ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাব

বিদ্যুৎ-গ্যাস নিয়ে ভোগান্তি

বিদ্যুৎ-গ্যাস নিয়ে ভোগান্তি

ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে রাজধানীসহ সারা দেশের গাছপালা উপড়ে পড়ায় বিদ্যুতের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত এবং এলএনজি সরবরাহ বন্ধ রাখায় গ্যাস সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছে লাখো মানুষ। তবে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিদেশ থেকে আমদানি করা এলএনজি ভাসমান দুটি টার্মিনালের আপাতত একটি টার্মিনাল থেকে এলএনজি সরবরাহ শুরু হয়েছে। তবে এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনালটি গভীর সমুদ্র থেকে রওনা দিয়েছে। দুয়েক দিনের মধ্যে মহেশখালী এসে পৌঁছাবে। পাইপলাইনের সঙ্গে জুড়ে দিলেই সেখান থেকেও এলএনজি সরবরাহ শুরু হবে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ঘূর্ণিঝড় ও বৈরি আবহাওয়ার কারণেও প্রায়ই বিতরণ ও সঞ্চালন ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটে। বৈদ্যুতিক লাইনে ডালপালাসহ গাছ ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটে। এতে বৈদ্যুতিক লাইন ও পোল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘটে যান্ত্রিক ত্রুটি। সুতরাং, এরকম বৈরি আবহাওয়ার মধ্যে গাছ সরানোসহ যান্ত্রিক ত্রুটি সারাতে কিছুটা সময় প্রয়োজন হয়। এই অবস্থায়ও বৈদ্যুতিক সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সব কারিগরি কর্মীরা সদা তৎপর আছেন।

পেট্রোবাংলা সূত্র বলেছে, দুটি টার্মিনাল থেকে গত শুক্রবার ৬২ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ পাওয়া গেছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া গভীর নিম্নচাপটি অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়ায় দুটি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করা হয়। দিনে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪০০ কোটি ঘনফুট। সর্বোচ্চ সরবরাহ করা হয় গড়ে ২৮০ থেকে ২৮৫ কোটি ঘনফুট। এতে সব সময়ই সরবরাহ ঘাটতি থাকে। এক খাতে বন্ধ করে অন্য খাতে সরবরাহ বাড়ানোর (রেশনিং) মাধ্যমে ঘাটতি সমন্বয় করা হয়। এর মধ্যে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে আসে ২১৫ থেকে ২২০ কোটি ঘনফুট। এলএনজি বন্ধ হওয়ায় গ্যাস সরবরাহের ঘাটতি বেড়েছে।

গত ১৩ মে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দুটি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করার কারণে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা অঞ্চলে গত শনিবার গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হবে।

গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থা কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএ) রোববার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, গ্যাস সরবরাহের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে ছয় থেকে সাত দিন সময় লাগবে।

সংস্থাটির মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) আমিনুর রহমান বলেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে মূলত এলএনজি টার্মিনাল থেকে আসা গ্যাস দিয়েই চাহিদা মেটানো হয়। এর কারণে সেন্ট্রাল গ্রিড থেকে আমাদের গ্যাস দেয়া হয় না। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে এলএনজি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ায় এ অঞ্চলের মানুষ গ্যাস পাচ্ছে না। অন্যদিকে সিএনজি স্টেশনগুলোতে জ্বালানি ভরতে না পেরে অটো রিকশাসহ অন্যান্য যানবাহনের লম্বা লাইন পড়েছে। জ্বালানি সংকটে ভাড়া দ্বিগুণ হয়ে পড়েছে অটোরিকশার।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এলএনজি সরবরাহ কমায় তিতাস অধিভুক্ত এলাকায় গ্যাসের স্বল্প চাপ বিরাজ করবে। এলএনজি সরবরাহ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত গ্যাসের স্বল্প চাপ থাকবে। রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ এলাকায় গ্যাস সরবরাহ করে তিতাস। গ্রাহকদের সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।

এদিকে গ্যাসের সরবরাহ কমায় কয়েকটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, চট্টগ্রাম, মেঘনাঘাট, হরিপুর ও সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা হয়েছে। চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতি ৩ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। এতে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে বেশি করে।

দিনে এখন বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা প্রায় ১৪ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে ১১ হাজার মেগাওয়াটের কম। গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দিনে সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলেও এখন হচ্ছে ৫ হাজার মেগাওয়াট।

পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এসএম ওয়াজেদ আলী সরদার বলেন, দিনে ১১০ কোটি ঘনফুট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের সরবরাহ নেমে গেছে ৬০ থেকে ৭০ কোটি ঘনফুটে। তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক রাখতে তিনি নিজেই নিয়ন্ত্রণকক্ষে বসে নির্দেশনা দিচ্ছেন বলে জানান তিনি।

ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে দুটি বিতরণ সংস্থা ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকা) ও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। ডেসকোর দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, তাদের বিতরণ এলাকায় চাহিদা ১ হাজার ১৫৭ মেগাওয়াট। আর সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে ৮৩৫ মেগাওয়াট। বিভিন্ন এলাকায় ৩২২ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

তবে গত শনিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত শুক্রবার থেকে মহেশখালীর দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ বলেছে, এলএনজি সরবরাহ কমে যাওয়ায় তিতাস গ্যাসের চাপ বেড়েছে। সরবরাহ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এমন পরিস্থিতি থাকবে।

এদিকে গত শুক্রবার রাত থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে লোডশেডিং বেড়েছে। রাজধানী শনিরআখড়া এলাকার বাসিন্দা নয়ন মুরাদ বলেন, গত শনিবার আট ঘণ্টায় চারবার বিদ্যুৎ গেছে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে একাধিকার লোডশেডিংয়ে ঘরের মধ্যে থাকা যাচ্ছে না।

মিরপুরের বাসিন্দা আবু তাহের বলেন, মিরপুর এলাকায় গ্যাস নেই। কারো চুলায় মিট মিট করে আগুন জ্বললেও রান্না করার মতো গ্যাস ছিল না। এতে বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে খাবার কিনে এনে খেয়েছি।

কর্ণফুলী গ্যাসের উপমহাব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে গ্যাস-বিদ্যুতে ব্যাঘাত ঘটেছে। তবে আমরা বিকল্প পথে কিছু গ্যাস বাসাবাড়িতে দেয়ার চেষ্টা করছি।

গত রোববার সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের সামনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, গ্যাসের প্রবাহ স্বাভাবিক হতে দুয়েক দিন সময় লাগবে। ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) বা ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল দুটি পুরোদমে চালু হতে সময় লাগবে। একটা চালু হয়ে যাবে। আগামী দুই দিনের মধ্যে জাহাজ চলে আসবে, গ্যাস আমরা দিতে পারব। আরেকটি চালু হতে ১২ থেকে ১৫ দিন সময় লাগবে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া কেটে গেলে আবারও গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত রাজধানীসহ সারাদেশে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট চরমে পড়ে মানুষ।

উল্লেখ, ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে সাগর উত্তাল ছিল। কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরগুলোকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত এবং পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরগুলোকে ৬ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর। এ কারণে মহেশখালীর দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে গত শুক্রবার ১২ মে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত