দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি

সিন্ডিকেটের থাবা থেকে রেহাই পাচ্ছে না মানুষ

প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

সারা দেশে নিত্যপণ্যের দাম হুহু করে বাড়ছে। কোনোভাবেই পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এতে জীবিকানির্বাহে কষ্টে পড়েছেন নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ।

পণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, ফড়িয়াদের কারসাজি কিংবা সিন্ডিকেটের কারণে পণ্য উৎপাদনকারী বা কৃষক কম দামে পণ্য বিক্রি করছে। এতে কৃষক পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেলেও ভোক্তাদের পকেট কাটছে সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেট করে, বাজারে কৃত্রিম পণ্য সংকট সৃষ্টি করে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করার সুযোগ বাড়ছে। এই কৃত্রিম সংকট নিরসনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বেশকিছু উদ্যোগ নিলেও কাজে আসছে না।

দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন পর্যাপ্ত হয়েছে। কিন্তু বেশি মুনাফার আশায় পেঁয়াজ মজুত রেখে সংকট তৈরি করে বাজারকে অস্থিতিশীল করা হয়েছে। এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি মোকাবিলায় পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি (আইপি) দিতে কৃষি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে পণ্যের দাম কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। নিয়ন্ত্রণের কার্যকর প্রচেষ্টাও কম। হঠাৎ হঠাৎ কোনো একটি বা একাধিক পণ্যের দাম অযৌক্তিকভাবে বেড়ে যায়। বাজার ব্যবস্থায় খুচরা ও পাইকারি বাজারের মধ্যে পণ্যের দামের পার্থক্য থাকে অনেক বেশি।

সবজির পাশাপাশি দেশে চিনির বাজারে অস্থিরতার জন্য ‘সরবরাহব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা’কে দায়ী করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। সংস্থাটি বলছে, চিনিকলগুলো তাদের সক্ষমতার চেয়ে বেশি সরবরাহের আদেশ নেয়ায় বাজারে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কারণ, সাপ্লাই অর্ডার বা সরবরাহ আদেশ (এসও) হাতবদলের সুযোগ থাকায় অতি মুনাফার জন্য বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়।

ট্যারিফ কমিশন সম্প্রতি চিনির বাজারের অস্থিরতা নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে। এতে চিনির সরবরাহ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলাসহ নানা বিষয় তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে পরিশোধিত চিনির সরবরাহ ব্যবস্থা আরও কার্যকর করতে বলা হয়েছে। সংস্থাটির মতে, পরিশোধন মিল থেকে চিনি সরবরাহে বিশৃঙ্খলার ফলে সৃষ্ট সমস্যা বাজারে চিনির মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া দেশে চিনি পরিশোধনাগার কম থাকার কারণেও বাজারে ‘সিন্ডিকেট’ হওয়ার সুযোগ রয়েছে।

প্রতিবেদনে বিটিটিসি বলেছে, চিনিকল থেকে এসওর (সরবরাহ আদেশ) মেয়াদ ১৫ দিন উল্লেখ করা হলেও তা অনেক ক্ষেত্রে তিন থেকে চার মাস পর্যন্ত থেকে যাচ্ছে। ফলে ভিন্ন ভিন্ন মূল্যের এসও বাজারে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। এ ছাড়া মিল থেকে উৎপাদন সক্ষমতার বেশি এসও দেয়া হয়। আবার এসও হাতবদলের সুযোগ রয়েছে। এতে অতি মুনাফার জন্য কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি হয়, আর সেটি বাজারে সমস্যার সৃষ্টি করে।

খাদ্যপণ্যের মূল্যের বাড়তি চাপ ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজারে সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা যায়, চাল, ডাল, তেল, আটা, ময়দা, চিনি ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য গত সপ্তাহের তুলনায় বেড়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কাছ থেকে পাওয়া তথ্য থেকেও একই চিত্র দেখা গেছে।

গত সপ্তাহে সরু চালের (নাজিরশাইল) কেজি ৬৭-৭৯ টাকা, মাঝারি মানের চালের (পাইজাম) কেজি ৫৪-৫৮ টাকা, মোটা চালের (স্বর্ণা) কেজি ৫০-৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চালের দাম প্রতি কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে বলে বেশ কয়েকজন খুচরা বিক্রেতা জানান।

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আবু তাহের জানান, সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্যের স্ফীতির কারণে দৈনন্দিন খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ফলশ্রুতিতে তিনি পারিবারিক অন্যান্য খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছেন। এভাবে যদি দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকে, তাহলে পরিবার নিয়ে ঢাকা শহরে বাস করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

পল্টন এলাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন ফরিদ প্রধান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, জীবনযাপনের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। আগামীতে এর প্রভাব আরও ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা করছি। কারণ বাংলাদেশে একবার কোনো পণ্যের দাম বাড়লে তা সাধারণত আর কমে না।

মিরপুরের দোয়ারিপাড়া বাজারের ব্যবসায়ী আবুল হোসেন জানান, পাইকারি বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বেড়েছে। জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় আমরা সরকারের নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি করতে পারছি না।

কারওয়ান বাজার কাঁচাবাজারের গত ১ মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য ৫ থেকে ৯ শতাংশ বেড়েছে। কিছু কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে মূল্য বৃদ্ধির হার আরও বেশি বলে যোগ করেন কারওয়ান বাজারের ভাই-ভাই দোকানের মালিক জাহিদ সরকার।

তবে গত রোববার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, বাজারে ভোক্তা পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম বাড়ায় আমদানি করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। আমাদের দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু বেশি মুনাফা লাভের আশায় অনেকে পেঁয়াজ মজুত রেখে সংকট তৈরি করে বাজারকে অস্থিতিশীল করছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ভোক্তা পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম কয়েকদিনের ব্যবধানে বেড়েছে। বর্তমান বাজার বিবেচনায় আমরা পেঁয়াজ আমদানির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি।

ইমপোর্ট পারমিট বা আইপি যেহেতু কৃষি মন্ত্রণালয় দিয়ে থাকে তাই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। বাজার পর্যবেক্ষণ করে তারা এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে বলে আমাদের জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, দেশের কৃষকরা যাতে পেঁয়াজের ন্যায্যমূল্য পান সে জন্য মূলত ইমপোর্ট পারমিট বন্ধ রাখা হয়েছে। এখন যেহেতু ভোক্তাদের বাজারে পেঁয়াজ কিনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাই আমদানি করা ছাড়া উপায় নেই বলেও জানান তিনি। আমদানির পর বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন বাণিজ্যমন্ত্রী।

বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের দিয়ে বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। নির্ধারিত দামে বাজারে চিনি বিক্রি করছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করে মনিটরিং করা হচ্ছে।

এক মাস আগে বাজারে যে চীনা আদার কেজি ছিল ২২০ টাকা, তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকায়। চীনা আদা বাদেও ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করা আদার দামও বেড়েছে কেজিতে ১০০ টাকা পর্যন্ত। আর দেশি আদার দাম কেজিতে বেড়েছে ১০০ টাকার বেশি।

সব ধরনের মশলার দামও বেড়েছে। কারওয়ান বাজারে প্রতি কেজি জিরা বিক্রি হচ্ছে ৮৩০ থেকে ৮৫০ টাকায়। পাশাপাশি এলাচ ১ হাজার ৬০০ টাকা, লবঙ্গ ১ হাজার ৫০০ টাকা, কালোজিরা ২৫০ টাকা ও প্রতি কেজি ধনিয়া বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকায়।

মশলা ব্যবসায়ী মেসার্স উপহার স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. বাবুল হোসেন বলেন, ২ থেকে ৩ মাসের ব্যবধানে কেজিপ্রতি বিভিন্ন মশলার দাম ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মশলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক রাসেল আহমেদ বলেন, আমরা আদাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ না। সব ধরনের মশলাই আমাদের বাইরে থেকে আনতে হয়। দেশে আদার চাহিদা প্রায় ৩ লাখ ৭১ হাজার মেট্রিক টন। গত অর্থবছরে দেশে আদার উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন। এবছর উৎপাদন কমে হয়েছে ১ লাখ ৯৩ হাজার মেট্রিক টন। গত অর্থবছরে ১৭ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে আদা চাষ হয়েছিল। চলতি অর্থবছরে হয়েছে ১৫ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে।

এ বিষয়ে কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সার্বিক বিবেচনায় সাধারণ মানুষকে বেশ ঝামেলাপূর্ণ একটি সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য এভাবে বাড়তে থাকে, তাহলে মানুষের জীবনে এর নেতিবাচক প্রভাব আরও গভীর হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকারকে সুষ্ঠু উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান ক্যাবের সভাপতি।