চট্টগ্রামে থামছে না বন্যপ্রাণী পাচার

বন বিভাগের অবহেলায় সক্রিয় পাচারকারীরা

প্রকাশ : ০১ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  সাইফুদ্দিন তুহিন, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামসহ আশপাশের পাঁচ জেলা এখন বন্যপ্রাণী পাচারের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন বনাঞ্চল থেকে বন্যপ্রাণী ও পাখি পাচার করছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এর মধ্যে বিরল ও বিপদাপন্ন প্রজাতির অনেক প্রাণী-পাখিও রয়েছে। এসব প্রাণী চট্টগ্রাম নগরীর নূপুর মার্কেট, দেওয়ানহাটসহ ঢাকায় পাচার করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ বিভাগের অভিযানে কিছু প্রাণী ও পাখি উদ্ধার হয়। তবে এতে নিয়ন্ত্রণে আসছে না বন্যপ্রাণী পাচার। সর্বশেষ ২৮ মে রাতে বান্দরবান পার্বত্য জেলার গহীন অরণ্যে বসবাসকারী বিরল প্রজাতির দুটি রাজ ধনেশ পাখি উদ্ধার করেছে পুলিশ। চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকা-সাতক্ষীরা রুটে পাচারের সময় চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া কলেজের সামনে থেকে রাজ ধনেশগুলো উদ্ধার করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম-কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম নগরী হয়ে দেশের সীমান্তে পাচার হচ্ছে বন্যপ্রাণী। বান্দরবানের আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, চট্টগ্রামের চুনতির গহিন অরণ্য থেকে বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণিগুলো ধরে নিয়ে আসা হয়। এরপর তা বিক্রি করা হয় চট্টগ্রামের নূপুর মার্কেটসহ বিভিন্ন মার্কেটে। রয়েছে সংঘবদ্ধ একটি চক্র। বিরল প্রজাতির কিছু প্রাণী দেশের বাইরেও সমানে পাচার হচ্ছে। বন কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ রয়েছে বিস্তর। এই সুযোগে পাচারকারী চক্র সব সময় থাকে সক্রিয়। তারাই বন থেকে বিভিন্ন প্রাণী ধরে এনে পাচার করছে দেশের অভ্যন্তরের বাজার ও সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে।

জানা গেছে, গত বছরের ২৭ অক্টোবর বন্যপ্রাণী পাচারকালে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থেকে দু’জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি মথুয়া বা বন মোরগ, একটি চিতাবিড়াল ও তিনটি মেছো বিড়াল উদ্ধার করা হয়। একই বছরের ৮ অক্টোবর বিরল প্রজাতির উল্লুকসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে লোহাগাড়া থানা পুলিশ। ওই বছরের ১০ নভেম্বর ঢাকায় পাচারকালে একটি সজারু, দুটি লজ্জাবতী বানরসহ একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানার দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, আটককৃতরা পাহাড়ি লোকজনের কাছ থেকে বন্যপ্রাণী সংগ্রহ করে। এরপর এসব প্রাণী নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে। সুবিধাজনক সময়ে এসব প্রাণী ঢাকার পাশাপাশি দেশের সীমান্ত এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সীমান্ত থেকে সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা দেশের বাইরে পাচার করে এসব প্রাণী।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ জানায়, ২০২১ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত চট্টগ্রামে বন্যপ্রাণী উদ্ধারে সংস্থাটি ৪২টি অভিযান পরিচালনা করে ৪২৫টি বন্যপ্রাণী ও পাখি উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে গন্ধগোকুল, হগ ব্যাজার, টিয়া, ময়না, মুনিয়া, বুলবুলি, বানর, ঘুঘু, শালিক, তক্ষক, গুঁইসাপ, লজ্জাবতী বানর, বন্যশূকর, মেছোবিড়াল, বনরুই, প্যাঁচা ও কালিম পাখি উদ্ধার করে। বিক্রির সময় উদ্ধার করা হয় হরিণের মাংসও। এছাড়া গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৪টি অভিযান পরিচালনা করে ১৯০টি বন্যপ্রাণী ও পাখি উদ্ধার করা হয়। চলতি বছরের মে পর্যন্ত আরো অনেক বন্যপ্রাণী উদ্ধার করেছে পুলিশ।

এদিকে বান্দরবান পার্বত্য জেলার গহীন অরণ্যে বসবাসকারী বিরল প্রজাতির রাজ ধনেশ পাখি পাচার করার সময় ২৮ মে রাতে চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া কলেজের সামনে থেকে দুটি রাজ ধনেশ উদ্ধার করে পুলিশ। এসব রাজ ধনেশ চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকা-সাতক্ষীরা বা অন্য পথে পাচার হচ্ছিল বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানতে পারে পুলিশ। পাচার কাজে জড়িত এক ব্যক্তিকেও আটক করেছে পুলিশ। তার নাম মিজানুর রহমান (৪৭)। তার বাড়ি পাবনা জেলার বেড়া উপজেলায়। ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে চার মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করেছে। আর এটিসহ গত এক সপ্তাহে চট্টগ্রামে রাজ ধনেশ পাখি জব্দের দুটি ঘটনা ঘটল। গত ২৫ মে অন্য ঘটনায় বাঁশখালী থেকে দুই জোড়া ধনেশ পাখিসহ দুই ব্যক্তিকে আটক করেছে পুলিশ।

জানা গেছে, চট্টগ্রামে চোরাচালানিরা বিভিন্ন প্রাণীর পাশাপাশি বিরল প্রজাতির পাখির দিকে নজর দিয়েছে। অত্যন্ত দামি এসব পাখির মধ্যে অন্যতম রাজ ধনেশ। একটি বিক্রি করতে পারলেই কয়েক লাখ টাকা। এক জোড়া রাজ ধনেশ পাখি ৪-৫ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। এতে টাকার লোভে বন্যপ্রাণি পাচার চক্রের অনেকে বেআইনি এই কাজে যুক্ত রয়েছে। এ চক্রের সদস্য মিজানুর রহমান ২৮ মে রাতে দুটি রাজ ধনেশ পাখি পাচারের সময় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া কলেজ গেট এলাকায় শ্যামলী পরিবহনের একটি বাস থেকে জব্দ করা হয়। সঙ্গে মিজানুর রহমানকেও আটক করা হয়।

চন্দনাইশ থানার ওসি আনোয়ার হোসেন বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গাছবাড়িয়া কলেজ গেটের সামনে গত রোববার রাত প্রায় পৌনে ১২টায় অভিযান চালিয়ে দুটি বিরল রাজ ধনেশ পাখিসহ মিজানুর রহমানকে আটক করে পুলিশ।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মিজান জানিয়েছে, পাখিগুলো বান্দরবানের আলীকদম থেকে সংগ্রহ করে ঢাকার গাজীপুরে আরেকজনের কাছে হস্তান্তরের দায়িত্ব ছিল তার। এরপর সাতক্ষীরা হয়ে ভারতে পাচার করা হয় এসব পাখি। এরপর রোববার রাতেই চন্দনাইশ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জিমরান মোহাম্মদ সায়েক তাৎক্ষণিক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বন্যপ্রাণি আইনে আটক মিজানুর রহমানকে চার মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন।

এর আগে গত ২৫ মে রাতে বাঁশখালীতে চারটি রাজ ধনেশসহ দুই পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর পাচারকারী ও উদ্ধারকৃত ধনেশ পাখি থানা হেফাজতে রাখা হয়। ২৬ মে সকালে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট খোন্দকার মাহমুদুল হাসানের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। আটক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ এর ৩৪ ধারার অপরাধে ছয় মাসের জেল প্রদান করা হয়। আটক ব্যক্তিরা হলো- মূল পাচারকারী বাগেরহাটের শরণখোলা এলাকার মৃত ফজলুল হকের পুত্র মিজানুর রহমান (৪২)। পাখি পরিবহনকারী অটোরিকশা চালক চকরিয়ার পানখালী এলাকার আবদুল মালেকের পুত্র মোহাম্মদ সেলিম (৫২)।