ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সীতাকুন্ডের জাহাজ ভাঙা শিল্প

নানা সমস্যায় জর্জরিত : লাল তালিকায় বেড়েছে সংকট

নানা সমস্যায় জর্জরিত : লাল তালিকায় বেড়েছে সংকট

চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড এলাকায় গড়ে উঠা জাহাজ ভাঙা শিল্প নানা সমস্যায় জর্জরিত। মালিকরা বলছেন, মন্দা পরিস্থিতির এই দুঃসময়ে তারা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাচ্ছেন না। এরই মধ্যে জাহাজ ভাঙা শিল্পকে লাল তালিকাভুক্ত করেছে সরকার। গেল মার্চেই কমলা শ্রেণি থেকে লাল শ্রেণিভুক্ত করা হয়। এতে স্ক্র্যাপ জাহাজের পরিবেশ ছাড়পত্রসহ কাটিংয়ের অনুমতি পেতে সময় ক্ষেপণ হচ্ছে। কোন কোন শিপইয়ার্ড অনুমতি পেতে ২ থেকে ৪ মাস পর্যন্ত সময় লেগেছে। অথচ এসব শিপইয়ার্ড বিদেশ থেকে জাহাজ আমদানি করতে ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) করেছে। আর সেই এলসির বিপরীতে প্রতিদিন ৪ থেকে ১০ লাখ টাকা ঋণ শোধ করছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে আমদানি করা জাহাজ কাটা শুরু করতে না পারলে তারা ক্ষতির মুখে পড়বেন। এতে জাহাজ ভাঙা শিল্পেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সীতাকুন্ডের জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পায় সরকার। এতে কাজ করেন কয়েক লাখ শ্রমিক। প্রতিবছর ২৫ লাখ টনেরও বেশি স্ক্র্যাপ লোহা আহরণ হয় এ শিল্প থেকে। কিন্তু করোনার সময় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এ শিল্পে। করোনার সময়ই নানা কারণে আর্থিক সংকট চরমে পৌঁছে অন্তত ৩০টি শিপইয়ার্ড। এসব শিপইয়ার্ড এখনও সচল করা যায়নি। কঠিন সময়ে গেল মার্চ মাসে কমলা শ্রেণিভুক্ত এ শিল্পকে লাল তালিকাভুক্ত করা হয়। এরপর থেকেই সংকট চরম রূপ নেয় বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স অ্যান্ড রি-সাইক্লার্স এসোসিয়েশন (বিএসবিআরএ) এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট কামাল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, লাল তালিকাভুক্ত করায় জাহাজ ভাঙা শিল্প সংকটে পড়েছে। নানা ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিয়েছে। জাহাজ ভাঙা শিল্প পরিবেশ অধিদপ্তরের কমলা শ্রেণিভুক্ত ছিল। নতুন আইনে এটিকে লাল শ্রেণিভুক্ত করা হয়। এ কারণে শিল্পের সঙ্গে যুক্ত নানা দাপ্তরিক কাজ সমাধান করতে দেরি হচ্ছে কয়েক মাস।

অর্থাৎ আগে যেখানে ১ মাস লাগত, সেখানে এখন ৩ মাস লাগছে। আরেক শিপইয়ার্ড মালিক বলেন, এলসি ও ডলার সমস্যার কারণে আমরা সংকটের মধ্যে আছে। এ সংকটে পড়ে বহুশিপ ইয়ার্ড বন্ধ। সচল ইয়ার্ডগুলো পড়েছে বন্ধের ঝুঁকিতে। বিপুল অংকের টাকা খরচ করে ইয়ার্ড মালিকরা আন্তর্জাতিক মানের গ্রিন ইয়ার্ড করছে।

গত ৫ বছরে পাঁচটি গ্রিন শিপইয়ার্ড হয়েছে। আরও ৭/৮টি গ্রিন শিপইয়ার্ড হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে লাল তালিকার জটিলতায় জাহাজ কাটিং পড়েছে ঝুঁকিতে। অনেক ইয়ার্ডে বন্ধ হয়ে আছে। এতে লোকসানে পড়ে ইয়ার্ডগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, পরিবেশ আইনে লাল তালিকায় অবস্থান করা মানে শিল্পটি পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এতে অনেক বিষয়ের ছাড়পত্র ঢাকা থেকেই সংগ্রহ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই। এদিকে ডলার সংকটে ব্যাংক এলসি খোলা বন্ধ করে দেয়ায় বহু ইয়ার্ড মালিক জাহাজ আমদানি বন্ধ রেখেছেন। অর্থাৎ তারা জাহাজ আমদানি করতে পারছে না। আমদানি দেরি হলে বন্ধের ঝুঁকিতে পড়ে শিপইয়ার্ড।

সীতাকুন্ডের ইয়ার্ডগুলো জাহাজ সংকটে পড়েছে। তাই স্ক্র্যাপ সরবরাহ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। বর্তমানে ১২৬টি শিপ ইয়ার্ডের অনুমোদন আছে। ৮ থেকে ১০ বছর আগেও এখানে ৬০ থেকে ৬৫টি ইয়ার্ডে নিয়মিত জাহাজ ভাঙা হত। কিন্তু বর্তমানে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন মাত্র ৩০টির মতো ইয়ার্ডে জাহাজ ভাঙা হচ্ছে। শিপব্রেকার্সরা জানান, এই শিল্পের দুর্দিনের কারণে মালিকরা আর্থিকভাবে বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন। কাজের অভাবে শ্রমিকরা পড়েছেন বেকায়দায়। গত এক দশকে নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে চলছে জাহাজ ভাঙাশিল্প। এরমধ্যে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই শিল্প। কখনও অতিরিক্ত ভ্যাট আরোপ, কখনও আন্তর্জাতিক বাজারে লোহার মূল্যবৃদ্ধি ক্ষতি হয় শিল্পের। এতে তারা বিপুল লোকসানের মুখে পড়েছেন। বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স অ্যান্ড রি-সাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, ৬০ এর দশকে সীতাকুন্ডের ফৌজদারহাট সাগর উপকূলে ঝড়ে আটকে পড়া স্ক্র্যাপ জাহাজ কুইন আল-পাইন ভাঙার মধ্য দিয়ে সম্ভাবনার দ্বার খোলে। আশির দশকে একটি লাভজনক শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে তা আরও দ্রুত ছড়িয়ে বর্তমানে সীতাকুন্ডের কুমিরা পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় গড়ে উঠেছে শিপইয়ার্ড। বর্তমানে এখানে ১২৬টি শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের অনুমোদন আছে। কিন্তু করোনা মহামারিসহ নানা কারণে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে অনেক ইয়ার্ডে জাহাজ আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে তা আরও প্রকট হয়। বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইকেলার্স এসোসিয়েশন-এর তথ্য মতে, ২০১৯ সালে করোনা মহামারির মধ্যেও দেশে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়েছে ২০৬টি। যার ওজন ছিল ২৩ লাখ ৯০ হাজার ৭১৪ কেজি।

২০২০ সালে ২২৮টি জাহাজ আমদানি হয়। যার ওজন ২০ লাখ ৬৯ হাজার ৬৬৬ কেজি। ২০২১ সালের প্রথম ৮ মাসে ২৮০টি স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়েছে। যার ওজন ২৭ লাখ ৫৮ হাজার ৫৯৭ কেজি। ২০২২ সালে তার অর্ধেকে নেমে আসে আমদানি। মাত্র ১৫১টি স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়। যার ওজন মাত্র ১১ লাখ ৪৭ হাজার ৪৫০ কেজি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত