স্বাভাবিক চট্টগ্রাম পোর্ট ও বিমান বন্দর

গ্যাস সংকট কেটেছে আংশিক

প্রকাশ : ১৬ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  সাইফুদ্দিন তুহিন, চট্টগ্রাম

ঘূর্ণিঝড় মোখার বিপদ সঙ্কেত নামিয়ে ফেলার পর স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি। চট্টগ্রাম বন্দরে গতকাল সকাল থেকে শুরু হয়েছে পণ্য ডেলিভারি। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে দেশি-বিদেশি অভ্যন্তরীণ সব ধরনের ফ্লাইট ওঠানামা শুরু হয়েছে। চট্টগ্রামে দুই দিন ধরে চলমান তীব্র গ্যাস সঙ্কট গতকাল সকাল থেকে কিছুটা কমেছে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় রান্নাসহ গ্যাসনির্ভর যাবতীয় কাজ চলছে সীমিত পরিসরে। এদিকে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রিত পৌনে এক লাখ লোক ফিরে গেছেন নিজ ঘরে। চট্টগ্রাম মহানগর ও আশপাশের উপজেলার বিভিন্ন স্থানে আশ্রিতরা নিজ বসত ঘরে ফিরে যান গতকাল রোববার রাতের মধ্যেই। চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরে গড়ে সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচহাজার কনটেইনার ওঠানামা হয়। গতকাল পুরোদমে কনটেইনার ওঠানামার কাজ চলেছে। গভীর সাগরে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া বড় জাহাজগুলো ফের জেটি ও বহির্নোঙরে ভিড়েছে। এতে কনটেইনারের পাশাপাশি সাধারণ কার্গো পণ্যও খালাস চলেছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য ডেলিভারিও চলেছে পুরোদমে।

এদিকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে দুইদিন বন্ধ থাকার গতকাল থেকে ফ্লাইট ওঠানামা শুরু হয়েছে। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত দেশি-বিদেশি অন্তত ১২টি ফ্লাইট ওঠানামা করেছে। রাতেও আরো ফ্লাইট ওঠানামার শিডিউল রয়েছে। তবে বিদেশগামী শত শত যাত্রী দুর্ভোগে পড়েছেন। তাদের এলোমেলো হয়ে যাওয়া ফ্লাইট শিডিউল স্বাভাবিক হতে বেশ সময় লাগবে বলে বিমান বন্দর সূত্র জানিয়েছে।

এদিকে চট্টগ্রামে গেল দুই দিন ধরে তীব্র গ্যাস সঙ্কটে নাকাল অবস্থায় ছিল নগরবাসী। সঙ্কট সামাল দিতে অনেকেই মাটির চুলা, স্টোভসহ গ্যাস সিলিন্ডার কেনা শুরু করেন। তবে গতকাল সকাল থেকে সীমিত পরিমাণে গ্যাস সরবরাহ শুরু হওয়ায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, মহেশখালীর কাছে বঙ্গোপসাগরে ভাসমান দুটি এলএনজি গ্যাসের টার্মিনাল আছে। এসব টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রাম হলে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। কিন্তু মোখার ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে গত শুক্রবার রাত ১১টায় দুটি টার্মিনাল মহেশখালী থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। ফলে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। গতকাল দুটি টার্মিনালের একটি মহেশখালীতে ফিরিয়ে এনে যুক্ত করা হয় পাইপলাইনে। এরপর শুরু হয় গ্যাস সরবরাহ। এটির গ্যাস সরবরাহ শুরু হওয়ায় গ্যাস সঙ্কট কিছুটা কমেছে। আরেকটি টার্মিনাল দ্রুত ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। তবে এটির পাইপলাইনে ত্রুটি থাকায় তা মেরামত করতে হবে। এরপর দুই টার্মিনালের গ্যাস একযোগে চট্টগ্রামে সরবরাহ শুরু হলে গ্যাস সঙ্কট কেটে যাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরজুড়ে গ্যাস সঙ্কট চলাকালে কেরোসিননির্ভর স্টোভ চুলার দাম বেড়ে যায়। এতে ২২০ টাকার স্টোভ ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়। পুরো নগরীতে গ্যাস সিলিন্ডারের হাহাকার পড়ে যায়। সঙ্কটের কারণে অনেকে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার শুরু করায় সিলিন্ডারের দামও বেড়ে যায়। ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকার গ্যাস সিলিন্ডার ৩ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। শুধু দুই দিনের মধ্যেই গ্যাস সিলিন্ডার আর স্টোভের ব্যবসা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। প্রতি লিটার ১১০ টাকার কেরোসিন বিক্রি হয় ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকায়। নগরীর বিভিন্ন স্থানে কেরোসিন তেল খুঁজেও পাননি ক্রেতারা। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা জানান, যে কোনো ধরনের সঙ্কট সৃষ্টির পেছনে কারো না কারো কারসাজি থাকে। চট্টগ্রামে দুই দিন গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকার সুযোগ নিয়েছে একটি চক্র। এই চক্রের কারসাজির কারণে গ্রাহকরা চরম মূল্য দিয়েছে। অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে নগরবাসীকে।

এদিকে দুই দিন গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকা এবং গতকাল সিএনজি গ্যাস রিফুয়েলিং স্টেশনে সীমিত পরিমাণে সরবরাহ থাকায় যানবাহন চলাচল তৃতীয় দিনের মতো বিঘ্নিত হয়েছে। সিএনজি স্টেশনগুলোতে সকাল থেকে ছিল যানবাহনের দীর্ঘ সারি। সিএনজির ঘাটতিকে পুঁজি করে বাস টেম্পোসহ সিএনজিনির্ভর যানবাহনগুলো বেশি ভাড়া নেয় যাত্রীদের কাছ থেকে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের কোনো নজরদারি ছিল না।

চট্টগ্রাম নগরীর সঙ্গে লাগোয়া বোয়ালখালী উপজেলার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম জানান, গোমদন্ডি থেকে নগরীর কাপ্তাই রাস্তার মাথা পর্যন্ত সিএনজি টেম্পোতে প্রতিজন ভাড়া নেয়া হয় ২০ টাকা। গতকাল রোববার প্রতিজন ভাড়া নেয়া হয় ৩০ টাকা করে। এভাবে প্রতিটি রুটে সিএনজি টেম্পোগুলো দ্বিগুণ তিনগুণহারে ভাড়া নিয়েছে। এতে যাত্রীরা চরম দুর্ভোগ পোহান। সঙ্কটের কথা বলে সোমবারও নগরীর বিভিন্ন স্থানে সিএনজিনির্ভর যানবাহনগুলো বেশি ভাড়া নিয়েছে।

এদিকে লাইনের গ্যাস বন্ধের সুযোগে কারসাজির মাধ্যমে বাড়িয়ে দেয়া হয় এলপিজি গ্যাসের দামও। ১ হাজার ১৭৬ টাকার একেক বোতল এলপি গ্যাস বিক্রি হয়েছে ১৬০০ টাকা থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত। দামের এমন কারসাজির অভিযোগের ভিত্তিতে রোববার সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৬ দোকানিকে ৪৮ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে নেতৃত্ব দেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সহকারী কমিশনার প্রতীক দত্ত। অভিযানে চট্টগ্রামের ষোলশহর রেলস্টেশন সংলগ্ন তাহের স্টোরে একেক সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রি হচ্ছিল ৩ হাজার টাকায়। পাশের দোকান সোহেল স্টোরে এলপি গ্যাসের বোতলের সঙ্গে চুলা কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। পুরো সেট বিক্রি হচ্ছে সাড়ে চার হাজার টাকায়। এ সময় তাহের স্টোরকে ২০ হাজার এবং সোহেল স্টোরকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এরপর নগরের এনায়েত বাজারের অধিকাংশ দোকানে এলপি গ্যাস বিক্রি হচ্ছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকায়। এ সময় এনায়েত বাজার এলাকার কিচেন ট্রেডার্সকে ১০ হাজার টাকা এবং আরো তিন দোকানকে ১৩ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

সহকারী কমিশনার প্রতীক দত্ত বলেন, লাইনের গ্যাস বন্ধের অজুহাতে অনেকে বেশি দামে সিলিন্ডার বিক্রি করেছেন। চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় দ্বিগুণ দামেও এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছিল। অনেকে গ্যাসের বোতলের সঙ্গে চুলা কিনতেও বাধ্য করেছেন। অনেক দোকানদার অভিযোগ করেছেন, ডিলাররা গ্যাসের দাম বেশি নিচ্ছেন। এসব অভিযোগে রোববার রাতে ষোলশহর ও এনায়েত বাজার এলাকার ৬ দোকানকে ৪৮ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ডিলারদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ক্যাবের সঙ্গে গ্যাস কোম্পানির বৈঠক : চলমান গ্যাস সঙ্কটের পর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কর্নফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে ক্যাব চট্টগ্রাম নেতৃবৃন্দ বৈঠক করেছেন। গতকাল নগরীর ষোলশহর এলাকায় অবস্থিত কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে ক্যাব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ক্যাব নেতৃবৃন্দ বলেন, ঘুর্নীঝড় মোখার ক্ষয়ক্ষতি কমাতে বিগত দুই দিন ধরে চট্টগ্রাম মহানগরীর বাসাবাড়ি, সিএসজি স্টেশন ও শিল্পকারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেন কর্নফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (কেজিডিসিএল)। ফলে বাসাবাড়িতে খাবারের সংকট প্রকট হয়ে যায়। খাবার কিনতে হোটেল রেস্তোরাঁয় ভিড় করলেও সেখানেও গ্যাস সরবরাহ না থাকায় নাকাল এবং বাড়তি টাকায় খাবার কিনতে বাধ্য হয়েছেন। এ সুযোগে এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডিারের দাম বেশি নেয় একশ্রেণির বিক্রেতা। ১২০০ টাকার সিলিন্ডার ৩ হাজার টাকার, রাইস কুকার, স্টোভ ও কেরেসিনের তেলের দাম আকাশছোঁয়া করে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় গণপরিবহন, সিএনজিও টেক্সিগুলোও বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে উদ্বেগ জানিয়ে ক্যাব নেতারা বলেন, দ্রুত গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক করুন। কেজিডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের সঙ্গে অনুষ্ঠিত জরুরি সভায় অংশ নেন ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন, ক্যাব চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক কাজী ইকবাল বাহার ছাবেরী, ক্যাব মহানগরের যুগ্ম সম্পাদক মো. সেলিম জাহাঙ্গীর, ক্যাব চান্দগাঁও থানা সভাপতি মো. জানে আলম, ক্যাব যুব গ্রুপ বিভাগীয় সভাপতি চৌধুরী কেএন রিয়াদ, ক্যাব যুব গ্রুপ মহানগর সভাপতি আবু হানিফ নোমান প্রমুখ। কেজিডিএল ইঞ্জিনিয়ারিং সাভিসেসের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মুহাম্মদ রইস উদ্দীন আহমদ এ উপলক্ষ্যে উপস্থিত ছিলেন।

ক্যাব চট্টগ্রাম নেতৃবৃন্দের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার পরিপ্রেক্ষিতে কেজিডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম জানান, অতিদ্রুত চট্টগ্রাম নগরে বাসাবাড়িতে ও সিএনজি স্টেশনে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। এরইমধ্যে গ্যাস সংযোগ স্বাভাবিক করা হচ্ছে। ঘূর্ণীঝড় মোখার ক্ষয়ক্ষতি কমাতে মহেশখালীতে অবস্থিত এলএনজি টার্মিনালগুলো নিরাপদে সরানো হয়। যার কারণে চট্টগ্রামে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করা হয় এবং গ্রাহকদের অবহিত করা হয়। পত্রপত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হয়।

ক্যাব নেতৃবৃন্দ বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরে এলএনজিনির্ভর গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থার কারণে যে কোনোভাবে আমদানিতে সংকট হলেই চট্টগ্রামে গ্যাস সঙ্কট প্রকট হয়ে যায়। এ অবস্থায় বিকল্প ব্যবস্থায় গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ন্যাশনাল গ্রিড থেকে বাখরাবাদ বা দেশীয় মজুত থেকে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার দাবি জানান। একইসঙ্গে যে কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা যে কোনো সংকট মোকাবিলায় বিকল্প ব্যবস্থায় বাসাবাড়ি ও সিএনজি স্টেশনে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা এবং দেশীয় গ্যাসে চট্টগ্রামের হিস্যা নিশ্চিত করার দাবি জানান।

নেতৃবৃন্দ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কর্নফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি বসতবাড়িতে ৫ লাখ ৯৭ হাজার সংযোগ আছে। যেখানে গ্যাসের চাহিদা প্রায় দৈনিক ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। ঘূর্ণীঝড় মোখার কারণে বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় প্রতি পরিবারে দুই দিনে প্রায় ৪ হাজার টাকার মতো অতিরিক্ত অর্থ করতে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়াও কার্যকর সমন্বয় না থাকায় গ্যাস সংকট স্বাভাবিক নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যের কারণে গ্রাহক পর্যায়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। তাই সুষ্ঠু সমন্বয় নিশ্চিত করার দাবি জানান তারা।