ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

চট্টগ্রামজুড়ে ব্যাপক প্রস্তুতি

* বন্দরে এলার্ট-৪ জারি * শাহ আমানতে বন্ধ ফ্লাইট * ১৭ হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত
চট্টগ্রামজুড়ে ব্যাপক প্রস্তুতি

প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র আঘাত থেকে রক্ষায় চট্টগ্রামজুড়ে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের সব ধরনের পণ্য ওঠানামা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গত শুক্রবার রাতে জারি করা হয়েছে সর্বোচ্চ সতর্কতা এলার্ট-৪। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আজ পর্যন্ত সব ধরনের ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নগরীর ও আশপাশের উপজেলায় খোলা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র। পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক তদারকির জন্য খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ।

চটগ্রাম বন্দর সংশ্লিষ্টরা জানান, মোখার ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি), জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি)সহ বন্দর চ্যানেলের সব জাহাজ বহির্নোঙরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বন্দর চ্যানেল থেকে সব লাইটার জাহাজও কালুরঘাট থেকে সদরঘাট পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর বিভিন্ন স্থানে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

গতকাল ভোর ৪টা থেকে জেটি শূন্য ছিল। মোট ১৮টি জাহাজ সরিয়ে নেয়া হয় বিভিন্ন জেটি থেকে। বন্দরের পাইলটরা টাগবোটের সহায়তায় সব বড় জাহাজ বহির্নোঙরের নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেন। কর্ণফুলী নদীতে জোয়ার থাকাবস্থায় প্রতিদিন সকাল সাতটা পর্যন্ত অপারেশন চলে। কিন্তু ভাটার কারণে নেওয়া যায়নি পতেঙ্গা ওয়াটারবাস জেটিতে অবস্থানরত ক্রুজশিপ বে-ওয়ান এবং ৭ নম্বর জেটিতে থাকা তিনটি জাহাজ। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সতর্কতা সংকেত অনুযায়ী বন্দরের নিজস্ব অ্যালার্ট-৪ জারি করা হয়েছে। এর ফলে জাহাজ থেকে পণ্য, কনটেইনার লোড-আনলোড বন্ধ হয়ে গেছে। কিউজিসিসহ জেটির হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট নিরাপদে রাখতে শক্তভাবে বাঁধা হয়েছে। কিছু কিছু ইকুইপেমন্ট বিশেষ ব্যবস্থায় নিরাপদে রাখা হয়েছে। যাতে তীব্র বাতাসের ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। বন্দরের মেরিন, নিরাপত্তা, ট্রাফিক ও সচিব বিভাগের পৃথক কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। বন্দর ভবনে দফায় দফায় জরুরি বৈঠক করা হয়েছে। বৈঠকের মূল বিষয় ছিল বন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে গতকাল সকাল ৬টা থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ রয়েছে। শুক্রবার রাতে বিমানবন্দর বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়।

বিমানবন্দরে কর্মরত সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তারা জানান, আবহাওয়া অধিদপ্তরের মহাবিপদ সংকেতের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সকাল ৬টা থেকে শাহ আমানতে আন্তর্জাতিকক ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আজ পর্যন্ত ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ থাকবে।

বিমানবন্দরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিদিন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক মিলিয়ে ৩০টি ফ্লাইট ওঠানামা করে। এসব ফ্লাইট চলাচল বন্ধ থাকায় বিপুল সংখ্যক যাত্রী পড়েছে বিপাকে।

প্রস্তুত ১৭ হাজার স্বেচ্ছাসেবক : ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ মোকাবিলায় চট্টগ্রামে প্রায় ১৭ হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রয়েছে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এসব স্বেচ্ছাসেবককে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে স্থয়ী ও অস্থায়ী মিলে ১ হাজার ৩০টি আশ্রয় কেন্দ্রও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যাতে প্রায় পাঁচ লাখের অধিক মানুষকে দুর্যোগকালীন আশ্রয় দেয়া যাবে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।

জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। চট্টগ্রামে স্থায়ী ৫৩০টি এবং অস্থায়ী ৫০০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যাতে ধারণক্ষমতা রয়েছে পাঁচ লাখেরও অধিক। উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটি সভা করে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়ার জন্য চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার ইউএনওদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তারা এরই মধ্যে তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির আট হাজার এবং সিসিপির আট হাজার ৮৮০ জন স্বেচ্ছাসেবক মিলে মোট ১৬ হাজার ৮৮০ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত করা হয়েছে। অন্যদিকে দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপে ১১৬টি, বাঁশখালীতে ১২২টি, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় ৯৪টি, ফটিকছড়িতে ১১২টি (অস্থায়ী), হাটহাজারিতে ১৮টি (অস্থায়ী), মীরসরাইয়ে ৮৫টি, রাঙ্গুনিয়ায় ২১৭টি (অস্থায়ী), রাউজানে ২টি, সীতাকুন্ডে ২৫টি, বোয়ালখালীতে ৮টি, চন্দনাইশে ৬টি, পটিয়ায় ১২৬টি (অস্থায়ী), সাতকানিয়ায় ৪টি, আনোয়ারায় ৫৮টি, লোহাগাড়ায় ২৭টি (অস্থায়ী) এবং কর্ণফুলীতে ১০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

প্রস্তুত ফায়ার সার্ভিস : চট্টগ্রামে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ মোকাবিলায় ২৫টি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনকে সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। দ্রুত উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রাম সদর দপ্তরে ২৫ জনের একটি স্পেশাল টিম গঠন করা হয়েছে। এছাড়া এসব ফায়ার স্টেশনের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল ও ছুটিতে যারা ছিলেন তারা স্টেশনে যোগদান করেছেন। সবাইকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রাম সদর দপ্তরের সহকারী পরিচালক এমডি আবদুল মালেক বলেন, দুর্যোগপ্রবণ এলাকার জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রতিটি ফায়ার স্টেশনে সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ টিম, প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানকারী দল এবং একটি করে ওয়াটার রেসকিউ টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। চট্টগ্রামে ফায়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষিত হাজারো ভলান্টিয়ার প্রস্তুত রয়েছেন।

তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগেই জনগণকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়া ও সতর্কতামূলক মাইকিং করা হচ্ছে। অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার সরঞ্জামসহ অ্যাম্বুলেন্স, জেমিনি বোট, চেইন স, হ্যান্ড স, রোটারি রেসকিউ স, স্প্রেডার, মেগাফোন, র‌্যামজ্যাক বা এয়ার লিফটিং ব্যাগ, ফাস্ট এইড বক্স ইত্যাদি প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী অনুসন্ধান ও উদ্ধার কাজসহ রাস্তাঘাট যান চলাচল উপযোগী করার জন্য ফায়ার সার্ভিস প্রস্তুত রয়েছে। তিনজনের ডুবুরি দল কক্সবাজার পাঠানো হয়েছে জানিয়ে এমডি আবদুল মালেক বলেন, চট্টগ্রাম সদর দপ্তরে দুইটি ডুবুরি দল ছিল। তাদের একটি কক্সবাজারে পাঠানো হয়েছে। কারণ কক্সবাজারে উপকূলীয় অঞ্চলে তল্লাশি চালানোর জন্য ডুবুরি দলের প্রয়োজন পড়তে পারে। আরেকটি দল চট্টগ্রাম সদর দপ্তরে রাখা হয়েছে।

প্রস্তুত মেডিক্যাল টিম : ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ মোকাবিলায় ২৮৪টি মেডিক্যাল টিম গঠন করছে জেলা সিভিল কার্যালয়। গতকাল চট্টগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন ডা. ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় মোট ২৮৪টি মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলার ১৪টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধিন ৫টি করে মোট ৭০টি মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়া জেলার ২০০ ইউনিয়নে জন্য একটি করে মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত রয়েছে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন ৯টি আরবান ডিসপেনসারিতে ৯টি ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ৫টি মেডিক্যাল টিম রাখা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ মোকাবিলায় সিভিল সার্জন কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। পাশাপাশি খোলা হয়েছে জরুরি কন্ট্রোল রুম।

চসিকের প্রস্তুতি : ঘূর্ণিঝড় মোখা থেকে মানুষের জানমাল বাঁচাতে ৪১টি ওয়ার্ডে মোট ৯০টি আশ্রয়কেন্দ্র্র প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, মোখা মোকাবিলায় চসিকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা উপ-কমিটি এক জরুরি সভায় যেসব সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় তা বাস্তবায়নে মেয়রের নেতৃত্বে চসিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিরলস কাজ করছেন। নগরীর দামপাড়ায় চসিক বিদ্যুৎ উপ-বিভাগ ভবনের নিচ তলায় খোলা হয়েছে কন্ট্রোলরুম যেখানে থাকা ০১৮৯৪-৮৮৩০০২ এবং ০২-৪১৩৬০২৭১ এই দুটি নাম্বারে যে কোনো নাগরিক জরুরি সব ধরনের সেবার জন্য যোগাযোগ করতে পারবেন।

সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে ৪১টি ওয়ার্ডে ৯০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুতকরণ, কন্ট্রোল রুম গঠন, ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রস্তুতি সভা ও ঘূর্ণিঝড় মোখার গতিবেগ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জরুরি যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ। নাগরিকদের মাঝে সচেতনতা তৈরিতে প্রতিটি এলাকায় মাইকিং করার পাশাপাশি আরবান মেডিক্যাল টিম, আরবান ভলান্টিয়ার ও উদ্ধারকর্মীদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে বিশুদ্ধ পানি, শুকনো খাবার, প্রয়োজনীয় যানবাহন ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ও সড়কবাতি নির্বিঘ্ন রাখার জন্য প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত