ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের সঙ্গে শুধু চিঠি চালাচালি

সিভিল এভিয়েশনের বকেয়া পাওনা ৫ হাজার কোটি টাকা

সিভিল এভিয়েশনের বকেয়া পাওনা ৫ হাজার কোটি টাকা

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বকেয়া বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের কাছে আটকা পড়েছে। প্রায় ২০ বছর ধরে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করতে পারছে না সিভিল এভিয়েশন। শুধু বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাছেই বকেয়া প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। আদালতের নির্দেশ, দুদক এবং সিভিল এভিয়েশনের মধ্যে দফায় দফায় চিঠি চালাচালির পরও ওই ৪ হাজার কোটি টাকা বিমানের কাছ থেকে আদায় করতে পারেনি সিভিল এভিয়েশন। বকেয়া পরিশোধের জন্য আবারও গত ১৮ মে বিমানকে চিঠি দিয়েছে সিভিল এভিয়েশন। এছাড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া ইউনাইটেড এয়ারও ৪০০ কোটি টাকা এখন পর্যন্ত পরিশোধ করেনি। কবে নাগাদ এসব অর্থ আদায় হবে, কিংবা আদৌ আদায় হবে কি না, তাও কেউ বলতে পারছেন না। সিভিল এভিয়েশন ও বিমান সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সিভিল এভিয়েশন জানায়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স মাঝে মধ্যে কিছু টাকা পরিশোধ করে। তবে ইউনাইটেড এয়ার, জিএমজি, অ্যারো বেঙ্গল, এয়ার পারাবাত, বেস্ট এয়ার, এভিয়ানা এবং রিজেন্ট এয়ার লাইন্সের কাছে সিভিল এভিয়েশনের পাওনা ১ হাজার কোটি টাকা প্রায় ২০ বছর ধরে আটকা রয়েছে। বন্ধ হওয়া এসব এয়ারলাইন্স আদৌ বকেয়া পরিশোধ করবে কি না, তাও অনেকটা অনিশ্চিত। বিমান প্রতি বছর তাদের হিসাবের খাতায় লাভ দেখালেও বকেয়া অর্থের পরিমাণের কথা বলে না। এ নিয়ে বিমান কর্তৃপক্ষ অনেকটা উদাসীন বলে অভিযোগ করেছে সিভিল এভিয়েশন।

জানা যায়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাছে বর্তমানে ৩ হাজার ৯৯৭ কোটি ৬৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা পাওনা রয়েছে। তবে মাঝেমধ্যে কিছু টাকা পরিশোধ করলেও ওই বিপুল পরিমাণ অর্থ কবে পরিশোধ করা হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই বকেয়া আদায়ের জন্য ২০২০ সালে হাইকোর্ট থেকে বিমানকে নির্দেশ দিয়েছে, দুদক কয়েক দফায় চিঠি দিয়েছে, সিভিল এভিয়েশন দফায় দফায় বৈঠক ও চিঠি চালাচালি করেছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সিভিল এভিয়েশনের পাওনা পরিশোধে কোনো উদ্যোগই নিচ্ছে না বলে সিভিল এভিয়েশনের একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন।

এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০২০ সালে বিমান ও সিভিল এভিয়েশনকে চিঠি দিয়ে বকেয়া সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল। বিমান কেন বকেয়া অর্থ পরিশোধ করেনি এবং সিভিল এভিয়েশন এ ব্যাপারে কী করেছে, তা জানতে চেয়ে কয়েক দফায় চিঠি দেয়ার পরও কোনো কাজ হয়নি। দুদক ৩ বছরের মধ্যে চিঠির কোনো সদুত্তর পায়নি। পরবর্তীতে দুদক আবার চিঠি দেয়। দুদকের চিঠিতে বলা হয়, পুঞ্জীভূত বকেয়ার কারণ, বকেয়া আদায়ের জন্য গৃহীত ব্যবস্থার বিবরণ দুর্নীতি দমন কমিশনকে অবহিত করার জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখনো কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি বিমান। পরবর্তীতে আবার চিঠি দিয়ে তা কার্যদিবসের মধ্যে বকেয়া আদায়ের জন্য কী কী করা হয়েছে বা কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা জানানোর জন্য তাগিদ দেয়ার পর ওই সাত কার্যদিবস গিয়ে আরো কয়েক বছর হলেও বিমানের কোনো সাড়া নেই।

জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও অতিরিক্ত সচিব শফিউল আজম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সিভিল এভিয়েশনের পাওনার মধ্যে মূল যে বকেয়া তা পরিশোধের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু ৭২ শতাংশ সারচার্জ যুক্ত করে যে বকেয়ার কথা বলা হয়েছে- তা মওকুফ করার জন্য বলা হয়েছে। এছাড়া সিভিল এভিয়েশনের বকেয়া আমরা পর্যায়ক্রমে পরিশোধ করছি। তবে এখন পর্যন্ত সব টাকা পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। তিনি আরো বলেন, এই বকেয়া অনেক আগের। আমরা চেষ্টা করছি পরিশোধ করার। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ থাকার পরও বিমান কীভাবে বছর বছর লাভের কথা বলেছে। এর জবাবে সিইও বলেন, আমরা প্রতি বছর শুধু বছর ওয়ারি আয়-ব্যয় হিসাব করি।

বকেয়া অনাদায় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বকেয়া আদায়ে আমরা চেষ্টা করছি। বিমান মাঝেমধ্যেই টাকা পরিশোধ করছে। তবে ইউনাইটেড এয়ার ৪০০ কোটি টাকার একটি টাকাও পরিশোধ করেনি। এছাড়া বন্ধ থাকা কয়েকটি এয়ার লাইন্সের কাছে বকেয়া থাকা অর্থও আদায় হচ্ছে না। তিনি বলেন, বিমানের বকেয়া বিলের ওপর অতিরিক্ত চার্জ রয়েছে আরো ২ হাজার কোটি টাকা। চেয়ারম্যান বলেন, অটোমেশন পদ্ধতিতে রাজস্ব আদায় করলে বকেয়া পড়বে না। তাই আমরা খুব দ্রুত অটোমেশন পদ্ধতিতে অর্থাৎ সফটওয়্যার বিলিং পদ্ধতিতে রাজস্ব আদায়ের উদ্যোগ গ্রহণ করছি। এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্তও হয়েছে।

সিভিল এভিয়েশন জানায়, বিমানবন্দর ব্যবহারের জন্য এয়ার লাইন্সগুলোর ওপর দুই ধরনের অর্থ পাওনা হয়েছে। তার মধ্যে আছে অ্যারোনটিক্যাল চার্জ এবং নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ। অ্যারোনটিক্যাল চার্জ হলো- বিমান ল্যান্ডিং চার্জ, সিকিউরিটি চার্জ, ওভার ফ্লাইং চার্জ, রুট নেভিগেশন চার্জ, সার্ভিস চার্জ, বোর্ডিং ব্রিজ ব্যবহারের চার্জ এবং এমবারকেশন চার্জ। নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জগুলো হলো- গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং চার্জ, চেক-ইন-কাউন্টার, কার পার্কিং এবং এভিয়েশন ক্যাটারিং সার্ভিস।

সিভিল এভিয়েশনের রাজস্ব বিভাগ জানায়, জিএমজি এয়ার লাইন্সের কাছে বকেয়া ৩১১ কোটি ৯০ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। বেস্ট এয়ারের কাছে পাওনা ৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ইউনাইটেড এয়ার আগের পরিচালনা বোর্ড ভেঙে দিয়ে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে- বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নামে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করেছে। তারা আবার ইউনাইটেড এয়ার চালু করতে করতে চাচ্ছে। তবে সিভিল এভিয়েশন বলেছে, আগের পাওনা ৪০০ কোটি টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত ফ্লাইট চালু করার সুযোগ নেই।

উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার দেনার বোঝা নিয়ে বিমান বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল। ওই সময় বিমানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় ১ হাজার ২১৬ কোটি টাকার সারচার্জ মওকুফ করে। বাকি ৫৭৩ কোটি টাকা পরিশোধ করে দায় মুক্তি পায় বিমান। তারপরও আবার বকেয়ার পাহাড় জমতে থাকে।

বিমান বলেছে, সারচার্জ ছাড়া মূল বকেয়া পরিশোধ করার জন্য সিভিল এভিয়েশনের কাছে একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে মূল বকেয়া পরিশোধের পরিকল্পনা রয়েছে। এই পরিকল্পনা মোতাবেক ২০২২ সালে ৩৪০ কোটি, ২০২৩ সালে ৪৪০ কোটি, ২০২৪ সালে ৫৯০ কোটি, ২০২৫ সালে ৭৪০ কোটি এবং ২০২৬ সালে ২ হাজার ৩৩৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা পরিশোধ করা হবে। এছাড়া এখন থেকে প্রতি মাসের রাজস্ব নিয়মিত বিমান পরিশোধ করবে।

জানা যায়, ২০১৩ সালের ৭ জুলাই বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এ প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এয়ারলাইন্সগুলোর বকেয়ার ওপর প্রতি ৩০ দিনে ৬ শতাংশ সারচার্জ আরোপ করা হবে। আর ১ বছর বকেয়া থাকলে মূল বকেয়ার ওপর ৭২ শতাংশ পর্যন্ত সারচার্জ দিতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত