ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর

এক সময়ের স্বপ্ন এখন বাস্তবতা

এক সময়ের স্বপ্ন এখন বাস্তবতা

মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের কারণে বদলে যাচ্ছে দেশের আমদানি-রপ্তানির চিত্র। এক সময় যে বন্দর ছিল স্বপ্ন এখন তা বাস্তবতা। পরিকল্পিত এই বন্দরে একের পর এক ভিড়ছে বড় জাহাজ। গত শুক্রবার এই বন্দরে ৬৫ হাজার টনেরও বেশি কয়লা নিয়ে জাহাজ বার্থিং নিয়েছে। এর আগে আরো একটি ৬৫ হাজার টন ধারণক্ষমতার জাহাজ ভিড়েছিল। ৮০ হাজার টন কয়লাবাহী একটি জাহাজ দুয়েক দিনের মধ্যে গভীর সমুদ্রবন্দরে ভিড়বে। চলতি মাসেই রেকর্ড এক লাখ টন কয়লাবাহী জাহাজ ভেড়ার শিডিউল রয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, গভীর সমুদ্র বন্দর দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই বন্দর পুরোদমে চালু হলে দ্রুত পাল্টাবে আমদানি রপ্তানির চিত্র। দেশের ব্যবসায়ীরাও এই বন্দরের সুফল ভোগ করবেন। বন্দরের সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় শিপিং বাণিজ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

২০০৯ সালে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। শুরুর দিকে বন্দরের স্থান ছিল ভিন্ন জায়গায়। প্রথম জায়গা ছিল কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপ। এরপর আসে পটুয়াখালীর পায়রা। নানাভাবে যাচাই-বাছাই শেষে সিদ্ধান্ত হয় সোনাদিয়া বা পায়রার পরিবর্তে কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপের মাতারবাড়ীতেই হবে গভীর সমুদ্রবন্দর। সমীক্ষায় পায়রায় গভীর সমদ্র্রবন্দর নির্মাণের নানা সঙ্কটের বিষয় উঠে আসে। তাই মাতারবাড়ীই বন্দরের জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে চূড়ান্ত হয়। ২০২০ সালের মার্চে গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। এরপর সেখানে টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু হয়। সেই গভীর সমুদ্রবন্দর এখন বাস্তবতা। এখন স্বপ্নের সেই বন্দরে ভিড়ছে জাহাজ।

নানা কারণে দেশে গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। পণ্য আমদানিতে খরচ বেশি পড়ছে। বাড়তি ব্যয় যোগ হচ্ছে পণ্যের দামে। এ ছাড়া বিনিয়োগেও পিছিয়ে থাকতে হচ্ছে। পণ্য বাণিজ্যে পরিবহন ও বন্দরসুবিধা নিয়ে ২০১৮ সালে করা বিশ্বব্যাংকের ‘লজিস্টিকস পারফরম্যান্স ইনডেক্সে’ ১৬০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০০তম। যা ছিল ২০১৬ সালের অবস্থানের চেয়ে ১৩ ধাপ পেছনে। এই সূচকে ভিয়েতনামের অবস্থান ৩৯তম, ভারতের ৪৪তম। এছাড়াও চট্টগ্রাম বন্দরে নানা কারণে বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। অন্তত প্রত্যাশিত ড্রাফটের সমান জাহাজ ভেড়াতে হলে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের বিকল্প ছিল না। চট্টগ্রাম বন্দরের সূচনা হয় ১৮৮৭ সালে। এই বন্দরের গভীরতা পাওয়া যায় সাড়ে ৯ মিটারের মতো। সাম্প্রতিক সময়ে তা সাড়ে ৯ মিটার থেকে ১০ মিটারে উন্নীত হয়েছে। তবে তা প্রত্যাশিত না। বড় জাহাজগুলোর ড্রাফট ১৪ মিটারে বেশি। এজন্য এসব জাহাজ এখনো বন্দর বহির্নোঙরে নোঙর করে অন্তত অর্ধেক পণ্য খালাস করে। জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের পর ড্রাফট কমে যায়। এরপর তা ভেড়ানো হয় চট্টগ্রামবন্দর জেটিতে। এতে পণ্য খালাসে সময় ও ব্যয় দুটিই বেড়ে যায়।

গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ উদ্যোগের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। ১৯৭৮ সালে নেদারল্যান্ডস ইকনোমিক ইনস্টিটিউট নামের একটি সংস্থা ১১টি স্থান পরিদর্শন করে কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে গভীর পানির টার্মিনাল নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার সুপারিশ করেছিল। পরে সেই উদ্যোগ আর আলোর মুখ দেখেনি। এরপর বিভিন্ন সরকারের আমলে গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রসঙ্গটি আলোচনায় আসে। কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয় ২০০৯ সালে। ওই বছর জাপানের প্যাসিফিক কনসালট্যান্ট ইন্টারন্যাশনাল নয়টি সম্ভাব্য এলাকা পরিদর্শন করে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সুপারিশ করে সমীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেয়। ২০১২ সালে সরকার সোনাদিয়া দ্বীপে গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রকল্প অনুমোদন দেয়। ২০১৬ সালে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার সময় ধরা হয়। অর্থায়ন করার আলোচনা চলছিল চীনের সঙ্গে। ২০১৪ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরে যান। কথা ছিল সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে সমঝোতায় সই হবে। কিন্তু সেই নির্ধারিত সমঝোতা স্মারক সই হয়নি। সোনাদিয়ায় অনিশ্চয়তার মধ্যেই পটুয়াখালীর পায়রায় সরকার গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ঘোষণা দেয়। তবে তখনো সমীক্ষা হয়নি। পরে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এইচআর ওয়েলিংফোর্ডকে দিয়ে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করানো হয়। এরপর ১ হাজার ৮৩৪ কোটি ডলার বা প্রায় ১ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা (ওই সময় প্রতি ডলার ৮৪ টাকা হিসাব করে) খরচ ধরে প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন করা হয়।

২০১৮ সালে পায়রায় প্রথম টার্মিনাল নির্মাণের ঘোষণা দেন সে সময়ের নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তবে বিশেষজ্ঞরা নির্মাণ এবং নদীর পলি অপসারণে বিপুল ব্যয়ের কারণে এ প্রকল্প নিয়ে আগ্রহী ছিল না। পরে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে ঘোষণা দেয়া হয় পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর হচ্ছে না। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে ‘বিগ বি’ উদ্যোগের ঘোষণা দেন। এর বাস্তব রূপ দিতে দেশটির উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ২০১৬ সালে একটি জরিপ করে মাতারবাড়ীতে বন্দর নির্মাণের পরামর্শ দেয়। এরপর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ হাতে নেয়। এটিই এখন বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তত্ত্ববধানে মাতারবাড়ীতে বন্দর উন্নয়নের কার্যক্রম শুরু করা হয়। এরইমধ্যে মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের কার্যক্রম প্রায় শেষের পথে। কয়লা খালাসের জন্য আড়াইশ’ মিটার প্রস্থ এবং ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল তৈরি করা হয়েছে। তার পাশে আরো একশ’ মিটার বাড়িয়ে এটিকে পরিণত করা হয় গভীর সমুদ্রবন্দরে। এখানে অনায়াসে ১৪ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ানো সম্ভব হবে। ইতোপূর্বে এই বন্দরে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল নিয়ে শতাধিক জাহাজ ভিড়েছে। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্টের বাইরে গত ২৪ এপ্রিল কয়লার একটি বিশাল চালান নিয়ে প্রথম জাহাজ নোঙর করে মাতারবাড়ীতে। ইন্দোনেশিয়া থেকে ৬৩ হাজার টন কয়লা নিয়ে আসা ২২৯ মিটার দীর্ঘ ও ১২ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের পানির নিচের গভীরতা) পানামার পতাকাবাহী এমভি ‘অউসো মারো’ জাহাজটিকে পরদিন ২৫ এপ্রিল বিকালে মাতারবাড়ী জেটিতে বার্থিং দেয়া হয়। দেশের ইতিহাসে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় জাহাজ। জাহাজটি সফলভাবে কয়লা খালাস করে গত ৭ মে সকালে মাতারবাড়ী ত্যাগ করেছে। ওই জাহাজের ধারাবাহিকতায় গত শুক্রবার ৬৫ হাজার ২৫০ টন কয়লা নিয়ে অপর একটি বড় জাহাজ আসে মাতারবাড়ীতে। এমভি এনডেয়াভোর নামের জাহাজটিকে শুক্রবার দুপুরে বার্থিং দেয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক জানান, গভীর সমুদ্রবন্দরের কারণে দেশের অর্থনীতি আরো গতিশীল হবে। এখন বেশি ড্রাফটের বড় জাহাজ ভেড়া শুরু হয়েছে। বৃহদাকার জাহাজ ভেড়া অব্যাহত থাকবে। সম্প্রতি ভেড়া এমভি এনডেয়াভোর জাহাজটি ২২৮ দশমিক ৯৯ মিটার লম্বা। এটির ড্রাফট ১২ দশমিক ৫ মিটার। এই জাহাজ ভেড়ার মাধ্যমে মাতারবাড়ী বন্দরের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত