জলবায়ুর প্রভাবে মৃত্যু বাড়ছে বজ্রপাতে

প্রকাশ : ৩০ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

দেশের ১৫ জেলায় ৩৩৬টি বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র (লাইটার অ্যারেস্টার) বসানোর কাজ চলছে। এরইমধ্যে ২৩৭টি লাইটনিং অ্যারেস্টার স্থাপন করা হয়েছে। অবশিষ্ট ৯৯টি লাইটার অ্যারেস্টার দ্রুত সময়ে স্থাপন সম্পন্ন হবে। এরপরও বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

জানা গেছে, প্রত্যেক বছরে বজ্রপাতে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। দিনে দিনে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বজ্রপাতে মৃত্যু কমিয়ে আনতে টিআর এবং কাবিখা নীতিমালা সংশোধন করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৯ কোটি ৫০ লাখ টাকার ‘লাইটার অ্যারেস্টার’ স্থাপন প্রকল্প হাতে নেয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এই প্রকল্পের আওতায় প্রত্যেকটি ‘লাইটার অ্যারেস্টার’ স্থাপনে ৬ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, দেশের ১৫ জেলা বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকার মধ্যে রয়েছে- দিনাজপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, বগুড়া, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর, চাঁপাইনবাবগ, নেত্রকোনা, রাজশাহী, নবাবগঞ্জ। এ প্রকল্পের আওতায় সিলেট অঞ্চলের সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলায় স্থাপন করা হয়েছে বজ্রনিধোরক যন্ত্র।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তির ব্যবহারে বজ্রপাতে মৃত্যু কমানো সম্ভব, তবে সচেতনতা এবং সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই। এখনই এই দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। সেজন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় লাইটার অ্যারেস্টার মেশিন স্থাপন করেছে। এই বজ্রনিরোধক দণ্ড ও যন্ত্র উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎ সহজে নিরাপদে মাটিতে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেয়। ৩০-৪০ ফুট লম্বা দণ্ডে তিন-চার ইঞ্চি জিআইপি পাইপ ও তামার তার থাকে। এছাড়া লাইটার অ্যারেস্টার হচ্ছে একটি ডিভাইস, যা বসানো হয় বজ্রনিরোধক দণ্ডের ওপর। এর মূল কাজ নির্ধারিত ব্যাসের মধ্যে বজ্রপাত হলে তা টেনে মাটিতে নামিয়ে আনা। বজ্রনিরোধক যন্ত্রটি সব সময় সক্রিয় থাকে।

মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, বজ্রপাত ঠেকানো সম্ভব নয়। তবে আরলি ওয়ার্নিং সিস্টেম, বজ্রপাতনিরোধক কংক্রিটের শেল্টার স্থাপন এবং জনসচেতনতার মাধ্যমে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা সম্ভব। সেজন্য দেশের বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ১৫ জেলায় বজ্রনিরোধক দণ্ড ও যন্ত্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়।

পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন, কিউমুলোনিম্বাস বা ঝড়োপুঞ্জ মেঘ থেকে বজ্রপাত হয়। তাই একে বজ্রগর্ভ মেঘও বলা হয়। কয়েক বছর ধরে এপ্রিল ও মে মাসে দেশে বজ্রপাতের পরিমাণ বেড়েছে। অন্যতম কারণ বাতাসে জলীয়বাষ্পের আধিক্য এবং তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া। আর এ তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত দূষণ। বায়ুতে দূষণের মাত্রা যত বাড়ছে, গড় তাপমাত্রা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলাদেশ ঝড়, খরা, বন্যা ও বজ্রাঘাতপ্রবণ অঞ্চল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে। এতে যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে বজ্রসহ শিলাবৃষ্টি পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা ও পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা সব মিলিয়ে যেন বজ্রপাত তৈরির আদর্শ পরিবেশ এ দেশের বায়ুমণ্ডল।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, বজ্রপাতে প্রতি বছর গড়ে ২৫০ জনের বেশি মানুষ মারা যায় বলে সরকারি হিসাবে দেখানো হচ্ছে। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরো বেশি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ুর পরিবর্তন আর অসচেতনতার কারণে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছেন।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অনুষদের ডিন ও ডিজেস্টার সায়েন্স এবং ক্লাইমট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমানের বলেন, বাংলাদেশের অবস্থানের কারণেই বজ্রপাত বেশি হয়। দক্ষিণে বঙ্গপোসাগর, উত্তরে হিমালয় থাকায় গরম-আর্দ্র ও শীতল-শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে। এই দুই ধরনের আবহাওয়ার সংঘাত ঘটলেই বজ্রপাত হয় সাধারণত। মার্চ থেকে শুরু হয় বজ্রপাতের অনুকূল পরিবেশ। আমার বয়স ও অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বজ্রপাতে মৃত্যুর হার প্রতি বছরই বাড়ছে। এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে, দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জলবায়ুর পরিবর্তন। বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বাড়ছে মূলত সতর্কতা না থাকার কারণেই। কৃষক মরছে বেশি। তারা বজ্রপাত আর বৃষ্টির মধ্যে মাঠে কাজ করেন। অনেকের কাজ না করে উপায়ও থাকে না। শহরে কিন্তু বড় বড় ভবন থাকার কারণে এর প্রভাব কম। শহরে মরছেও কম।

আবহাওয়া-জলবায়ুর পরিবর্তনকে সরাসরি দায়ী করে ড. জিল্লুর বলেন, প্রাকৃতিক এই দুর্যোগরোধে মানুষের কোনো হাত নেই। কিন্তু বজ্রপাতনিরোধক ব্যবস্থা গড়ে তোলা তো মানুষের পক্ষে সম্ভব। সরকার হাওর এলাকায় কিছু কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। তবে এই দুর্যোগ যেহেতু বাড়ছে, সেহেতু ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপকতা আরো বাড়াতে হবে। সতর্কতার জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। গণমাধ্যমেরও দায় আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এ ব্যাপারে কর্মসূচি নিতে হবে। মৃত্যুর হার কমাতে হলে সবাইকে সতর্কতা অবলম্বনের আওতায় আনতে হবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং বেসকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের তথ্যমতে, দেশে প্রতি বছর গড়ে বজ্রপাতে ২৬৫ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই মাঠে থাকা কৃষক, সাড়ে ১৪ শতাংশ বাড়ি ফেরার পথে, আর ১৩ শতাংশ গোসল কিংবা মাছ শিকারের সময়। তবে শহরের ভবনগুলোতে বজ্রপাত প্রতিরোধক দণ্ড থাকায় হতাহতের সংখ্যা কম। ২০১১-এর শুরু থেকে ২০২২ পর্যন্ত ১২ বছরে দেশে বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ১৬২ জনের।

বজ্রনিরোধক ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারি পর্যায়ে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন এনজিও কাজ করছে। সেখানে সরকারি হিসেবে গত ১০ বছরে সারা দেশে প্রায় আড়াই হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বজ্রপাতে ২০১১ সালে মারা গেছেন ১৭৯ জন, ২০১২ সালে ২০১ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫, ২০১৪ সালে ১৭০, ২০১৫ সালে ১৬০, ২০১৬ সালে ২০৫, ২০১৭ সালে ৩০১, ২০১৮ সালে ৩৫৯, ২০১৯ সালে ১৯৮, ২০২০ সালে ২১১ জন এবং ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত মারা গেছেন ১০৯ জন। বেসরকারি হিসেবে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি। বেসরকারি একটি সংগঠনের তথ্যমতে- ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে চলতি মাসের ৪ মে পর্যন্ত বজ্রপাতে ৩৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। বজ্রপাতে মারা যাওয়া বড় অংশই কৃষক। শহরের চেয়ে গ্রামীণ এলাকায় বজ্রপাতে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। বিশেষ করে ফাঁকা মাঠে চাষের কাজ করতে গিয়ে মৃত্যু হচ্ছে অনেকের।

বজ্রনিরোধক যন্ত্র ও দণ্ড স্থাপনের বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। বজ্রপাতের ঝুঁকি মোকাবিলায় কাজ করছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।

তিনি বলেন, দেশে বছরে বজ্রপাতে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। বজ্রপাতে মৃত্যু কমিয়ে আনতে ‘লাইটার অ্যারেস্টার’ স্থাপন করা হচ্ছে। জনগণকে সচেতন করতে বিভিন্ন মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে। কারণ প্রত্যেক নাগরিকের জীবন মূল্যবান, সেই মূল্যবান জীবন রক্ষায় নিয়মিত কাজ করছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরামর্শে বজ্রপাতনিরোধক আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এতে বজ্রপাত শুরু হওয়ার প্রায় ৪০ মিনিট আগেই সতর্কতামূলক বার্তা দেবে ‘লাইটার অ্যারেস্টার’। এ সময়ের মধ্যে মানুষ নিরাপদ আশ্রয় নিতে পারবে বলে জানান সচিব কামরুল হাসান।