ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ডলার সংকটে বেকায়দায় বিদ্যুৎ বিভাগ

লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ মানুষ সহসায় মিলছে না স্বস্তি

বিদ্যুৎ খাতকে সেবা হিসেবে দেখতে হবে : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ মানুষ সহসায় মিলছে না স্বস্তি

ডলার সংকটে চরম বেকায়দায় পড়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা, গ্যাস ও জ্বালানি তেল পর্যাপ্ত আমদানি করতে পারছে না সংস্থাটি। এতে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব না হওয়ায় দেশজুড়ে ঘন ঘন লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে। আগামীতে লোডশেডিংয়ের মাত্রা আরো বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও ডলার সংকটে কয়লা, গ্যাস ও জ্বালানি সংকটসহ রক্ষণাবেক্ষণ জটিলতায় পুরো মাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যর্থ হচ্ছে পিডিবি। এতে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় নাকাল হতে হচ্ছে মানুষ। গত কয়েকদিন তীব্র দাবদাহের পাশাপাশি বিদ্যুতের যাওয়া-আসা নাগরিক জীবনের বাড়িয়েছে দুর্ভোগ। সারাদেশে পিডিবির দেড় শতাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ২৭ হাজার ৩৬১ মেগাওয়াটের। সর্বশেষ পাওয়ার সেলের ৩১ মে’র তথ্য বলা হয়েছে, গত বুধবার সারাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৭৫০ মেগাওয়াট, ওই দিন বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল ১৪ হাজার ৩৬৮ মেগাওয়াট। আর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে ১৩ হাজার ৫৭৩ মেগাওয়াট। অর্থাৎ, গত বুধবারে গ্রাহক পর্যায়ে ১১৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল। গতকাল বৃহস্পতিবারও রাজধানীসহ সারাদেশে লোডশেডিং ছিল। কারণ চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না পিডিবি।

জ্বালানি সংকটে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেনি বেশকিছু পাওয়ার প্ল্যান্ট। এর মধ্যে ঘোড়াশাল ১০৮ মেগাওয়াট, টঙ্গী ৮০ মেগাওয়াট, হরীপুর, সিদ্দিরগঞ্জ ৩৩৫ মেগাওয়াট, চট্টগ্রাম ২০৮ মেগাওয়াট, আরপিসিএল ২১০ মেগাওয়াট, ভেরামারা ৪১০ মেগাওয়াট, বাঘাবাড়ি ৭১ মেগাওয়াট। একই দিন সারাদেশে জ্বালানি সংকটে আরো বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে (আইপিপি) উৎপাদনে ঘাটতি ছিল। এদিন কাপ্তাই লেকের পানির স্তর কমে যাওয়ায় ২৩০ মেগাওয়াট কাপ্তাই হাইড্রো পাওয়ার প্ল্যান্টে মাত্র ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। অন্যদিকে রক্ষণাবেক্ষণ জটিলতায় দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে সিদ্দিরগঞ্জ ২১০ মেগাওয়াট ও আশুগঞ্জ ৪২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র। কয়লার অভাবে দেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিয়ন বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কয়লা সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলে সামনের দিনগুলোতে বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। মানুষ লোডশেডিংয়ের ভোগান্তিতে পড়বে এর পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাজগুলোতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সরকার বিভিন্ন খাত থেকে রাজস্ব আয় করছে। সেই আয়ের একটি অংশ বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় করতে পারে। তবে বিদ্যুৎ খাতকে আয়ের উৎস হিসেবে দেখা যাবে না। বিদ্যুৎ খাতকে সেবা হিসেবে দেখতে হবে সরকারকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলার সংকটে চরম বিপর্যয়ের মুখে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। জুনের মধ্যে ডলার সংকটের কোনো সমাধান হচ্ছে না। চলতি বছরের শেষ পর্যন্তও এ সংকট থাকতে পারে। এতে গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি তেল আমদানি বাধার মুখে পড়বে।

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে লোডশেডিং চলছে। লোডশেডিংয়ের চরম দুর্ভোগে পড়ে রাজধানী শনিরআখড়া এলাকার বাসিন্দা সবুজ মিয়া আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, তিন-চার দিন ধরে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় রাতের বেলা ঘুমাতে পারছি না। বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে পরিবারের সদস্যরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

শনিরআখড়া ও মাতুয়াইল এলাকায় লোডশেডিংয়ের ব্যাপারে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শর্তে বলেন, মাতুয়াইলে ২৪ ঘণ্টায় সর্বনিম্ন ৮ ঘণ্টা লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। সর্বোচ্চ লোডশেডিং আরও বেশি। বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় সাপ্লাই অনেক কম। ফলে প্রতি ঘণ্টায় ১২ মেগাওয়াট লোডশেডিং দেয়া হয়। আগামীকাল থেকে লোডশেডিং বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

সূত্র জানায়, চলমান ডলার সংকট এবং ডলারের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল আমদানিতে পিছু হটছে। তারা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের মাধ্যমে এসব জ্বালানি সরবরাহ নিতে আগ্রহী। তবে বিপিসি চাহিদা মাফিক তাৎক্ষণিক সরবরাহ দিতে না পারার কারণে আইপিপিগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।

বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৪৭ শতাংশ গ্যাসভিত্তিক। গ্যাসসংকটে গ্যাসভিত্তিক সব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো যাচ্ছে না। এই কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ১১ হাজার মেগাওয়াট। সেখানে গত বুধবার দিনের বেলায় উৎপাদন হয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট। অন্যদিকে ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৭ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। সেখানে দিনের বেলায় উৎপাদন হয়েছে ২ হাজার ২১৫ মেগাওয়াট। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩ হাজার ৪৪০ মেগাওয়াট। গত বুধবার দিনের বেলায় উৎপাদন হয়েছে ২ হাজার ১৫৭ মেগাওয়াট।

অত্যধিক গরমে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লেও সেই অনুযায়ী বরাদ্দ পাচ্ছে না তারা। ফলে বাধ্য হয়ে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। এ বিষয়ে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিটির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেন, গ্রাহকের চাহিদার তুলনায় প্রায় ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম সরবরাহ করছে পিডিবি। বিদ্যুতের ঘাটতি হওয়ায় লোডশেটিংয় দিতে হচ্ছে। সরবরাহ আরও কমলে লোডশেডিং বাড়বে।

ডলার সংকটে কয়লা, গ্যাস ও জ্বালানি তেল আমদানি স্বাভাবিক করতে পারছে না বিপিসি। সরকারের কাছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের বকেয়া পাওনা রয়েছে প্রায় ২৮ কোটি টাকা। ফলে তারাও বিদ্যুৎ উৎপাদনে পিছু হটছেন। এ বিষয়ে পিডিবির প্রাইভেট জেনারেশন (আইপিপি/পিপিপি) বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এবিএম জিয়াউল হক বলেন, আইপিপিগুলোর জ্বালানির সাপ্লাই চেইন রয়েছে। আইপিপিগুলো নিজেরা ফুয়েল আমদানি করে। আবার বিপিসির কাছ থেকেও ফুয়েল নেয়। কিন্তু বিপিসি নিয়মিত ফুয়েল দিতে পারছে না। তাছাড়া ডলারের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণেও আইপিপিগুলোকে ফুয়েল আমদানিতে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।

লোডশেডিং নিরসনে কোনো উদ্যোগ রয়েছে কিনা এ ব্যাপারে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদারের মোবাইলে ফোন করা ও ম্যাসেজ পাঠানো হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত