গণপূর্ত অধিদপ্তর

চাকরি পেতে খরচ শুধু আবেদন ফি

প্রকাশ : ২১ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন গণপূর্ত অধিদপ্তর। এই অধিদপ্তর প্রায় দুইশ’ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে উপমহাদেশের স্থাপত্য কাঠামো নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ দ্বায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ কাজের সঙ্গে জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। ফলে সংস্থার জনবল নিয়োগে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষতার দিকে নজর দেয়া হয় বলে জানান গণপূর্ত অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, গণপূর্ত অধিদপ্তরের জাতীয় বেতন গ্রেড-১১ থেকে গ্রেড-১৬ পর্যন্ত (তৃতীয় শ্রেণির) ৮ ক্যাটাগরির ৪৫৩টি শূন্য পদে নিয়োগের জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র গ্রহণ করে ২০১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর দুটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আবেদন আহ্বান করা হয়েছিল। এতে স্টেনোগ্রাফার-কাম-কম্পিউটার অপারেটর, স্টেনোটাইপিস্ট-কাম-কম্পিউটার অপারেটর, সার্ভেয়ার, ড্রাফটসম্যান, অফিস সহকারী-কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক, হিসাব সহকারী এবং ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট পদ ছিল। ৮ ক্যাটাগরি পদের মধ্যে অফিস সহকারী-কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক, হিসাব সহকারী ও ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট- এ তিন ক্যাটাগরি পদে প্রায় ৬৮ হাজার আবেদন পাওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে এমসিকিউ পদ্ধতিতে ২০১৬ সালের ১৮ ও ১৯ নভেম্বর বাছাই পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। এমসিকিউ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া মোট আট ক্যাটাগরিতে ৮ হাজার ৯০ জন প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষা ২০২০ সালের ১৩ মার্চ গ্রহণ করা হয়। লিখিত পরীক্ষায় দুই হাজার ৪২৬ জন উত্তীর্ণ হয়।

পরবর্তীতে সংস্থার বিভাগীয় বাছাই, নিয়োগ ও পদোন্নতি কমিটির সদস্যদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে স্টেনোগ্রাফার-কাম-কম্পিউটার অপারেটর, স্টেনোটাইপিস্ট-কাম-কম্পিউটার অপারেটর এবং অফিস সহকারী-কাম-মুদ্রাক্ষরিকের ব্যবহারিক পরীক্ষা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল গ্রহণ করে। এরপর গত বছরের ৭ এপ্রিল ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এতে ৩৬৭ জন উপযুক্ত চাকরিপ্রার্থী নিয়োগ পায়।

জানা গেছে, শূন্য পদের বিপরীতে বিপুল সংখ্যক চাকরিপ্রত্যাশীদের নিয়োগ দিতে গিয়ে সমস্যার মুখোমুখি পড়েছিল গণপূর্ত অধিদপ্তরের ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ। কারণ মাস্টাররোল কর্মীরা শূন্য পদের এই নিয়োগের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছিল, সেজন্য নিয়োগ পরীক্ষা দেরি হয়েছিল। আবার ২০২০ সালে করোনা মহামারির পরীক্ষার তারিখ পিছিয়ে যায়। সবকিছু মোকাবিলা করে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে একসঙ্গে বিপুল সংখ্যক জনবল নিয়োগ দেয় গণপূর্ত অধিদপ্তর।

এ বিষয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হওয়ায় কিছু কুচক্রিমহল অপপ্রচার চালাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তবে এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বিন্দুমাত্র ত্রুটি নেই। গণপূর্তের ইতিহাস-ঐতিহ্য ধরে রাখতে মেধাসম্পন্ন যোগ্য লোককে নিয়োগ দেয়া হয়।

তিনি আরো বলেন, গণপূর্ত সরকারি সংস্থা ও আবাসন অবকাঠামো নির্মাণে দায়বদ্ধ। যুগোপযোগী প্রকৌশল প্রযুক্তির সর্বোত্তম প্রয়োগে টেকসই, পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ স্থাপনা নির্মাণে সুদক্ষ প্রকৌশলীরা পরিচালনা ও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করছেন। সেখানে জনবলের ঘাটতি থাকলে চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ঝিমিয়ে পড়বে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবীদের নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও শৃঙ্খলা ফেরাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সংস্থাপন শাখা। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অসন্তোষ, হতাশা এবং স্থবিরতা দূর করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয় এই সংস্থা থেকে। নিয়োগের ক্ষেত্রেও বয়সের ঊর্ধ্বসীমা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, চাকরির মেয়াদ ইত্যাদি মাপকাঠি নির্ধারণে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগ হতে জারিকৃত নির্দেশনাবলি অনুসরণ করে সংস্থাপন শাখা।

সরকারি প্রবিধানমালায় বলা হয়েছে, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক, সাঁটলিপিকার কাম-কম্পিউটার অপারেটর, গাড়িচালক ইত্যাদি ক্ষেত্রে কমন নিয়োগ বিধিমালা অনুসরণ করতে হবে। সেই বিধিমালা অনুসরণ করে গ্রেড ১১ থেকে ১৬ গ্রেড পর্যন্ত ৩৬৭ জনকে নিয়োগ দেয় গণপূর্ত অধিদপ্তর। সব নিয়ন-নীতি মেনে জনবল নিয়োগের পরও বঞ্চিতরা আদালতে মামলা করে। পরবর্তীতে সেই মামলা গণপূর্তের পক্ষে রায় এসেছে।

সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান/স্বশাসিত সংস্থাসমূহে প্রবিধানমালার ভিত্তিতে নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এরূপ প্রবিধানমালা প্রণয়ন/সংশোধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সর্বোচ্চ ৪টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। এ প্রক্রিয়ার ১ম ও ২য় ধাপ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়। দেখা গেছে, প্রবিধানমালা প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সময়ের সিংহভাগ ১ম ও ২য় ধাপে অতিবাহিত হয়। প্রবিধানমালা প্রণয়ন বিলম্বিত হলে নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রক্রিয়া অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বিলম্বিত হওয়ায় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ ও হতাশা পরিলক্ষিত হয় এবং প্রশাসনে স্থবিরতা দেখা দেয়। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রবিধানমালা প্রণয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে নজর রাখে প্রতিটি সংস্থাপন শাখা।

এসব বিষয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও সংস্থাপন শাখার প্রধান নন্দিতা রানী সাহা আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘গণপূর্ত অধিদপ্তরে ২০০৪-৬ সালে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে কিছু অযোগ্য লোক ঢুকে গেছে, যাদের দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত দুরূহ। সে কারণেই এবারের নিয়োগ প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হওয়া প্রয়োজন যাতে মেধাসম্পন্ন যোগ্য লোককে নিয়োগ দেয়া যায়।’

সংস্থাপনে দায়িত্ব পালনের সুবাদে অধিদপ্তরের ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা থেকে নিম্ন পদস্থ সবার সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে নন্দিতা রানী সাহার। তিনি বলেন, চাকরি শেষে অনেকে পেনশন পান। তবে পেনশনের টাকা পাওয়ার আগে কারো কারো বিরুদ্ধে ছোটখাটো অডিট আপত্তি রয়ে যায়। সেই অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি করতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয়।

নন্দিতা রানী সাহা আরো বলেন, ‘কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করি। সেই তদন্ত কমিটির পরামর্শে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সম্প্রতি গুরুত্বর অপরাধের দায়ে তিনজন প্রকৌশলীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মির্জা সাখাওয়াত হোসেনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী কেউ আইনশৃঙ্খলা সদস্যের হাতে গ্রেপ্তর হলে তার চকরি স্থগিত করতে বাধ্য। আর ছোটখাটো অপরাধের দায়ে বদলি কিংবা ভর্ৎসনা করা হয়।’

নিয়োগপ্রাপ্তরা বলছেন, কোনো ধরনের ঘুষ ছাড়াই চাকরির আবেদন ফি জমা দিয়ে নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি চাকরি পেয়েছেন তারা। গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী বলছেন, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জিরো টলারেন্স নীতি নেয়ার পাশাপাশি গণপূর্তের নাম ভাঙিয়ে যাতে কেউ কোনো দুর্নীতি করতে না পারে, সে বিষয়ে কঠোর ছিলেন তারা। স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার কারণে প্রকৃত মেধাবীরা চাকরি পেয়েছেন।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণপূর্ত অধিদপ্তরে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেয়া একজন চাকরিপ্রত্যাশী বলেন, চাকরির আবেদনের পর লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। লিখিত পরীক্ষার সময়ে পরীক্ষার কক্ষে দায়িত্বে থাকা স্যাররা যথেষ্ট কড়াকড়ি করেন। আমার পরীক্ষাও ভালো হয়েছিল, ফল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। পরে ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হয়। মৌখিক পরীক্ষার শুরুর আগে সব প্রার্থীর উদ্দেশ্যে বলা হয়েছিল, নিয়োগ পরীক্ষা হবে শতভাগ মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে, কারো প্রতি অবিচার করা হবে না, তদবিরের কারণে কাউকে বিন্দু পরিমাণ অন্যায় সুবিধা দেয়া হবে না। পরীক্ষা শেষে যখন আমার চাকরি হয়, তখনই বুঝতে পেরেছি- গণপূর্ত অধিদপ্তরে চাকরি নিতে কোনো ঘুষ ও তদবিরের প্রয়োজন হয় না।