ভূমিসেবা সপ্তাহ শুরু

এক ক্লিকেই বিরোধ নিষ্পত্তি

প্রকাশ : ২২ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

সারা দেশে ভূমি নিয়ে শত বছর ধরে মানুষের বিরোধ চলছে। সেই বিরোধ নিরসনে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ভূমি মন্ত্রণালয়। এরইমধ্যে অনলাইনভিত্তিক ভূমিসেবা চালু করা হয়েছে। এতে এক ক্লিকেই ভূমির বিরোধ নিষ্পত্তি হয়ে যাচ্ছে।

ভূমি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা জানান, স্মার্ট ভূমিসেবা নিশ্চিত করতে আজ থেকে ২৮ মে পর্যন্ত ভূমিসেবা সপ্তাহ পালন করা হবে। মানুষের ভোগান্তি দূর করে সহজেই ভূমিসেবা পেতে মাঠ পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়মিত আলোচনা সভা হয়। তিন মাস পরপর মন্ত্রণালয় ও বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে পর্যালোচনা সভা হয়। গতকাল রোববার ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. খলিলুর রহমান ও বিভাগীয় কমিশনারদের সঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা সভা হয়েছে। এই সভায় ভূমিসেবা সপ্তাহের বিষয়ে আলোচনা হয়।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব প্রদীপ কুমার দাস আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, মানুষের জমিজমার বিরোধ সমাধানে স্মার্ট ভূমিসেবা ঘোষণা করা হয়েছে। এই লক্ষ্যে সারা দেশে ভূমি সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রম অনলাইনে সম্পন্ন করা হচ্ছে। অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর বা খাজনা আদায় করা হয়। ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনতে নিয়মিত মাঠপর্যায়ে কাজ করা হচ্ছে। তবে জনবল সংকট থাকায় মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয়। পিএসসির (বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন) মাধ্যমে নন-ক্যাডার তহসিলদার (ভূমি সহকারী কর্মকর্তা) নিয়োগ দেয়া হলে সমস্যার সমাধান হতে পারে।

প্রদীপ কুমার দাস আরো বলেন, ভূমি সম্পর্কিত যেসব সমস্যা রয়েছে, পুরোপুরি সমাধানের চেষ্টা চলছে। এতে মানুষের ভোগান্তি দূর হবে। মাঠ জরিপ করতে গিয়ে দেখা যায়- গ্রামের মানুষ শহরে বসবাস করছেন, জরিপ করতে গিয়ে ভূমির মালিকদের খুঁজে পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে ভূমি জরিপে কিছুটা হেরফের হতে পারে, তবে ভূমির মালিক আবেদন করলে সহজেই সমাধান হয়ে যাচ্ছে।

মানুষ তার চাকরি জীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে একখণ্ড জমি কিনেন, যাতে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তার মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়। কিন্তু জমি কিনেই ঝামেলায় পড়েন অনেকে। কেউ আবার জমি কিনে হয়েছেন সর্বশান্ত। মূলত জমি সংক্রান্ত অসতর্কতার কারণেই মানুষকে এই ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। তাই জমি কেনার আগে রেকর্ড, খতিয়ান ও নকশা যাচাই করা দরকার। এছাড়াও জমির মৌজা, দাগ নম্বর এবং দাগে জমির মোট পরিমাণ নিয়ে প্রতারণা ও ভোগান্তি দূর করতে ভূমি উন্নয়ন কর, ই-নামজারি, ভূমিবিষয়ক পরামর্শ, খতিয়ান (পর্চা), জমির ম্যাপ ডিজিটালাইজেশন করার কাজ করছে ভূমি মন্ত্রণালয়।

সূত্রে জানা গেছে, শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সর্বত্র জমি নিয়ে বিরোধ রয়েছে মানুষের। আত্মীয়-স্বজন থেকে পাড়াপ্রতিবেশীদের মাঝে জমির বিরোধ নিয়ে মামলা হচ্ছে এবং যুগ যুগ ধরে চলছে। কিন্তু ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা-ম্যাপ ও খতিয়ান তৈরি হলে দ্রুত সমস্যার সমাধান হবে। জমির ডিজিটাল ম্যাপ এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে নির্দিষ্ট জমির সীমানা, পরিমাণ, চৌহদ্দি এবং ওই জমির অতীত-বর্তমান সব তথ্য পাওয়া যাবে।

মাঠপর্যায়ে আধুনিক ভূমি ব্যবস্থাপনা প্রকল্প সম্পন্ন হতে চলেছে। ২০২৬ সালের গৃহীত ও পরিকল্পিত সব প্রকল্পের পূর্ণ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে ভূমি মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে ই-নামজারি সিস্টেম, নাগরিকদের অনলাইনে দাখিলা প্রদানসহ দেশের ১ লাখ ৩৮ হাজার ম্যাপকে ডিজিটালাইজ করাসহ স্যাটেলাইট ইমেজ ক্রয় করা হচ্ছে। এই ম্যাপের ওপর স্যাটেলাইট ইমেজ বসিয়ে প্লটভিত্তিক জমির শ্রেণির একটি তথ্যভাণ্ডারও তৈরি করা হচ্ছে। ২০২৩ সালের মার্চ নাগাদ ২০ হাজার ডিজিটাল মৌজা ম্যাপ ই-নামজারি সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে। গত মার্চে ২০ হাজার ডিজিটাল মৌজা ম্যাপ ই-নামজারি সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। নামজারির সঙ্গে-সঙ্গে এই ডিজিটাল ম্যাপ ও খতিয়ান স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশোধিত হতে থাকবে। একই খতিয়ানের মধ্যে বহুমুখী দাগ শেয়ার করা তথা হাতের লেখা খতিয়ান প্রথার অ্যানালগ পদ্ধতির উত্তরণ ঘটিয়ে ড্রোন দিয়ে ডিজিটাল জরিপের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এটি বাস্তবায়নে ভূমি নিয়ে মামলা ও সীমানা বিরোধ কমে যাবে। এনআইডি দিয়েই যেন পাওয়া যায় জমির সব তথ্য- এই ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা আছে ভূমি মন্ত্রণালয়ের। দ্রুত সারা দেশে বাংলাদেশ ডিজিটাল জরিপ (বিডিএস) বাস্তবায়ন করা। যেসব জায়গায় একবার এই ডিজিটাল জরিপ সম্পন্ন হবে, সেখানে ভবিষ্যতে আর জরিপ করার প্রয়োজন পড়বে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায় ই-নামজারি ব্যবস্থায় বর্তমানে মাসে অনলাইনে দুই লাখের বেশি নামজারি নিষ্পত্তি হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৯০ লাখ নামজারি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে। নামজারি সিস্টেম থেকে অনলাইনে আদায়কৃত প্রায় ১৬২ কোটি টাকা তাৎক্ষণিকভাবে সরকারের কোষাগারে জমা হয়েছে। অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর আদায় যা তাৎক্ষণিকভাবে অটোমেটেড চালান সিস্টেমের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে। ডাক বিভাগ এখন নাগরিকের ঠিকানায় খতিয়ান পৌঁছে দিচ্ছে। ১৬১২২ নম্বরে ফোন করে বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে যে কোনো সময় (২৪/৭) যে কোনো নাগরিক এখন ভূমি অফিসে না এসেই নামজারি, ভূমি উন্নয়ন কর এবং খতিয়ান সেবা গ্রহণ করতে পারছেন। অনলাইন ব্যবস্থার কারণে ১৬৯৯টি জলমহাল কম ইজারা দিয়েও সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২-এর জুন মাস পর্যন্ত হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী দেশে মোট কৃষি খাস জমি ১৭ লাখ ৩৫ হাজার ৯১৫ একর, এরমধ্যে বন্দোবস্তযোগ্য ৪ লাখ ৬০ হাজার ১৬৪ একর। মোট অকৃষি খাস জমি ২২ লাখ ৫০ হাজার ১৭০ একর, যার মধ্যে বন্দোবস্তযোগ্য ১ লাখ ১৫ হাজার ৭৬৩ একর।

অধিগৃহীত জমির সর্বোচ্চ এবং যথাযথ ব্যবহার করা হলে এবং দুই ফসলি ও তিন ফসলি জমি অধিগ্রহণের আওতাবহির্ভূত রাখা হলে কৃষি জমি সংক্ষণের ব্যবস্থাসহ খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা মজবুত করা সম্ভব হবে। দেশের বা বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে মামলার যে কোনো পক্ষ ভূমি রাজস্ব মামলায় যাতে অনলাইন শুনানিতে অংশ নিতে পারেন, সেই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এতে ভূমি রাজস্ব বিষয়ে সেবাপ্রত্যাশী জনগণ উপকৃত হচ্ছেন। ভূমি মন্ত্রণালয়ের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হলো সিভিল স্যুট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দেওয়ানি মামলা ও ভূমি রাজস্ব মামলাগুলো দ্রুত, স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সেবা নিশ্চিত করাই এর মূল লক্ষ্য। বেশ কিছু পুরোনো আইন সংস্কার করে যুগোপযোগী করা এবং কয়েকটি নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যে হলো, ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩ এবং ভূমির মালিকানা ও ব্যবহার আইন, ২০২৩।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতায় তিনটি জরিপবিষয়ক প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর মধ্যে মৌজা ও প্লটভিত্তিক ডিজিটাল ভূমি জোনিং প্রকল্প সরাসরি ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি দক্ষ ব্যবহার। ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের আওতায় ‘এস্টাব্লিশমেন্ট অব ডিজিটাল ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন, ধামরাই ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলা এবং মানিকগঞ্জ পৌরসভায় ডিজিটাল ল্যান্ড সার্ভে করা হবে। এ প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে ম্যাপ ও রেকর্ডের ইন্টিগ্রেশন হবে। এ প্রকল্পে ডিজিটাল ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সফটওয়্যার প্রস্তুত করা হবে। সব ডাটা ক্লাউড বেজ সার্ভারে সংরক্ষণ করা হবে। ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের ডিজিটাল জরিপ পরিচালনার সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের আওতায় পটুয়াখালী, বরগুনা, সিরাজগঞ্জ, পাবনা জেলা এবং গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া ও কোটালিপাড়াসহ ৩২টি উপজেলায় ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।