দিনভর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি গুমোট আবহাওয়া

* চট্টগ্রামে আশ্রয় কেন্দ্রে ৮২ হাজার মানুষ * বন্দরে দুই দিন হ্যান্ডলিং বন্ধ * চরম গ্যাস সংকটে নাকাল নগরবাসী

প্রকাশ : ১৫ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  চট্টগ্রাম ব্যুরো

ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র প্রভাবে গতকাল দিনভর গুমোট আবহাওয়া ছিল চট্টগ্রামে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ছিল সারা দিন। বিকালের দিকে হালকা বাতাস বয়ে যায়। মোখা মোকাবিলায় চট্টগ্রামের উপকূলীয় উপজেলাগুলোয় সর্বাত্মক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রস্তুতি নেয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।

ছয় উপজেলায় আশ্রয় কেন্দ্রে এরই মধ্যে আশ্রয় নিয়েছেন ৮২ হাজার মানুষ। এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে টানা দুই দিন পণ্য ওঠানামা বন্ধ রয়েছে। নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া জাহাজগুলো এখনো সেখানেই আছে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠানামা দুই দিন ধরে বন্ধ। এতে বিদেশগামী যাত্রীরা পড়েছেন চরম বিপাকে। এদিকে মোখার প্রভাব পড়েছে দেশের জ্বালানি সেক্টরে। চট্টগ্রামে গ্যাস সংকটে এখন নাকাল অবস্থা। লোকজন চুলা জ্বালাতে পারেনি দুই দিন। সিএনজি গ্যাস-নির্ভর যানবাহন চলাচল সীমিত হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, বিপুলসংখ্যক মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন। তারা নিরাপদে আছেন। দুর্যোগ কেটে না যাওয়া পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করবেন। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বাঁশখালী, সন্দ্বীপ, আনোয়ারা, কর্ণফুলী, সীতাকুন্ড, মীরসরাই উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। বাঁশখালী উপজেলায় ১১০টি আশ্রয় কেন্দ্র্রে ৪৫ হাজার ১৪৩ জন, সন্দ্বীপে উপজেলায় ১৬২টি আশ্রয় কেন্দ্রে ২৯ হাজার ৮৮৫ জন, আনোয়ারা উপজেলায় ৩৩টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৫ হাজার ২৮০ জন, সীতাকুন্ড উপজেলায় ৬২টি আশ্রয় কেন্দ্র্রে ১ হাজার ২৮৯ জন, কর্ণফুলী উপজেলায় ১৮টি আশ্রয় কেন্দ্র্রে ২০০ জন এবং মীরসরাইয়ে আশ্রয় কেন্দ্র্রে ৬০ জন আশ্রয় নিয়েছেন। জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের

সার্বিক তত্ত্বাবধানে উপজেলাসমূহে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছেন উপজেলা

নির্বাহী কর্মকর্তারা। আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রিতদের মাঝে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন তারা। জেলা প্রশাসক বলেন, উপকূলীয় উপজেলাসমূহে ঘূর্ণিঝড় মোখা’র ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুদেরকে নিরাপদ আশ্রয়স্থলে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। মাছ-ধরার ট্রলার, নৌকা গত ১১ মে থেকে সমুদ্রে চলাচল বন্ধ আছে। নৌ চলাচল ও স্পিডবোট চলাচল বন্ধ আছে। কোস্ট গার্ড এ কার্যক্রম মনিটরিং করছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে রেড ক্রিসেন্ট ও সিপিপি’র ভলান্টিয়াররা দুর্যোগ মোকাবিলায় মাঠে আছেন। এদিকে ঘূর্ণিঝড় মোখা’র আঘাত থেকে রক্ষায় কর্ণফুলী নদীতে অবস্থান করছে ৪০০ লাইটার জাহাজ, অয়েল ট্যাংকার, ফিশিং ট্রলার, ড্রেজার ও বার্জ। এসব লাইটার জাহাজে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, পায়রাসহ বিভিন্ন গন্তব্যের দিকে যাওয়ার শিডিউল রয়েছে। জাহাজগুলোতে রয়েছে মেশিনারি, শিল্পের কাঁচামাল, ভোগ্যপণ্য ও খাদ্যশস্য রয়েছে। কিছু জাহাজ খালি রয়েছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর জেটির উজানে সদরঘাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত লাইটার জাহাজগুলো রয়েছে। মূলত শাহ আমানত সেতুর পূর্ব সপাশে বেশি লাইটার জাহাজ বয়াতে বাঁধা বা নোঙরে রয়েছে। জাহাজগুলো সুশৃঙ্খলভাবে রাখার বিষয়টি তদারকি করছে বন্দরের মেরিন বিভাগ। সহায়তা করছে কোস্ট গার্ড। এক নজরে মনে হবে এটি লাইটার জাহাজের টার্মিনাল। শাহ আমানত সেতুর নিচে অপেক্ষমাণ বার্জের এক মাঝি জানান, তারা প্লাস্টিক পাইপ বোঝাই করে ফেলেছেন। পায়রা যাবেন। কিন্তু সাগর উত্তাল হওয়ায় নিরাপদ আশ্রয়ে চলে এসেছেন। লাইটারেজ শ্রমিক ইউনিয়নের সিনিয়র সহ-সভাপতি নবী আলম বলেন, ঘূর্ণিঝড় থেকে সুরক্ষায় জাহাজগুলো নিরাপদ স্থানে নোঙর করে রাখা হয়েছে। পতেঙ্গা উপকূল ও বহির্নোঙরে কোনো লাইটার জাহাজ এ মুহূর্তে নেই। সব জাহাজ বন্দরের উজানে আশ্রয় নিয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের দাপট কমলে জাহাজগুলো আবার যাবে বহির্নোঙরে। চট্টগ্রাম বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, সব সময় দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় লাইটার জাহাজগুলো কর্ণপুলী নদীর নির্ধারিত স্থানে নোঙর করে থাকে। ৪০০ লাইটার জাহাজ কর্ণফুলী নদীর নির্দিষ্ট এলাকায় রয়েছে। বন্দরের জেটি, বহির্নোঙরে ও পোর্ট লিমিটে কোনো পণ্যবাহী জাহাজ নেই। বন্দর চ্যানেল, জেটি, হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট নিরাপদ রাখতে এবং ক্ষয়ক্ষতি কমাতে এমন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এদিকে মোখার আঘাত থেকে রক্ষায় মহেশখালীর কাছে গভীর সাগরে অবস্থানরক দুটি এলএনজি গ্যাসের ভাসমান টার্মিনাল সরিয়ে নেয়া হয়েছে গভীর সাগরে। যাতে ঘূর্ণিঝড়ে কোনো ধরনের ক্ষতি না হয়। টার্মিনাল দুটি সরিয়ে নেয়ার পর সেখান থেকে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে গ্যাসের গ্রিড লাইনে সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর থেকে চট্টগ্রামে ভয়াবহ গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। গত শনিবার রাত থেকে চট্টগ্রাম নগরীর অর্ধেক অংশে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। গতকাল ভোর থেকে গ্যাস সরবরাহ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। গতকাল দিনভর গ্যাস সংকটে নগরবাসী চরম দুর্ভোগ পোহান। অনেকে স্টোভ কিংবা লাকড়ি দিয়ে চুলায় রান্নার কাজ সারেন। কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি সূত্র জানায়, এলএনজি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ায় দেশের বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি খাতে হাহাকার শুরু হয়েছে। গত শনিবার চট্টগ্রামসহ সারাদেশে গ্যাস সরবরাহ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হওয়ায় রান্নাঘরের চুলা থেকে সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাসের অভাব প্রকট হয়ে উঠে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীতে গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। এতে করে রান্নাবান্না নিয়ে ঘরে ঘরে তৈরি হয়েছে কষ্ট, সিএনজি স্টেশনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ায় যানবাহনের দীর্ঘ লাইন এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন কমে যাওয়ায় শহর বন্দর এবং চট্টগ্রামজুড়ে ভয়াবহ লোডশেডিং শুরু হয়েছে। কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, দেশে ব্যবহৃত গ্যাসের প্রায় ৩০ শতাংশ আমদানিকৃত এলএনজির উপর নির্ভরশীল। গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এলএনজি কিনে সরকার দেশের গ্যাস খাতের ঘাটতি মোকাবেলা করছে। আমদানিকৃত এলএনজিবাহী জাহাজ বঙ্গোপসাগরের মহেশখালীর অদূরে দুটি ভাসমান টার্মিনালে খালাস করা হয়। ওখান থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে এলএনজি চট্টগ্রামের আনোয়ারা পর্যন্ত এনে জাতীয় গ্রিডের মূল সরবরাহ লাইনে প্রদান করা হয়।

ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে এলএনজি খালাসের ভাসমান টার্মিনাল দুটিকে শুক্রবার রাত ১১টা নাগাদ নির্ধারিত স্থান থেকে সরিয়ে গভীর সমুদ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে আমদানিকৃত এলএনজি খালাস পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। দেশে গত কিছুদিন ধরে প্রতিদিন গড়ে ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ দেয়া হ”িছল। মোখার কারণে এই ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে। ফলে সারাদেশে গ্যাস সরবরাহে ভয়াবহ রকমের ধস নামে। চট্টগ্রামসহ সারাদেশে গ্যাস সরবরাহ কমে যায়। এতে রান্নাবান্নার চুলা জ্বলা বন্ধ হয়ে যায় নগরীর বিভিন্ন এলাকায়। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে সিএনজি রি-ফুয়েলিং স্টেশনগুলোতে। শনিবার থেকে সিএনজি স্টেশনগুলোকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত পুরোপুরি বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। সিএনজিনির্ভর যানবাহনগুলোকে ভয়াবহ রকমের সংকটে পড়েছে। বিভিন্ন স্টেশনের সামনে অসংখ্য গাড়ি লাইন ধরে গ্যাসের অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। ভয়াবহ অবস্থা দেখা দিয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও। এলএনজি সরবরাহ কমে যাওয়ায় দেশব্যাপী পিডিবির বরাদ্দ কমানো হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে। ফলে চট্টগ্রামসহ পুরোদেশেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে চলমান গ্যাস সংকট ছয় থেকে সাত দিন থাকতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের শঙ্কা কমে গেলে গ্যাসভর্তি টার্মিনাল দুটি আবার মহেশখালীতে ফিরিয়ে আনা হবে। আগের মতোই গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে। তখন গ্যাস সংকট থাকবে না।