ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বজ্রপাত থেকে বাঁচতে ১২শ’ ৩২ কোটি টাকার প্রকল্প

বজ্রপাত থেকে বাঁচতে ১২শ’ ৩২ কোটি টাকার প্রকল্প

পিরোজপুরের স্বরূপকাঠিতে প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে ছাগলের ঘরে পলিথিন টানাতে গিয়ে আবুল কালাম ও জাহানারা বেগম দম্পতির বজ্রপাতে মৃত্যু হয়। সিরাজগঞ্জে ধান কাটার সময় দুজনের বজ্রপাতে মৃত্যু হয়। দেশে সাম্প্রতিক সময়ে বজ্রপাত এক ধরনের আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঝড়-বৃষ্টি এলেই বজ্রপাতে একাধিক মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। বজ্রপাতে মৃত্যু কমিয়ে আনতে ১২শ’ ৩২ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা হিসেবে ১৫ জেলায় ৩৩৬টি বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র (লাইটার অ্যারেস্টার) বসাতে ২০২১-২২ অর্থবছরের টিআর এবং কাবিখা নীতিমালা সংশোধন করে জরুরি ভিত্তিতে ১৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। তবে বড় পরিসরে সারা দেশে বজ্রনিরোধক যন্ত্র বসাতে ১২শ’ ৩২ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে সবুজ পাতায় রয়েছে।

গবেষকরা বলছেন, তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বাড়লে বজ্রপাতের সম্ভাবনা ১২ শতাংশ বেড়ে যায়। গত কয়েক দশকে বড় বড় গাছ কেটে ফেলাও তার একটি কারণ। উঁচু গাছপালা বজ্রনিরোধক হিসেবেও কাজ করে। খোলা স্থানে মানুষের কাজ করা এবং বজ্রপাতের বিষয়ে অসচেতনতা থাকায় মৃত্যু বাড়ছে।

সারা দেশে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু বাড়ায় ২০২৩ সালের মে মাসে সরকার বেশকিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা জারি করেছে। সেগুলো হলো- বজ্রঝড় সাধারণত ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট স্থায়ী হয়। এ সময়টুকু ঘরে অবস্থান করতে হবে। অতি জরুরি প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে হলে রাবারের জুতা পরে বাইরে যাওয়া নিরাপদ, এটি বজ্রঝড় বা বজ্রপাত থেকে সুরক্ষা দেবে। বজ্রপাতের সময় ধানক্ষেত বা খোলামাঠে যদি থাকেন তাহলে পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙুল দিয়ে নিচু হয়ে বসে পড়তে হবে। বজ্রপাতের আশঙ্কা দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। ভবনের ছাদে বা উঁচু ভূমিতে যাওয়া উচিত হবে না। বজ্রপাতের সময় যে কোনো ধরনের খেলাধুলা থেকে শিশুকে বিরত রাখতে হবে, ঘরের ভেতরে অবস্থান করতে হবে। খালি জায়গায় যদি উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, ধাতব পদার্থ বা মোবাইল টাওয়ার থাকে, তার কাছাকাছি থাকবেন না। বজ্রপাতের সময় গাছের নিচে থাকা বিপজ্জনক। বজ্রপাতের সময় ছাউনিবিহীন নৌকায় মাছ ধরতে না যাওয়াই উচিত হবে। সমুদ্রে বা নদীতে থাকলে মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। যদি কেউ গাড়ির ভেতর অবস্থান করেন, তাহলে গাড়ির ধাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ রাখা যাবে না। এছাড়াও আরো বেশকিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক জোট আইপিসিসি নোবেল বিজয়ী এবং বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএএস) নির্বাহী পরিচালক বৈজ্ঞানিক ও নীতি গবেষণায় ড. আতিক রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, দেশে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু বাড়ছে, এ নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। তবে এই মৃত্যু কমিয়ে আনতে হবে। আকাশে মেঘ করলে কৃষক মাঠের ফসল দ্রুত ঘরে তোলার চেষ্টা করবেন, এটি স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে সচেতনতার পাশাপাশি বজ্রনিরোধক যন্ত্র স্থাপন করতে হবে।

বজ্রনিরোধক যন্ত্র স্থাপনে সরকারের নেয়া উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ড. আতিক রহমান আরো বলেন, বজ্রনিরোধক যন্ত্র স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছুটা ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। এছাড়াও দেশে তাপমাত্রা বেড়েছে। বর্তমানে ছয় ঋতু নেই। সাড়ে তিন ঋতু দেখা যাচ্ছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত ও কিছু সময়ে বসন্তের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চের ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বাষ্প বাড়ায় মেঘ বাড়ছে, আর মেঘ বাড়লে মৌসুমি বায়ুর চাপ বাড়ে। সুতরাং একটি মেঘের সঙ্গে আরেকটি মেঘের ঘর্ষণে বজ্রপাত হয়। এ সময় উচ্চ ভোল্টের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ যখন মাটিতে নেমে আসে, তখন সবচেয়ে উঁচুতে বজ্রপাত আঘাত করে।

তিনি আরো বলেন, বজ্রপাত ঠেকাতে তালগাছ রোপণ কর্মসূচি সরকার নিলেও তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়নি। প্রকল্পের নামে অর্থের অপচয় হয়েছে। এবার বজ্রনিরোধ যন্ত্র বা লাইটার অ্যারেস্টার স্থাপনে যে প্রকল্প নেয়া হয়েছে, সেটিও তেমন কাজে আসবে না। কারণ বজ্রনিরোধক যন্ত্র বসানোর কিছু দিনের মধ্যেই দেখা যাবে যন্ত্রটি চুরি হয়ে গেছে। বজ্রনিরোধে ১২শ’ ৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে টাওয়ার বসানোর চেয়ে সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাট-বাজারে জনসচেতনতা বাড়ানো দরকার। মানুষ যেন- আকাশে মেঘ দেখলেই নিরাপদ আশ্রয়ে যান অথবা মাটিতে শুয়ে পড়েন।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাত মৌসুমে ফসলি জমি, মাঠ, জলাশয়ে মানুষের চলাচল বৃদ্ধি এবং জনসচেতনতার অভাবে গত কয়েক বছর ধরে বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ছে। এছাড়া ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘোষণা করায় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের নজরদারি বেড়েছে। এতে মৃত্যুর প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় বজ্রপাতপ্রবণ দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। এতে দেশে বজ্রপাতের তীব্রতা বেড়েছে। বিশেষ করে প্রতি বছর হাওরাঞ্চলে বজ্রপাতে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন। যার বেশিরভাগই কৃষক। মানুষকে রক্ষায় প্রকল্প নিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। বজ্রনিরোধক যন্ত্র স্থাপন এবং মোবাইল অ্যাপ, মোবাইল ভয়েস ও মোবাইল টেক্সট মেসেজের সাহায্যে বজ্রপাত আঘাত হানার আগে কৃষকসহ অন্যান্যদের সতর্ক করা হবে। হাওরাঞ্চলে এক কিলোমিটার পরপর নির্মাণ করা হবে বজ্রনিরোধক কংক্রিটের ছাউনি। মেঘের গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ পেলেই মাঠের কৃষকসহ মানুষজন শেল্টার ছাউনিতে আশ্রয় নিতে পারবে। প্রতিটি শেল্টারে ‘লাইটার অ্যারেস্টার’ বসানো হবে। আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম, অর্থাৎ বজ্রপাতের ৪০ মিনিট আগেই সংকেত দেবে সেই যন্ত্র। মোবাইলের মাধ্যমে এ সতর্কবার্তা মাঠের কৃষকসহ সবার কাছে পৌঁছে যাবে। এছাড়া এ প্রকল্পের আওতায় জনসচেতনতা বাড়ানো হবে।

বজ্রপাতের আগাম সতর্কবার্তা পেতে বিশেষ প্রযুক্তি স্থাপন, বজ্রপাত শোষণে অ্যারেস্টার স্থাপন এবং মানুষের জন্য আশ্রয় ছাউনি নির্মাণ করা হবে। সাধারণত এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত বজ্রপাত হয়। একেকটা স্ট্রাইককে বলা হয় বজ্রপাত। পুরো ঘটনাকে বলা বজ্রঝড়। বজ্রঝড় হলে একটার পর একটা বজ্রপাত হতেই থাকে। সাধারণত এটি ২৫ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। বজ্রপাতে মানুষকে রেহাই দিতে বজ্রনিরোধ যন্ত্র স্থাপন ও জনসচেনতা বাড়ানোর বিষয়টি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে বলে জানিয়ে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বজ্রঝড়ের স্থায়িত্ব ৪০ মিনিটের কাছাকাছি, তাই ছাউনি নির্মাণ ও আগাম বার্তার ব্যবস্থা করতে পারলে মানুষের মৃত্যু কমানো সম্ভব। ছাউনি নির্মাণের সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি লাইটার অ্যারেস্টার স্থাপন করা হবে। প্রতিটি অ্যারেস্টার স্থাপনে ৬ লাখ টাকার কাছাকাছি লাগবে। সারা দেশে লাইটার অ্যারেস্টার স্থাপন করতে মোটা অংকের অর্থের প্রয়োজন হবে। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে বজ্রপাতে ২০১১ সালে মারা গেছেন ১৭৯ জন, ২০১২ সালে ২০১ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১৪ সালে ১৭০ জন, ২০১৫ সালে ১৬০ জন, ২০১৬ সালে ২৬৩ জন, ২০১৭ সালে ৩০১ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৯ সালে ১৯৮ জন, ২০২০ সালে ২১১ জন, ২০২১ সালে ৩৬৩ জন এবং ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের ৪ মে পর্যন্ত বজ্রপাতে ৩৪২ জন মারা গেছেন। বজ্রনিরোধক যন্ত্র স্থাপন প্রকল্পের ব্যাপারে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। এর পরেই বজ্রনিরোধ যন্ত্র স্থাপনে জোরেসোরে কাজ করছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ ছাড়াই বিশেষ প্রয়োজনে ত্রাণ মন্ত্রণালয় টিআর এবং কাবিখা নীতিমালা সংশোধন করে ১৫ জেলায় বজ্রনিরোধ যন্ত্র ও দণ্ড স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এরইমধ্যে কাজ শেষের দিকে। আর ১২শ’ ৩২ কোটি টাকার প্রকল্প পাস ও অর্থ পেলেই একযোগে সারা দেশে বজ্রনিরোধক যন্ত্র স্থাপনের কাজ শুরু করা যাবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আসবে বলে আশাবাদী সচিব।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত