জ্বালানি ঘাটতি পূরণে নানা উদ্যোগ

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পরিকল্পনা

প্রকাশ : ১৮ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধিতে বিদ্যুৎ খাতে চাপ বেড়েছে। তবে চলমান চাপ সামলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে বেশকিছু পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেেেন্দ্রর পাশাপাশি সব সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সোলার প্যানেল বসানোর পরিকল্পনা চলছে। বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বাড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে। সেজন্য বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী লাইট এলইডি ব্যবহার করার জন্য ব্যবহারকারীদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। ভোক্তাদের জন্য জ্বালানি নিরীক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। আধুনিক ইটভাটায় পরিবর্তন ও গ্যাসচালিত সিম্পল সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে কম্বাইন সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রে রূপান্তরের জন্য সরকার বাস্তবমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। নতুন ভবন বিধিতে জ্বালানি কার্যকারিতা এবং সৌর জ্বালানির বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে ভবন বিধি সংশোধন করা হবে। রাইস পার-বয়লিং সিস্টেম থেকে দক্ষ রাইস পার-বয়লিং সিস্টেমে পরিবর্তন করা হচ্ছে।

জানা গেছে, চলতি বছরের শুরুতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা ও গ্যাস আমদানিতে ডলারের জোগান নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। সেই অনিশ্চয়তা কেটে উঠতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ এবং টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মিটিং করেন। ওই মিটিংয়ে জ্বালানির ঘাটতি মেটানোসহ জ্বালানি সংরক্ষণের জন্য জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি শুরু বিষয়ে আলোচনা হয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার কমানো কিংবা তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং তার উপরে রাখার বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। আমদানিকৃত/দেশে তৈরি ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের এনার্জি স্টার লেবেলিং কর্মসূচি চালুর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

সূত্র জানায়, কয়লা সংকটে ২৩ দিন বন্ধ থাকার পর পুনরায় রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন শুরু হয়েছে। গতকাল রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটে উৎপাদন শুরু হয়। এতে ২৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ শুরু করেছে। অন্যদিকে কয়লাভিত্তিক ৩০৭ মেগাওয়াট বরিশাল বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্য মতে, গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৩৯৩ কোটি ৩০ লাখ ইউনিট। চলতি অর্থবছর বিদ্যুতের সম্ভাব্য উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৯৪ কোটি ৮০ লাখ ইউনিট। এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে পিডিবি। অন্যদিকে আগামী অর্থবছর বিদ্যুতের সম্ভাব্য উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৭১৪ কোটি ২০ লাখ ইউনিট। এর মধ্যে গ্যাস থেকে উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৫৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। আর ফার্নেস থেকে ২.৫৪ শতাংশ, কয়লা থেকে ২৩.৫৮ শতাংশ ও ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ। এছাড়া ভারত থেকে আমদানি করা হবে (আদানিসহ) ১৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এতে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বাড়লেও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমবে।

বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা সংস্থা পাওয়ার সেলের ২০২১-২০২২ বার্ষিক প্রতিবেদন তথ্যে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলো বেশকিছু গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে। এছাড়া বিদেশি দাতা সংস্থার সহায়তায় যৌথ বিনিয়োগেও নির্মাণ পরিকল্পনা করা হয়েছে। আগামী ৫ বছরের মধ্যে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানির পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এগোতে হবে বিদ্যুৎ বিভাগকে। কারণ, আগামীতে আর সস্তায় জ্বালানি কেনা সম্ভব হবে না। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে পিডিবি’র মালিকানায় ১ হাজার ৫৭৫ মেগাওয়াট এবং বিপিডিবি ও মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি জিইর (জেনারেল ইলেকট্রিক) সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র ২০২৫ সাল থেকে শুরু করে ২০২৮ সাল নাগাদ উৎপাদনে আসবে।

পিডিবির গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনার মধ্যে হরিপুরে ২৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট, নরসিংদীর ঘোড়াশালে একই প্রযুক্তির ২২৫ মেগাওয়াট, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ৫৫০ মেগাওয়াট, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় ৫৫০ মেগাওয়াট। পিডিবির উদ্যোগে পরিকল্পনাধীন এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। গ্যাসভিত্তিক সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে নির্মাণ হচ্ছে। ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এলএনজিভিত্তিক দুটি বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে এরই মধ্যে মার্কিন কোম্পানি জিইর সঙ্গে সমঝোতা স্বাক্ষর করেছে সংস্থাটি। আগামী ২০২৭ ও ২০২৮ সালকে সম্ভাব্য উৎপাদন বছর ধরে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনায় স্বাক্ষর করেছে বিপিডিবি। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (সিপিজিসিএল) সঙ্গে জাপানের মিৎসুই অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড ৫৮৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে।

বিদ্যুতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, সারাদেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে বেশকিছু পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। ইতোমধ্যে কয়লাভিত্তিক কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। আগামীতে গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক আরো কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসছে। এখানে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাইরে অন্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো চ্যালেঞ্জিং। অন্য জ্বালানির তুলনায় গ্যাসই সহজলভ্য এবং তুলনামূলক সাশ্রয়ী। গ্যাস সংকট রয়েছে। তবে বিদ্যুৎ চাহিদা বিবেচনায় জ্বালানি আমদানি করেই আমাদের এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে।