কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন, কুতুবদিয়া, মহেশখালীর সোনাদিয়া, ধলঘাটা, মাতারবাড়ি, কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডী, খুরুশকুল, ঈদগাঁওয়ের গোমাতলী, পোকখালীতে স্মরণকালের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস ঘটাতে পারে ধারণা স্থানীয়দের। পাহাড়ধস ও জলোচ্ছ্বাসে প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কাও এড়িয়ে যাচ্ছেন না অতীতের ভুক্তভোগীরা। গতকাল দিবাগত রাতে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে উপকূল এলাকার বাসিন্দা।

এছাড়া উখিয়া-টেকনাফের আশ্রিত রোহিঙ্গা বসতি ও কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকায় ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। গতকাল দুপুরের পর থেকে কক্সবাজারসহ দেশের সব সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখে যেতে বলা হয়েছে। এরপর থেকে উপকূলের বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে কাজ শুরু করে প্রশাসন। তবে, গতকাল সকাল থেকে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে পর্যটক ও দর্শণার্থীরা ভীড় করেন। সমুদ্র থেকে তাদের সরিয়ে নিতে হিমশিম খেতে হয়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশকে।

এদিকে শুক্রবার রাত হতে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাত হয়েছে কক্সবাজারে। পাহাড়ের চূড়ায় এবং পাদদেশে বসবাসরতদের নিরাপদে সরিয়ে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। মোখায় সম্ভাব্য ক্ষতি ও পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করতে শুক্রবার রাতে জরুরি সভা করে জেলা প্রশাসন। সভায় মোখা মোকাবিলায় সকল প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে কক্সবাজারের প্রশাসন।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, গতকাল সকাল থেকে জেলার সব সাইক্লোন শেল্টার খুলে দেয়া হয়েছে। ১০ নম্বার মহাবিপদ সংকেত জারি করার পর থেকে লোকজনকে আশ্রয়ণকেন্দ্রগুলোতে নিয়ে আসা হচ্ছে। মোট ৮ হাজার ৬০০ জন সিসিপির এবং রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির ২ হাজার ২০০ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছে। ঘূর্ণিঝড় মোখা তুলনামূলকভাবে সেন্টমার্টিনে আঘাত হানার সম্ভাবনা রয়েছে। সেখানে নেভি, কোস্টগার্ড, পুলিশসহ সেন্টমার্টিনে ৩৭টি সরকারি স্থাপনাকে সাইক্লোন শেল্টার হিসেবে ব্যবহারের জন্য বলা হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজ চলছে।

জেলা প্রশাসক আরো বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবেলায় জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সেনাবাহিনী এবং বিমান বাহিনীও সহযোগিতা করবেন। ঘূর্ণিঝড়ের সময় রাস্তায় গাছপালা পড়ে থাকলে সেগুলো দ্রুত অপসারণের জন্য বনবিভাগ ও ফায়ারসার্ভিস কাজ করবে।

দুর্যোগকালীন সময়ের জন্য ২৫ লাখ নগদ টাকা রাখা হয়েছে। যার মধ্যে ১০ লাখ টাকা উপজেলা পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে ৫.৯০ মে. টন চাল, ৩.৫ মেট্রিক টন টোস্ট বিস্কুট, ৩.৪ মেট্রিক টন শুকনা কেক, ১৯৪ বান্ডিল ঢেউটিন, ২০ হাজার প্যাকেট ওরস্যালাইন ও ৪০ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট মজুত রাখা হয়েছে। প্রস্তুত রয়েছে ৫৭৬টি আশ্রয় কেন্দ্র। ওইসব সাইক্লোন শেল্টারের ধারণাক্ষমতা মোট ৫ লাখ ৫৯৯০ জনের। খোলা হয়েছে একটি কন্ট্রোলরুম। মোবাইল নাম্বার: ০১৮৭২৬১৫১৩২।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ জানিয়েছেন, মোখা মোকাবিলায় প্রশাসনের পক্ষে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে তৎপরতা চালানো হচ্ছে। এরইমধ্যে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে আনা শুরু হয়েছে। নারী, বয়স্ক, শিশু এবং গাবাদি পশু সহ উপকূলীয় এলাকার মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। জেলায় ৫৭৬ টি আশ্রয় কেন্দ্রে ক্রমাগত মানুষ আসতে শুরু করেছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ১ লাখ ৭৭ হাজার ৭শ’র বেশি মানুষ আশ্রয় নেয়ার তথ্য রয়েছে। এটা আরও বাড়বে। যারা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় থাকার পরও আশ্রয় কেন্দ্রে আসবে না তাদের জোরপূর্বক আশ্রয় কেন্দ্রে আনা হবে।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় মোখাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন সেন্টমার্টিনের বাসিন্দারা। অনেক বাসিন্দা দ্বীপ ছেড়ে গেলেও সিংহভাগই অবস্থান করছে। সেন্টমার্টিনের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড় মোখায় দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা দ্বীপবাসিকে সর্তক করতে বিভিন্ন সচেতনামূলক প্রচারণা করে যাচ্ছি। মানুষকে নিরাপদে রাখতে স্কুল-মাদ্রাসা সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রেখেছি। আতঙ্কিত না হয়ে ধৈর্য সহকারে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানান চেয়ারম্যান মুজিব।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রশাসনের আলাদা প্রস্তুতি রয়েছে। দ্বীপের বাসিন্দাদের জন্য সরকারি বেসরকারি ৩৭টি ভবন আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে খুলে দেয়া হয়েছে। দ্বীপের জন্য আলাদাভাবে ৫ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১ লাখ টাকা পাঠানো হয়েছে।

মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইয়াছিন বলেন, মহেশখালীর সোনাদিয়া সবেচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ তাই সেখানকার প্রায় দুই হাজারের অধিক বাসিন্দাকে নিরাপদে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে। এছাড়াও ধলঘাটা, কালামরছড়া, কুতুবজোম এলাকায় যেসব বাসিন্দা ঝুঁকিতে রয়েছে তাদেরও সরিয়ে আনা হচ্ছে। আশ্রয় কেন্দ্রে খাবারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তাদের সহায়তায় কাজ করছে জনপ্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবক।

এদিকে, কক্সবাজার হোটেল মোটেল জোনের ৬৮ টি আবাসিক হোটেল মোটেলকে আশ্রয় কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে।

কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক হাফিজুর রহমান লাভলু বলেন, দূর্যোগকালীন সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সে দায়িত্ববোধ থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা হোটেলগুলোকে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করেছি। প্রয়োজনে সব হোটেলকে আশ্রয় কেন্দ্র করা হবে।

এদিকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে গতকাল সকাল থেকে পর্যটক ও দর্শণার্থীরা ভিড় করেন। অনেকে ঝুঁকি নিয়ে সৈকতে গোসল করতে নামেন। ট্যুরিস্ট পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকিং করে সমুদ্রে নামাতে নিষেধ করা হলেও আমলে নিচ্ছে না পর্যটকরা।

ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের সহকারী পুলিশ সুপার শেহরিন আলম বলেন, জোর করে লোকজনকে সরানো কঠিন। একদিক থেকে সরানো হলে অন্যদিক থেকে সাগরে নামে। এ অবস্থায় সকলের সহযোগিতা ছাড়া পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব না। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় ধসে অনাকাংখিত মৃত্যু এড়াতে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (যুগ্ম সচিব) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।

তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’য় রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি মোকাবিলায় ক্যাম্পগুলোতে স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ক্যাম্পের স্কুল ও মসজিদ-মাদ্রাসাসহ মজবুত সেন্টারগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে শেল্টার হিসেবে। ক্যাম্পে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, রেডক্রস, মেডিক্যাল টিম, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, দমকল বাহিনী, বিভিন্ন দাতা সংস্থার কর্মীসহ রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবীরাও দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে। দুর্যোগকালীন সময়ের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে নগদ অর্থ ও শুকনো খাবার।