বন্ধে নেই প্রশাসনিক তৎপরতা

ব্রহ্মপুত্রের বুক চিরে লুট হচ্ছে বালু

প্রকাশ : ২১ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ময়মনসিংহ ব্যুরো

ময়মনসিংহের তথা বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী ব্রহ্মপুত্র নদ। এটি লৌহিত্য নামেও পরিচিত। সেই ব্রহ্মপুত্র নদের বিভিন্ন অংশে অবৈধ ড্রেজার বসিয়ে লুট হচ্ছে বালু। লুটের মহা প্রলয় চললেও প্রশাসনিক তৎপরতা নেই। কালেভদ্রে প্রশাসনের অভিযান চললেও তাও সুফল মিলছে না। সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে বালু লুটের কারণে ব্রহ্মপুত্রের তলদেশ থেকে মাটি সরে গিয়ে নদের দুই পাড়ে সরকারি-বেসরকারি স্থাপনাসহ হুমকির মুখে পড়েছে বসতবাড়ি, ফসলিজমি, রাস্তাঘাট ও ব্রহ্মপুত্র সেতু। অপরদিকে ব্রহ্মপুত্র নদ তার নাব্য হারিয়ে এখন মৃত্যুর প্রহর গুনছে। সেই সাথে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে জীববৈচিত্র্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে পরিবেশবাদীদের অভিমত।

বালু লুটকে ঘিরে একেক সময় গড়ে উঠেছে একাধিক সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের নেপথ্যে ও প্রকাশ্যে শেল্টার দিয়ে এই লুটতরাজকে জায়েজ করছে রথী-মহারথীরা। সরাসরি বালু লুটের সাথে জড়িত রয়েছেন কাউন্সিলর, ছোট-বড় নেতাসহ নানা বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লুটেরা। লুটের টাকা মাছের ভাগার মতো স্তরভেদে চলে যায় তাদের পকেটে। সিন্ডিকেটটি সরকারের রাজস্ব খাতকে শুভংকরের ফাঁকিতে ফেলে প্রশাসনের নাকের ডগায় সরকারি বালু মহালগুলো থেকে মাসে কয়েক কোটি টাকার বালু লোপাট করে আসলেও নির্বিকার রয়েছে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা।

ব্রহ্মপুত্রের তীর ঘেঁষে নগরীর কাঠগোলা, খাগডহর, জেলখানা রোড, ঘুন্টি কিসমত, শম্ভুগঞ্জ, গোদারার ঘাট ঘুরে দেখা যায়, কিসমত কল্যাণপুর এলাকায় ড্রেজার সাজু, সাইদ, সুজন, আসাদ, রুমানসহ অনেকেই ব্রহ্মপুত্র থেকে শুরু করে সদর উপজেলার বেগুনবাড়ি পর্যন্ত ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করছে। একইভাবে সদর উপজেলার তারাগাই, কল্যালপুর, বেগুনবাড়ি ও চর ইশ্বরদিয়া, সিটিকরপোরেশনের ৩২ নং ওয়ার্ডের দক্ষিণপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের সন্নিকটে একটি চক্র নদের বুক হতে ভেকু মেশিনের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করছে।

বালুর খনি খ্যাত ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে উত্তোলিত বালু প্রতিদিন ট্রাক, মাহেন্দ্র ও ট্রাক্টরযোগে যাচ্ছে জেলার সর্বত্র। আর স্পটগুলোর আশপাশে বিক্রির অপেক্ষায় রয়েছে সারি সারি অবৈধ বালুর ঢিবি। প্রকাশ্যে এসব ঢিবি থেকে বালু বিক্রি হলেও দেখার কেউ নেই।

স্থানীয় কাঠগোলা এলাকার আ. জলিল ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, ড্রেজারে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর তীর ঘেঁষে স্থাপনাগুলো নদী গর্ভে চলে যাচ্ছে। প্রশাসনের লোকজন কালভাদ্রে এসে কিছু জরিমানা করে চলে যায়। পরে চক্রটি পুনরায় শুরু করে বালু উত্তোলন উৎসব।

একইভাবে শামীম, হিরা, সাব্বির জানান, ড্রেজারের বালু পরিবহনের কারণে এলাকার কোনো মানুষ ধুলা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। আর রাস্তাগুলো গর্তে পরিণত হয়েছে। এ বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ হয় কি না প্রশ্ন করলে বলেন, প্রতিবাদ করলে মারতে আসে, প্রশাসনিক অভিযান নাম মাত্র, বালু উত্তোলন সাময়িক বন্ধ থাকলেও অসাধু কর্তাব্যক্তিদের ম্যানেজ করে ফের শুরু হয় বালু উত্তোলন। এসব বিষয়ে কথা কাঠগোলা এলাকার ড্রেজার ব্যবসায়ী আসাদের সঙ্গে তিনি জানান, বালু তোলার অপরাধে মাঝে মাঝে জরিমানা ও জেল পর্যন্ত খেটেছি।

এদিকে ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র নদ খনন নিয়েও বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। এ কর্মসূচির মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র নদ খননের নামে যে প্রহসন চলছে তার প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। তাদের দাবি, ২০১৯ সালে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা সরকারি বরাদ্দে ব্রহ্মপুত্র খনন প্রকল্প শুরু হয়। প্রথমে খনন করা হয় নগরের কাচারীঘাট এলাকায়। এর পরের বছর থেকে শুষ্ক মৌসুমে চর জাগছে নদে। অথচ খননের আগেও কখনো এমন চর দেখা যায়নি। ব্রহ্মপুত্রে কখনো এত কম পানি ছিল না। এখানে খননের নামে একটি মহল বালু সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। আসলে ব্রহ্মপুত্র নদকে মেরে ফেলা হচ্ছে। খনন করে বালু নদের পাড়ে রাখার কারণে সেসব এলাকা অবৈধ দখলদারদের কবলে চলে যাচ্ছে। যে কারণে ব্রহ্মপুত্র নদ এখন মরে গেছে।

জেলা প্রশাসক কার্যালয় সুত্রে জানা যায় ব্রহ্মপুত্র নদে নাব্য ফিরিয়ে আনতে ২০১৯ সালের শেষের দিকে শুরু হয় খননকাজ। প্রায় ২ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নদের ২২৭ কিলোমিটার খনন করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইড্রব্লিউটিএ)। ‘পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের নাব্য উন্নয়নে ড্রেজিং’ শীর্ষক প্রকল্পটি আগামী ২০২৪ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এর বাইরে বালু উত্তোলনের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে কাউকে ইজারা দেয়া হয়নি। অবৈধ ড্রেজার মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)পারভেজুর রহমান বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ড্রেজার মেশিন বন্ধে যথেষ্ট হিমশিম খাচ্ছি। ড্রেজার মালিকগণ প্রশাসনের অভিযানের সংবাদ পেয়ে সব গুটিয়ে নিয়ে পুনরায় পূর্বের মতো তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। এখন আমার বদলীর আদেশ হয়েছে তাই এ বিষয়ে রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর রাজস্ব (আরডিসি) সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।

এ বিষয়ে ময়মনসিংহ সদরের ইউএনও শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা নিয়মিত অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছি। অভিযানের কিছুটা ধীরগতির সত্যতা স্বীকার করে আরও বলেন, অবৈধ বালু উত্তোলনের একমাত্র পথ হতে পারে বালু মহালগুলো পুনরায় চালু করা। প্রশাসনের এখানে ন্যূনতম দুর্বলতা কেউ প্রমাণ করতে পারবে না।

রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে ড্রেজার মেশিনে বালু উত্তোলনের বিষয়ে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাফিজার রহমান বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক খননকৃত ৩৩টি স্পটের বালুর মধ্য ২৫টি স্পটের বালু ইজারা দেয়া হয়েছে। অবশিষ্ট উত্তোলনকৃত বালুর মধ্যে ৩টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অবশিষ্টগুলো এখনও ইজারা দেয়া হয়নি। ড্রেজার মেশিনে নদী হতে বালু উত্তোলন সম্পূর্ণ নিষেধ। এ বিষয়ে ময়মনসিংহ সদরের ইউএনওকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি ওইসব স্থানে কয়েকটি ড্রেজার মেশিনে উত্তোলিত বালু জব্দ করে তা নিলামে বিক্রি করা হয়। যদি কেউ বালু উত্তোলন করতেই থাকে প্রয়োজনে প্রশাসন সেখানে শক্তি প্রয়োগ করবে।