বিরোধী এমপিদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে রাজি : প্রধানমন্ত্রী

* রিজার্ভ নিয়ে কোনো চিন্তা নেই * স্যাংশন বিষয়ে কোনো ভয় করি না

প্রকাশ : ১৬ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  বিশেষ প্রতিবেদক

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পাশাপাশি নির্বাচনকালীন সরকারে বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যদের কেউ আসতে চাইলে তাকে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে সম্মতির কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘সংসদে যেসব সংসদ সদস্য আছে, তাদের মধ্যে কেউ যদি ইচ্ছা প্রকাশ করে নির্বাচনকালীন সরকারে আসতে, আমরা নিতে রাজি আছি। এমনকি ২০১৪ সালেও খালেদা জিয়াকেও আমি এ আহ্বান করেছিলাম, তিনি আসেননি। তারা (বিএনপি) সংসদে নেই। তাই তাদের সম্পর্কে চিন্তা করার কিছু নেই। গতকাল বিকাল ৪টায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। সদ্যসমাপ্ত জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফর নিয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা পশ্চিমা গণতন্ত্র ফলো করি। ব্রিটেনে কীভাবে নির্বাচন হয়, তারা কীভাবে করে, আমরা সেইভাবে করব। এখন নির্বাচন আসছে, ভয় কেন। জনগণের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। জনগণ যদি ভোট দেয় আছি, না দিলে নাই। জনগণের আস্থা বিশ্বাসই আমার একমাত্র শক্তি। আমার তো হারাবার কিছু নেই। বাবা-মা, ভাই সবই হারিয়েছি। আমি আমার দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের দেশে কিছু লোক আছে, দেশে যতই ভালো কাজ হোক না কেন, তারা তা দেখে না। তারা হয়তো চোখ থাকতে অন্ধ, আরেকটা হচ্ছে হীনমন্যতা। প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য অপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। হয় তাদের জ্ঞানের অভাব, না হয় দুরভিসন্ধি। প্রতিহিংসা পরায়ণতা, এটা তাদের থাকবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি মাইক লাগিয়ে আন্দোলন করে যাচ্ছে। সরকার হটাবে। আমরা তো তাদের কিছু বলছি না। আমরা যখন বিরোধী দলে ছিলাম, তখন আমাদের নামতে দিয়েছে? গ্রেনেড হামলা করে হত্যা করার চেষ্টা করেছে। ২১ হাজার নেতাকর্মী হত্যা করেছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ মেরেছে। নির্বাচন ঠেকাতে ৫০০ স্কুল পুড়িয়েছে। সাড়ে ৩ হাজার লোক ও ৩ হাজার ৮০০ গাড়ি পুড়িয়েছে। ২৭টি রেল পুড়িয়েছে। ৯টা লঞ্চ পুড়িয়েছে, ৭০টি সরকারি অফিস পুড়িয়েছে। তারা আন্দোলন করুক কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু যদি জ্বালাওপোড়াও কিছু করতে যায়, কোনো মানুষকে যদি আবার পোড়ায়, তাহলে ছাড় দেয়া হবে না।

তিনি আরো বলেন, মানুষের ক্ষতি আর করতে দেব না। একেকটা পরিবার আজকে কী দুরবস্থায় আছে, খোঁজ রাখেন? নিজের সন্তানকে কোলে নিতে পারে না। চেহারা নিয়ে কোথাও যেতে পারে না। কি বীভৎস অবস্থা সৃষ্টি করেছে বিএনপি-জামায়াত। ২০০৮ সালে তাদের ২০ দলীয় ঐক্যজোট পেয়েছে ২৯টি আসন। তারা আবার বড় বড় কথা বলে। কার টাকা-পয়সায় আন্দোলন করছে, কোথায় থেকে টাকা পাচ্ছে তারা। বাংলাদেশের মানুষ কি অন্ধ হয়ে গেছে? হাজার হাজার কোটি টাকা তো লুট করে নিয়েই গেছে। মানি লন্ডারিং করেছে খালেদা জিয়া ও তার দুই ছেলে। ৪০ কোটি টাকা তো উদ্ধার করে নিয়ে আসছি। এখনো বিএনপির বহু নেতার টাকা বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে সুইচ করা আছে।

ইশতেহার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ : আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার হবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। যদিও এটা আগেই বলে দিয়েছি। কিন্তু এটাই হবে, বাংলাদেশকে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ’৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পরে প্রাইভেট সেক্টরে মোবাইল, টেলিফোন চালু করে দিয়েছিলাম। আবার টেলিফোন ছিল এনালগ, সেইগুলো ডিজিটাল করেছি। আজকে দেশে প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা আছে। স্কুলে স্কুলে এখন ডিজিটাল ল্যাব আছে। এখন মোবাইলে ফোনে কথা বলতে পারছি, ছবি পাঠাতে পারছি। এটা স্মার্টনেস না? করোনার সময় আমরা যে মানুষের কাছে নগদ সহায়তা পাঠালাম, কীভাবে পাঠিয়েছি? প্রত্যেকর নাম ও আইডি কার্ড নিয়ে একসঙ্গে সরাসরি ৩৫ লাখ মানুষের কাছে টাকা পৌঁছে গেল। এখন বয়স্ক, বিধবা ভাতাসহ যা কিছু দিচ্ছি, সবাই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দিচ্ছি।

রিজার্ভ নিয়ে কোনো চিন্তা নেই : দেশের রিজার্ভ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা রিজার্ভ নিয়ে বলতে বলতে সবার মাথায় এটা ঢুকে গেছে। রিজার্ভ নিয়ে দেশে তেমন কোনো সংকট নেই। রিজার্ভ নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। তিন মাসের খাদ্য কেনার মতো ডলার যেন আমাদের হাতে থাকে, সেটা নিয়েই আমাদের চিন্তা। তবে আমরা সবসময় রিজার্ভ ধরে রাখার চেষ্টা করি। আগে কত রিজার্ভ ছিল, এখন আমাদের রিজার্ভ কত এসব। তাই এটা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। আমাদের জমি আছে, আমরা নিজেদের খাবার নিজেরাই উৎপাদন করব। এটা নিয়েও আমাদের কোনো সমস্যা নেই। আরেক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা আমাদের স্যাংশন দিয়েছে, তাদের স্যাংশন বিষয়ে কোনো ভয় করি না। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আমাদের আত্মবিশ্বাস নিয়ে থাকতে হবে। তবে যারা আমাদের এমন স্যাংশন দিয়েছে তাদের কাছ থেকে কোনো কিছু কেনাকাটা না করতে আমি অর্থ মন্ত্রণালয়সহ অন্যদের বলে দিয়েছি। চলমান ডলার সংকট বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দিচ্ছি। আমাদের বিনিয়োগ বাড়ছে, উৎপাদন বাড়ছে। কাজেই ডলারের ওপর চাপ তো বাড়বেই। কিছুদিন আগে করোনা গেল, এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যার ফলে আজ সারা বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। পরিবহন পরিচালন ব্যয় বেড়ে গেছে। যে কারণে ডলার সংকট এখন সমগ্র বিশ্বেই রয়ে গেছে।

বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারিত্বে উন্নীত হয়েছে : বাংলাদেশ ও জাপানের দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক ‘কৌশলগত অংশিদারিত্বে’ উন্নীত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে দ্রুততম সময়ে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি সম্পাদন, বিগ-বি প্রকল্পের মাধ্যমে আঞ্চলিক যোগাযোগ জোরদারকরণ, অর্থনৈতিক অবকাঠামোর উন্নয়ন, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, জাপান ওভারসিজ কো-অপারেশন ভলান্টিয়ার প্রকল্প পুনরায় চালু করা, বাণিজ্য বৃদ্ধি, বাংলাদেশের বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলে জাপানি বিনিয়োগ, মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল, ঢাকা-টোকিও সরাসরি বিমান চলাচল বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

দেশকে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছি : সরকারপ্রধান বলেন, কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সরকার কাজ করছে। এ কারণে আজ আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে বিএনপি তা চাইত না। তারা ভিক্ষার জন্য খাদ্য নির্ভরশীলতা অর্জনে বিশ্বাসী ছিল না। তারা চাইত বিদেশ থেকে ভিক্ষা করতে। আমরা ক্ষমতায় আসার পর দেশের কৃষির মেরামত শুরু করি। আজ আমাদের খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে। আমরা খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি তার রপ্তানি বাড়াতেও সরকার কাজ করছে। এছাড়া কৃষিপণ্যের একটি বড় বাজার আছে বিদেশে। দ্রুততম সময়ে আমরা যাতে বিদেশে পণ্য পাঠাতে পারি সেজন্য বিশেষ কার্গো বিমান কিনছি। এ অবস্থায় সামনের দিনে কৃষিপণ্য উৎপাদন লাভজনক হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে গ্রামে গিয়ে নিজ নিজ জমি চাষের উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান।

সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই : সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা ও বেতন বৃদ্ধি নিয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখনই সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেয়ার কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। তবে বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ানোর পদক্ষেপ নেব।’ ‘২০১৫ সালে আমরা যখন বেতন ভাতা বৃদ্ধি করি, আমরা একটা গবেষণায় দেখেছিলাম যে ইনফ্লেশনের (মুদ্রাস্ফীতি) সাথে সাথে একটা পারসেন্ট হারে বেতন বাড়বে। প্রতি বছরের হিসাব মতে ইনফ্লেশন যত বাড়বে তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমরা বেতন বাড়াই।

সাংবাদিকদের পাশে আছি : সাংবাদিকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একসময় সাংবাদিকতা করেছেন। কাজেই আপনারা জানেন, আপনাদের প্রতি সব সময় আমার আলাদা এক সহানুভূতি আছে। আন্দোলন সংগ্রামে আপনারা আপনারা পাশে ছিলেন, আমরাও ছিলাম। তবে মালিকদের সঙ্গে কী করণীয়, সেটা আপনারা করেন। আমরা আপনাদের পাশে আছি। তিনি বলেন, যারা পত্রিকার মালিক তারা সবাই অর্থশালী ও বিত্তশালী। তাই সাংবাদিকদের ভালো-মন্দ দেখা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সংবাদপত্রের সব মালিকরা বড় লোক। তাদের ব্যবসা আছে। কিন্তু করোনার সময় প্রণোদনার সুযোগটা কিন্তু তারা নিয়েছেন। আপনাদের দাবিটা আপনাদের আদায় করতে হবে। আমাদের সংবাদকর্মী ও কলা-কুশলীদের সুযোগ-সুবিধার জন্য বেসরকারি খাতে এতগুলা টেলিভিশন দিয়েছি। আগে মাত্র একটি টেলিভিশন ছিল। পত্রিকা যথেষ্ট দেয়া হয়েছে। পত্রিকা মালিক হচ্ছে সব বেসরকারি ব্যবসায়ী। সেখানে যারা কাজ করেন, তাদের দেখাশোনার দায়িত্ব কিন্তু তাদেরই।

এ সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের সভাপতি-লীর সদস্য, সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুল মান্নান এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সংবাদ সম্মেলনের সঞ্চালনা করেন।