ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নির্বাচনকালীন সরকারে থাকছে না চমক

নির্বাচনকালীন সরকারে থাকছে না চমক

এবারের নির্বাচনকালীন সরকারে অল্প কিছু চমক থাকলেও বড় কোনো চমক থাকছে না, আগের মতো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই হবে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তবে এবার বিরোধী দলের সীমিত অংশগ্রহণ থাকতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

সূত্র জানায়, প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ আগাগোড়াই বলে আসছে, নির্বাচনের সময় সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারই বহাল থাকবে। ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠানে কমিশনকে সহায়তা করতে সরকার সহায়ক সরকারের ভূমিকা পালন করবে।

গত ২৫ মে কাতারে ইকোনমিক ফোরামে যোগদানকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ‘কথোপকথন’ শীর্ষক অধিবেশনে তিনি বলেছেন, গণতন্ত্র এবং জনগণের ভোটাধিকার সমুন্নত রেখে আমাদের সরকারের (আওয়ামী লীগ সরকার) অধীনেই অবশ্যই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে। এর ফরম্যাটই বা কী। কতজন সদস্য থাকবেন ইত্যাদি। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, এবারের নির্বাচনেও একই প্রক্রিয়ায় সরকার গঠন হবে। তেমন ব্যতিক্রম কিছু হবে না। আগের মতোই আকারে ছোট হবে। তারা রুটিন দায়িত্ব পালন করবেন।

এদিকে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে এ সংক্রান্ত একটি প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আমরা এটুকু উদারতা দেখাতে পারি যে, পার্লামেন্টে সংসদ সদস্য যারা আছেন তাদের মধ্যে কেউ যদি ইচ্ছা করেন যে, নির্বাচনকালীন সরকারে আসতে চান আমরা নিতে রাজি আছি। আগেও আমরা নিয়েছি।

তবে বিষয়টি নিয়ে খোদ ধোঁয়াশায় রয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট নেতারাও। সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোরও হাল একই। তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এতেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু তা কেমন হবে, কীসের ভিত্তিতে হবে আমরা জানি না।

এ নিয়ে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনা তো আমাদের জানা নেই। না জেনে কী বলবো? উনি বলেছেন যা, ওই পর্যন্তই। এর বাইরে আমাদের কিছু জানা নেই। কোন পরিপ্রেক্ষিতে, কিসের ভিত্তিতে উনি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করবেন, এসব জানলে পরে জানাবো। এতে আমাদের আগ্রহ আছে কি না তাও জানাবো।

এর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনের পৌনে দুই মাস আগে ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর গঠন করা হয়েছিল নির্বাচনকালীন সরকার। সেখানে নতুন-পুরাতন মিলিয়ে মোট সদস্য ছিলেন ২৯ জন। ১০ জন ছিলেন উপদেষ্টা। তখন ওই সরকারকে বলা হচ্ছিল সর্বদলীয় সরকার। এরপর একই প্রক্রিয়ায় ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও সরকার গঠন করা হয়। এবারও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই প্রক্রিয়ায় সরকার গঠন হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।

এ নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বলেন, বরাবরের মতোই হবে নির্বাচনকালীন সরকার। আকারে ছোট হবে। তারা রুটিন দায়িত্ব পালন করবেন। তবে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর মধ্যে যে কেউ আগ্রহ প্রকাশ করলে তাদের নির্বাচনকালীন সরকারে রাখা হবে।

এ সংবিধানের কথা উল্লেখ করে সরকার সমর্থিত আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী একটি সরকার থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে আরেকটি সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে। আর নির্বাচনের সময় আগের নির্বাচিত সরকারই তার দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখবে। এই দায়িত্ব পালনের বিষয়টি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় যে বিধান, জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তাই। এর অর্থ হচ্ছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় সরকার যেভাবে দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখে জাতীয় নির্বাচনের সময়ও বিদ্যমান সরকারই স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখবে।

সংবিধান বিশেষজ্ঞরা জানান, নির্বাচন কারও অধীনে অনুষ্ঠানের কথা সংবিধানে নেই। জাতীয় নির্বাচনের সময় সরকারের ধরন পরিবর্তন হবে এমন বিধানও নেই।

সংবিধান অনুযায়ী, জাতীয় নির্বাচনসহ সব ধরনের নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন। তবে এ সময়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ ইসির কাছে ন্যস্ত হতে হবে এমনটিও সংবিধানে উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে সংবিধানে বলা আছে, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনীয় কর্মচারী নিযুক্ত করবেন। সরকারের নির্বাহী বিভাগ ইসিকে দায়িত্ব পালনে সহায়তা করবে।

সংবিধানের এই দুই বিধানের আলোকে সরকারের ইসিকে সহযোগিতা করা ও নির্বাচনকালে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ইসির পরামর্শ নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) এবং নির্বাচনি বিধিমালার আলোকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়নসহ কিছু কিছু কাজে সরকারকে কমিশনের অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। পাশাপাশি নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে এমন উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন, নির্বাচনের সময় সরকারি প্রটোকল গ্রহণ, ডাকবাংলোসহ সরকারি স্থাপনার ব্যবহার বা এ জাতীয় কিছু কর্মকাণ্ডে বিধিনিষেধ আরোপ থাকে।

আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতা জানান, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে ‘সর্বদলীয় সরকার’ গঠন করা হলেও এটির কোনও প্রয়োজন ছিল না। সব রাজনৈতিক দল যাতে নির্বাচনে অংশ নেয় সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই সরকার গঠন করেছিলেন।

ওই নেতাদের মতে, তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে তাদের মন্ত্রিসভায় স্থান দিতেই প্রধানমন্ত্রী প্রথমে ওই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ওই সময় বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করে মন্ত্রিসভায় তার দলের প্রতিনিধি দেয়ারও প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু বিএনপি না আসায় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী অন্য দলগুলোকে নিয়ে তিনি ওই সরকার গঠন করেন। আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, বাহ্যিকভাবে ওই সরকারটি ‘অন্তবর্তীকালীন বা নির্বাচনকালীন সরকার’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও বাস্তবে সেটা ছিল স্বাভাবিক সরকারই।

সংবিধানের বিধান অনুসারে, বিদ্যমান সরকার ক্ষমতায় থাকতেই পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এক্ষেত্রে নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে গেলেও সরকারের ওপর তার প্রভাব পড়বে না। সংবিধানের ৫৭(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই অযোগ্য করিবে না।

সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর অর্থ হচ্ছে যিনি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন, তিনি নতুন একজন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকবেন। অর্থাৎ এ বিধান অনুসারে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বপদে বহাল রেখেই নির্বাচন কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করবে। প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি তার সরকারের মন্ত্রিসভার ক্ষেত্রেও সংবিধানের একই বিধান।

এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, সংবিধানে সহায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো বিধান নেই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ও এ ধরনের কোনো বিধান আছে বলে জানা নেই। সংবিধানে বলা আছে, কোনো সরকার নির্বাচন করবে না। নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন। আর নির্বাচনের সময় বর্তমান সরকারই দায়িত্বে থাকবে। সরকার ভোটের জন্য কর্মকর্তা নিয়োগসহ কমিশন যা চাইবে তা করতে বাধ্য থাকবে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে স্পষ্ট করে বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার থাকবে। এর মানে হচ্ছে, নির্বাচন করার জন্য নির্বাচন কমিশন স্বাধীন থাকবে এবং তাকে সহায়তা করতে কমিশন সরকারের কাছে যা চাইবে তা দিতে হবে। কিন্তু যে সরকার আগের নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছে সেই সরকারই দেশের ডে টু ডে রানিং থাকবে। এরপর নির্বাচনে যে জয়লাভ করবে তার কাছে ওই সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত