ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

গ্যাস সংযোগ বন্ধ, নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি

ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে ডেভেলপার কোম্পানি

ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে ডেভেলপার কোম্পানি

গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় দেশজুড়ে আবাসন খাতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা থাকলেও পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক গ্যাস সংযোগ বন্ধে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না আবাসন খাত। নতুন করে যুক্ত হয়েছে নির্মাণসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি। এতে ফ্ল্যাটের খরচ ও বিক্রির বিরাট ফারাক নিয়ে সংকটের মধ্যে পড়েছে আবাসন ডেভেলপার কোম্পানিগুলো।

জানা গেছে, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি আবাসন খাতের সংশ্লিষ্টরা গ্যাস সংযোগ নিয়ে চরম বিড়ম্বনায় রয়েছেন। ২০২০ সালে পাইপলাইনের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে প্রাকৃতিক গ্যাস সংযোগ স্থায়ীভাবে বন্ধের ঘোষণা দেয় জ্বালানি বিভাগ। বাধ্য হয়ে আবাসন ব্যবসায়ীরা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলপিজি) দিকে ঝুঁকছেন। তবে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়ায় মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে ডেভেলপার কোম্পানিগুলোর জন্য।

এ নিয়ে আবাসন খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বহুতল ভবন নির্মাণে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয় ডেভেলপার কোম্পানিগুলো। ভবন নির্মাণের পরে ফ্ল্যাট বিক্রির অপেক্ষায় থাকেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু ধীরে ধীরে আবাসন খাতে সংকট বাড়ায় বিড়ম্বনায় পড়েছেন হাউজিং ব্যবসায়ীরা। দেশের আবাসন খাতের সংস্থাগুলো একটি বিষয় স্পষ্ট করেছে, কয়েক দশক ধরে আবাসন খাতটি মানুষের বাসস্থান সংকট দূর করতে সহায়তা করে আসছে। তবে আবাসনে গ্যাস সংযোগ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়ার অনেক আগেই এ নিয়ে আবাসন ব্যবসায়ীরা প্রশ্ন তুলেছেন। ফলে আবাসন খাতে ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে। গ্যাস সংযোগ বন্ধের এই সিদ্ধান্তে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের ফ্ল্যাটের মালিক এবং আবাসন কোম্পানিগুলো সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১২ সালের পর থেকেই আবাসন খাত অস্থিরতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। করোনা মহামারি এই খাতকে খাদের কিনারায় নিয়ে যায়। পরবর্তীতে পুনরায় আবাসন খাত ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু এবার নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে আসে নির্মাণসামগ্রীর উচ্চমূল্য। কারণ ফ্ল্যাটের দাম বাড়লেও ক্রেতাদের আয় তেমন বাড়েনি। ফলে আবাসন খাতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) সূত্র জানায়, বর্তমানে রিহ্যাব সদস্য সংখ্যা ৯৪০। এর মধ্যে সক্রিয় সদস্য সংখ্যা ৩৭৬। শতাংশের হিসেবে ৪০ ভাগ সদস্য সক্রিয়। অর্থাৎ অনেক সদস্য নীরবেই হারিয়ে যাচ্ছেন। রিহ্যাবের সদস্যদের প্রকল্প চলমান ১ হাজার ৫০৪টি। এর মধ্যে নির্মাণাধীন অ্যাপার্টমেন্টের সংখ্যা ৩০ হাজার ৮০টি। বর্তমান বিক্রয়যোগ্য অ্যাপার্টমেন্ট সংখ্যা ১৫ হাজার ৪০টি। ইতিমধ্যেই বিক্রি করা ইউনিট সংখ্যা ৯ হাজার ২৪টি। আর অবিক্রীত ইউনিট সংখ্যা রয়েছে ৬ হাজার ১৬টি। অর্থাৎ বিক্রিতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।

আবাসন ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে রডের দাম ছিল ৬০-৬৫ হাজার টাকা। এখন রড বিক্রি হচ্ছে ৯০-৯৫ হাজার টাকায়। সিমেন্টের দাম ছিল ৩২০-৩৩০ টাকা। এখন ৫০০ টাকা ছাড়িয়েছে। শুল্কসহ পাথরের দাম ছাড়িয়েছে দ্বিগুণ। এর সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য সামগ্রী রং, স্যানিটারি, আসবাবপত্র ও ইন্টেরিয়ার সরঞ্জামসহ সবকিছুর দামই বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। এই কারণে নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। যার প্রভাব ফ্ল্যাট বিক্রিতে পড়েছে।

সম্প্রতি সরকারের জারি করা একটি প্রজ্ঞাপনে দেখা গেছে, প্রথমশ্রেণির অধিক পোড়া বা ঝামা ইটের দাম ১০ টাকা থেকে ৩ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ টাকায়। আর অটোমেটিক মেশিনে তৈরি এক নম্বর গ্রেডের ইটের দাম ১১.৫ টাকা থেকে ৪.৫ টাকা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১৬ টাকায়। মানভেদে ইটের দাম ৩০% থেকে ৩৯% বাড়িয়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নির্মাণ কাজের শিডিউল অব রেট পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনের আওতায় ইট ছাড়াও প্রধান নির্মাণ উপকরণ সিমেন্টের দাম ২২% ও রডের দাম ২৮% পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এদিকে প্রতি বস্তা অর্ডিনারি পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের দাম খুচরা পর্যায়ে ৭০ টাকা ও বাল্ক সংগ্রহে ৮০ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ৪৯০ টাকা থেকে ১৪% বাড়িয়ে খুচরা সিমেন্টের দাম ধরা হয়েছে ৫৬০ টাকা। আর ৪৪০ টাকা থেকে বাড়িয়ে বাল্ক সংগ্রহে প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম ধরা হয়েছে ৫২০ টাকা। এ হিসাবে পাইকারি সিমেন্টের দাম বেড়েছে ১৮%। প্রতি বস্তা পোর্টল্যান্ড কম্পোজিট সিমেন্টের খুচরা দাম ৪৬০ টাকা থেকে ১৪% বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২৫ টাকায়। এ হিসাবে বস্তায় দাম বেড়েছে ৬৫ টাকা। আর বাল্ক সংগ্রহে একই মানের সিমেন্টের দাম ৪১০ টাকা থেকে ২২% বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০০ টাকায়। শতকরা হিসাবে দাম বেড়েছে ২২%।

রিহ্যাব সূত্র জানায়, ২০২০ সাল থেকে নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে প্রতি টন রডের দাম ছিল ৬৪ হাজার টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৯৫ হাজার টাকা। ২০২০ সালে প্রতি ব্যাগ সিমেন্টের (৫০ কেজি) দাম ছিল ৪০০ টাকা, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা। এ ছাড়া ২ বছরের ব্যবধানে প্রতি ঘনফুট বালুর দাম গড়ে ২৫ টাকা, প্রতি বর্গফুট পাথরের দাম ৮০ টাকা ও থাই অ্যালুমিনিয়ামের দাম ১৭০ টাকা ও শ্রমিকের খরচ ৮০ টাকা করে বেড়েছে। এ ছাড়া ইট, গ্রিল, স্যানিটেশন ও বৈদ্যুতিক কাজের খরচও বেড়েছে।

ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন দেখেছিলেন বেসরকারি কোম্পানির চাকরিজীবী কাওসার রহমান। তিনি বলেন, ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন নিয়ে অনেক ফ্ল্যাট দেখেছি। পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে গেছে। ফলে ফ্ল্যাট আর কিনতে পারিনি।

রিহ্যাবের সহ-সভাপতি কামাল মাহমুদ বলেন, উপকরণের দাম বাড়ায় ফ্ল্যাটের দামেও তার প্রভাব পড়েছে। নির্মাণ উপকরণের দাম বাড়লে ফ্ল্যাটের দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। ফলে মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে ফ্ল্যাট রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ৬ মাস আগে যে রডের দাম ছিল টনপ্রতি ৬৫ হাজার টাকা সেই রড এখন লাখের কাছাকাছি। ভবন নির্মাণের প্রধান উপকরণই হলো রড। নির্মাণ উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ডেভেলপাররা ফ্ল্যাটের দাম কমাতে পারছে না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত