ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নতুন কারিকুলামের লক্ষ্য ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা

নতুন কারিকুলামের লক্ষ্য ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা

দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এ বছর চালু হয়েছে নতুন কারিকুলাম। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ক্লাসেও একই কারিকুলাম চালু হবে। চলতি শিক্ষাবর্ষের প্রায় ৫ মাস অতিবাহিত হতে চললেও সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতির বই ও ব্যবহারিক বিভিন্ন কাজের সঙ্গে এখনো খাপ খাওয়াতে পারছেন না শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এদিকে কিছুদিন পরই শুরু হবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের অর্ধবার্ষিক মূল্যায়ন। এর আগে সিলেবাস শেষ করা নিয়ে ব্যস্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

তবে নতুন কারিকুলাম সম্পর্কে এখনো যথাযথ অভিজ্ঞতা না থাকায় দেশের একেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একেকরকমভাবে চলছে শিক্ষার্থীদের হোকওয়ার্ক ও গ্রুপ ওয়ার্ক। সঠিক পদ্ধতি নিয়ে চরম বিভ্রান্তি ও ভোগান্তিতে পড়ছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে নতুন কারিকুলামের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও তাদের শ্রেণি কার্যক্রম তদারকি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাজধানীর নামকরা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক শাহীনুর সুলতানা জানান, স্কুলের ৭ম শ্রেণির স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা বিষয়টি যিনি পড়ান তিনি শিক্ষার্থীদের কিছু কাজ দিয়েছেন। এই কাজের ওপর মূল্যায়ন করা হবে এবং নম্বর দেয়া হবে।

শ্রেণিকক্ষে প্রতিটি দলের মধ্যে এসব কাজ ভাগ করে দেয়া হয়। সবাইকে বিভিন্ন রকম খাবার, ওয়ান টাইম প্লেট, বাটি, গ্লাস ইত্যাদি নিতে হবে। সবাইকে খাবার এক্সট্রা করে নিয়ে যেতে বলেছেন। আমার সন্তানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বাসা থেকে নুডুলস্ রান্না করে নিয়ে যেতে হবে। তার শ্রেণিকক্ষে কেউ নিবে পায়েস, কেউ রোল আবার কেউ শর্মা ইত্যাদি। খাবারের স্বাদের ভিত্তিতে নাকি নম্বর দিবে এবং ক্লাসে নাকি উৎসব হবে।

তিনি বলেন, স্কুলের শিক্ষিকার ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই, কিন্তু আমি সামগ্রিক সিস্টেমটা নিয়ে বলতে চাই। যখন নতুন বইগুলোতে রান্নাবান্না সম্পর্কে দেয়া ছিল তখন অনেকেই বলেছেন এগুলো থেকে তারা জীবনমুখী শিক্ষা পাবে, রান্না শিখবে ইত্যাদি।

কিন্তু শিক্ষকের নির্দেশনা অনুযায়ী আসলে কি তারা রান্না শিখেছে? নির্ধারিত দিনে শিক্ষার্থীরা রান্না করে নিবে নাকি এই দায়িত্ব মায়েদের ঘাড়ের উপর পড়বে?

সুমন রায় নামের আরেকজন অভিভাবক জানান, ৬ষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি ভার্সনের ছাত্রদের এসাইনমেন্ট ছিল ৭ জন করে এক একটা গ্রুপের ছাত্রদের ভাত-মাছ তরকারি আলুভর্তাসহ ৭ ধরনের খাবার বাসা থেকে রান্না করে ক্লাসে নিয়ে যাওয়া। তারপর সেই খাবার টিচাররা মিলে খাবে, আর বাচ্চাদের মূল্যায়ন হবে। এভাবে বাচ্চার মায়েদের রান্না করা খাবারের মাধ্যমে ছাত্রদের মূল্যায়ন কীভাবে নির্ভর করে?

জানা গেছে, নতুন কারিকুলামের পাঠ্যবইয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের যে হোম ও গ্রুপ ওয়ার্ক দিচ্ছেন, তা ঠিকমতো বুঝতে না পারায় যে যার মতো ওয়ার্ক করে নিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া ক্লাসের বাইরে গিয়ে গ্রুপের সদস্যরা সবাই মিলে ওয়ার্ক নিয়েও জটিলতায় পড়ছে। কারণ সন্তানদের গ্রুপ ওয়ার্কের জন্য সময় ও স্থান নির্ধারণ এবং তাদের সঙ্গে সময় দিতে চরম বিপাকে পড়ছেন অভিভাবকরা। অনেকে আবার ব্যক্তিগত ও গ্রুপ ওয়ার্ক প্রাইভেট বা কোচিংয়ের শিক্ষকদের মাধ্যমে করে নিচ্ছেন। তাছাড়া এসব কাজের জন্য বিভিন্ন সামগ্রী ব্যবহারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো গাইডলাইন না থাকায় ভালো মূল্যায়নের আশায় টাকা খরচের প্রতিযোগিতা লেগে গেছে। এতে অভিভাবকদের ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে। আবার শহরের ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যবহারিক কাজে কিছুটা জোর দিলেও মফস্বলের শিক্ষার্থীরা এক্ষেত্রে অনেকটাই অন্ধকারে। তাই এ পরিস্থিতিতে নতুন কারিকুলামের সফলতা তথা আসল উদ্দেশ্য পূরণ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকার কারণেই মূলত এ পরিস্থিতি হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে কুষ্টিয়ার একজন স্কুল শিক্ষক বলেন, নতুন কারিকুলাম বিষয়ে যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে তা মোটেও যথেষ্ঠ নয়। এ বিষয়ে শিক্ষকদের অনেকেই অন্ধকারে। তারা ক্লাসে ঠিকমতো পড়াতে ও বুঝাতে পারছেন না। তাই শিক্ষকদের আরো প্রশিক্ষণ হওয়া জরুরি।

অপরদিকে অভিভাবকদের দাবি-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন কারিকুলাম কীভাবে পড়ানো হচ্ছে, তা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মাধ্যমে তদারকি করা দরকার। এনসিটিবির গাইডলাইন অনুযায়ী যাতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন কারিকুলাম পড়ানো হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নতুন কারিকুলাম নিয়ে প্রথম দিকে একটু জটিলতা দেখা দিলেও ক্রমান্বয়ে তা সবাই আয়ত্ব করে ফেলবে। আর এ পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যা থেকে বের হয়ে হাতে-কলমে শিখতে পারবে।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, মুখস্থ বিদ্যা দিয়ে আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। যে ভবিষ্যতের জন্য আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের তৈরি করছি সেই ভবিষ্যতে মূল দক্ষতাই হবে শিখতে পারার দক্ষতা। তিনি বলেন, শিক্ষার রূপান্তর ঘটানোর জন্য আমরা নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে এসেছি। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতি নতুনভাবে করা হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শ্রেণিতে এই নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আমরা একজন শিক্ষার্থীকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারব।

সূত্রমতে, নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষকদের অনলাইনে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এই প্রশিক্ষণ দেয়। অনলাইন প্রশিক্ষণ শেষে ৬ থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রথম ধাপে মোট পাঁচ দিন এবং ২০ থেকে ২৪ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় পাঁচ দিন শিক্ষকদের সরাসরি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

তবে প্রাথমিকের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উদ্বোধন হয় গত ২৩ জানুয়ারি। এ পর্যন্ত খুব স্বল্প সংখ্যক শিক্ষকের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা গেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত