ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রাজ্যে একদিনের শোক পালন

ভারতে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত ২৮০

ভারতে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত ২৮০

ভারতের ওড়িশা রাজ্যে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় ২৮০ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৯ শতাধিক। ওডিশার মুখ্য সচিব প্রদীপ জেনা হতাহতের এ সংখ্যা জানিয়েছেন। গত শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে ওড়িশার বালাসোর জেলার বাহাঙ্গাবাজার এলাকায় তিনটি ট্রেনের সংঘর্ষে ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পর ট্রেনের ভেতর থেকে একের পর এক মরদেহ উদ্ধার করে আনা হয়। ভেতরে এখনো অনেকে আটকা পড়ে আছে বলে মনে করা হচ্ছে। তাই নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ওডিশা রাজ্যে গতকাল এক দিনের শোক পালন করা হয়। জানা গেছে, কলকাতাগামী বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস ট্রেনটি ওডিশার বাহাঙ্গাবাজার এলাকায় লাইনচ্যুত হয়ে পড়েছিল। চেন্নাইগামী শালিমার-চেন্নাই সেন্ট্রাল করমণ্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনটি ওই এলাকা পেরিয়ে যাওয়ার সময় লাইনচ্যুত ট্রেনের বগির সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এতে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। এ সময় করমণ্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনটির কয়েকটি বগি একটি পণ্যবাহী ট্রেনের বগির উপর আছড়ে পড়ে। দুর্ঘটনার পর উদ্ধার কাজে নামে ভারতের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রিলিফ ফোর্সের (এনডিআরএফ) সদস্যরা। তাদের সহায়তা করে ওড়িশা ডিজাস্টার র‌্যাপিড অ্যাকশন ফোর্সও। দুর্ঘটনার পর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে থাকেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, রাজ্যের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছেন।

এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুর্ঘটনার খবরে টুইটারে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘ওড়িশায় ট্রেন দুর্ঘটনায় আমি মর্মাহত।’ মোদি দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের প্রতি পরিবারকে ২ লাখ রুপি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। পাশাপাশি আহত ব্যক্তিদের ৫০ হাজার রুপি করে সহায়তা দেয়ার কথা বলেছেন তিনি। এছাড়া রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে ১০ লাখ রুপি ও গুরুতর আহত ব্যক্তিদের ২ লাখ রুপি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শোক ও আহত ব্যক্তিদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে টুইট করেছেন।

সর্বশেষ এ দুর্ঘটনাকে ভারতে সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এর আগে ২০১৩ সালে ওড়িশার জাজপুর জেলায় দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল করমন্ডল এক্সপ্রেস। এবারের দুর্ঘটনাস্থল থেকে সেটি ছিল মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে। এ দুর্ঘটনার কারণে অন্তত ১৮টি দূরগামী ট্রেন যাত্রা বাতিল করা হয়।

ট্রেনটির গতি ছিল ১২৭ কিমি. ঢুকেছিল ভুল লাইনে

ভারতের ওড়িশায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার ‘সম্ভাব্য’ কারণ জানা গেছে। দেশটির সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস জানিয়েছে, দুর্ঘটনায় দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেস ভুল লাইনে ঢুকে পড়ে। এখান থেকেই দুর্ঘটনার সূত্রপাত হয়। নাম গোপন রাখার শর্তে রেলওয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত শুক্রবার ওড়িশার বালেশ্বরের বাহানগর বাজার স্টেশনের লুপ লাইনে দাঁড়িয়েছিল একটি মালবাহী ট্রেন। ওই সময় চেন্নাইগামী করমণ্ডল ট্রেনের মূল লাইন দিয়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মূল লাইনে না গিয়ে এটি লুপ লাইনে ঢুকে পড়ে। দুর্ঘটনার সময় ১২৭ কিলোমিটার গতিতে এগিয়ে আসা করমণ্ডল এক্সপ্রেস অত্যন্ত জোরে মালবাহী ট্রেনকে ধাক্কা দেয়। তখন করমণ্ডল এক্সপ্রেসের কয়েকটি বগি ছিটকে পাশের আরেকটি মূল লাইনে গিয়ে পড়ে। এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিপরীত দিক থেকে বেঙ্গালুরু থেকে হাওড়াগামী সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস চলে আসে। লাইনের ওপর পড়ে থাকা করমণ্ডল ট্রেনের কয়েকটি বগিতে সজোরে ধাক্কা মারে সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস। এতেই সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

ভারতের খড়গপুর ডিভিশনের সিগন্যাল রুমের ভিডিওতে দেখা গেছে, বালেশ্বরের ওই স্টেশনের কাছে মোট চারটি লাইন রয়েছে। এর মধ্যে দুটি লুপ লাইন। আর বাকি দুটি মেইন লাইন। ভারতের রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, লুপ লাইন তৈরি করা হয় স্টেশন এলাকায়। মূলত ট্রেন চলাচল সহজ করতে এসব লুপ লাইন বানানো হয়। লুপ লাইন সাধারণত ৭৫০ মিটার লম্বা হয়, যেন কয়েকটি ইঞ্জিনসহ একটি বড় মালবাহী ট্রেন দাঁড়াতে পারে। তবে এখন এ লুপ লাইনের দৈর্ঘ্য বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে ভারতের রেলওয়ে।

ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা কি মানুষের ভুলে হয়েছে নাকি কোনো কারিগরি ত্রুটির কারণে হয়েছে সেটি এখনো নিশ্চিত নয়। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, মানুষের ভুলই এজন্য দায়ী। কারণ করমণ্ডল এক্সপ্রেস প্রথমে ভুল লাইনে প্রবেশ করেছিল। এরপর এটি লাইনচ্যুত হয়েছিল। তবে আরেকটি সূত্র বলছে, লুপ লাইনে ট্রেনটি দাঁড়ানো থাকলেও হয়তো এটির কয়েকটি বগি মূল লাইনের ওপর ছিল। আর ওই সময় মূল লাইন দিয়ে আসা করমণ্ডল এক্সপ্রেস ওই বগিগুলোতে সজোরে ধাক্কা মারে।

ওড়িশার ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা কীভাবে ঘটল?

রাজ্যটির বালেশ্বর জেলার এ ঘটনা চলতি শতাব্দীতে হওয়া ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা। গত শুক্রবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টার দিকে দুর্ঘটনাটি ঘটে। দুপুর ৩টার দিকে হাওড়ার নিকটবর্তী শালিমার স্টেশন থেকে ছাড়ে চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেস। এটি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ওড়িশার বালেশ্বরে পৌঁছায়। আধা ঘণ্টা পর বাহানগা বাজারের কাছে ২৩ কামরার ট্রেনটি দুর্ঘটনায় পড়ে। ওড়িশার চিফ সেক্রেটারি প্রদীপ জেনা ও কয়েকটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন এ দুর্ঘটনায় একটি মালবাহী ট্রেনও জড়িত বলে জানিয়েছে। তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এখনো এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

বিবিসি বলছে, একটি যাত্রীবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার পর পাশের লাইন ধরে বিপরীত দিক থেকে আসা আরেকটি ট্রেনের লাইনে পড়ে থাকা বগিগুলোকে সজোরে ধাক্কা দেয়। লাইনচ্যুত করমণ্ডল এক্সপ্রেসের বেশ কয়েকটি বগি পাশের ওই লাইনে পড়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে, সেখানে হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস এসে সেগুলোকে আঘাত করে।

ভারতীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মালবাহী ট্রেনও এ দুর্ঘটনায় জড়িয়ে আছে; কিন্তু তারা বিস্তারিত আর কিছু জানাননি।

বার্তা সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, হাওড়া যাওয়ার পথে বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসের কয়েকটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পাশের লাইনে গিয়ে পড়ে বলে এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। এই কর্মকর্তা বলেন, হওড়া থেকে চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেস এসে ওই লাইনের ওপর পড়ে থাকা বগিগুলোকে আঘাত করে, এতে এর বগিগুলোও লাইনচ্যুত হয়। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের লাইনচ্যুত বগিগুলো ছিটকে গিয়ে সেখানে আরেকটি লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মালবাহী ট্রেনের ওয়াগনগুলোকে আঘাত করে বলে জানান তিনি।

ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভি বিস্তারিত কিছু না জানিয়ে শুধু বলেছে, সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম প্রাণঘাতী এ দুর্ঘটনায় হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস, করমণ্ডল এক্সপ্রেস ও একটি মালবাহী ট্রেন জড়িত। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলেছে, চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ১০-১২টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পাশের লাইনে গিয়ে পড়ার পর পূর্ণ বেগে চলন্ত হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস সেগুলোকে আঘাত করে। আনন্দবাজার পত্রিকা স্থানীয় একটি সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, করমণ্ডল এক্সপ্রেসই একই লাইনে আগে চলতে থাকা একটি মালবাহী ট্রেনের পেছনে তীব্র গতিতে ধাক্কা মারে, সংঘর্ষের তীব্রতায় করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনটি মালবাহী ট্রেনটির উপরে উঠে যায়। করমণ্ডলের ২৩টি বগির মধ্যে ১৫টি লাইন থেকে ছিটকে পাশের ডাউন লাইন ও আশপাশে গিয়ে পড়ে।

ওই ডাউন লাইন দিয়ে তখন আসছিল বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস ট্রেন। এটি সোজা গিয়ে করমণ্ডলের লাইনচ্যুত বগিগুলোর উপর গিয়ে পড়ে। এতে হাওড়াগামী ট্রেনটিরও দুটি বগি লাইনচ্যুত হয়।

করমণ্ডলের বেঁচে যাওয়া যাত্রী প্রশান্ত মণ্ডল ঘটনাস্থল থেকে ফোনে আনন্দবাজারকে জানিয়েছেন, তিনি উল্টেপড়া বগি থেকে বেড়িয়ে একটি রেলগেট দেখতে পান, সেখানে একজন পুলিশ ছিল। এই পুলিশ জানান, সিগন্যাল না পেয়ে মালবাহী ট্রেনটা দাঁড়িয়েছিল, তখন করমণ্ডল সজোরে এর পেছনে ধাক্কা মারে।

আনন্দবাজার বলছে, করমণ্ডলের ইঞ্জিন ওই মালবাহী ট্রেনের ওপর উঠে পড়েছে, তা শুধু প্রচণ্ড জোরে সরাসরি ধাক্কা মারলেই সম্ভব এবং প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশের বয়ানও তেমনটিই বলছে।

উদ্ধার অভিযান শেষ

ভারতের ওড়িশায় দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনগুলোতে চালানো উদ্ধার অভিযান শেষ হয়েছে। বর্তমানে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করাসহ অন্যান্য কাজগুলো চলছে বলে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী অশিনি বৈষ্ণ। এছাড়া আহতদের দেখতে ওড়িশায় যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয় সেনাবাহিনীর একটি, ন্যাশনাল ডিজেস্টার রেসপন্স ফোর্সের সাতটি, ওড়িশা ডিজেস্টার র‌্যাপিড অ্যাকশন ফোর্সের পাঁচটি দল এবং ফায়ার সার্ভিস ও ইমার্জেন্সির ২৪টি ইউনিট। এছাড়া ভারতীয় বিমানবাহিনীর এম-১৭ হেলিকপ্টারও মোতায়েন করা হয়।

ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ওড়িশার বালেশ্বর জেলায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গতকাল দুর্ঘটনাস্থল বাহাঙ্গা বাজার পরিদর্শনে গিয়ে মমতা এ ঘোষণা দেন।

মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের যারা আছেন, তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে ৫ লাখ রুপি, গুরুতর আহতদের ১ লাখ রুপি এবং আহতদের ৫০ হাজার রুপি করে সহায়তা দেবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার।

পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। রাজ্যের যারা আহত হয়েছেন, প্রয়োজনে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে তাদের চিকিৎসা করানো হবে বলে ঘোষণা দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

গতকাল বেলা ১১টা ৩৯ মিনিটে বাহাঙ্গা বাজারের দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। ঘটনাস্থলে পৌঁছে অশ্বিনী বৈষ্ণবের সঙ্গে কথা বলেন মমতা। এ সময় যথাযথ তদন্তের আহ্বান জানান তিনি। পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘রেলের মনে হয় সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। আরো যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন।’ এ সময় কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রীও তার পাশে ছিলেন।

দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনে ছিলেন বাংলাদেশিরাও

ওড়িশার বালেশ্বরে দুর্ঘটনার কবলে পড়া করমণ্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনটিতে বাংলাদেশিরাও ছিলেন। তাদের সংখ্যা ঠিক কত, তা জানা না গেলেও অন্তত ১৫ বাংলাদেশি যাত্রীকে দুর্ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। বাংলাদেশি যাত্রীদের খোঁজ নিতে কলকাতাস্থ বাংলাদেশের উপ-দূতাবাসের তিন সদস্যের একটি দল রওনা হন ওড়িশার পথে। বাংলাদেশের বহু মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। তাদের কেউ কেউ চিকিৎসা করান কলকাতায়, অনেকে চলে যান চেন্নাই-বেঙ্গালুরুতে। এ ধরনের বাংলাদেশি ভ্রমণকারীরা সাধারণত করমণ্ডল এক্সপ্রেসে যাতায়াত করেন। ফলে ট্রেনটি দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার খবরে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশিদের মধ্যেও। অনেকেই নিকটাত্মীয়দের খোঁজখবর নিতে শুরু করেন। তাদের সুবিধার্থে একটি হটলাইনও চালু করেছে কলকাতাস্থ বাংলাদেশের উপ-দূতাবাস।

দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনটিতে কতজন বাংলাদেশি ছিলেন, তাদের কী অবস্থা তা জানতে ঘটনাস্থলে তিন সদস্যের একটি দল পাঠানো হয়েছে উপ-দূতাবাস থেকে।

উদ্বেগ বাড়ছে বাংলাদেশিদের মধ্যে

বাংলাদেশের ময়মনসিংহের বাসিন্দা মিনাজ উদ্দিন ছিলেন করমণ্ডল এক্সপ্রেসে। চেন্নাই যাচ্ছিলেন চিকিৎসার জন্য। কিন্তু শুক্রবার সন্ধ্যায় ভয়াবহ দুর্ঘটনার সাক্ষী হন তিনি। দুর্বিষহ সেই অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে মিনাজ উদ্দিন বলেন, আমি করমণ্ডল এক্সপ্রেসের বি-৩ কামরায় ছিলাম। এত বড় ট্রেন দুর্ঘটনা আগে কখনো দেখিনি। আমাদের আগের কামরা পুরো দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। সেখানে যেসব বাঙালি ছিলেন, তাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে আহতদের মধ্যে দুই বাংলাদেশি নাগরিকের সন্ধান পাওয়া গেছে। তারাও চিকিৎসার জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে চেন্নাই রওয়ানা হয়েছিলেন। দুর্ঘটনায় দুজনই মারাত্মকভাবে আহত হন। তাদের উদ্ধার করে ওড়িশার বালেশ্বরের ফকির মোহন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়। পরে সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কটকের শ্রীরাম চন্দ্র ভঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।

ফকির মোহন মেডিক্যাল কলেজের অর্থোপেডিক বিভাগের চিকিৎসক টি সুরেশ কুমার গুপ্তা বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত হয়ে দুই বাংলাদেশি আমাদের এখানে ভর্তি হন। দুজনের শরীরের নিচের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ত্বকের অবস্থা ভালো নয়। যদিও তাদের নাম-পরিচয় এখনো সঠিকভাবে জানা যায়নি। কারণ দুর্ঘটনার পর দুজনই অচেতন হয়ে পড়েন। তবে তাদের মধ্যে একজন এতটুকু বলতে পেরেছেন, তারা দুজনেই বাংলাদেশের বাসিন্দা। তবে ওড়িশার রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এখনো এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য জানানো হয়নি। ওড়িশায় ট্রেন দুর্ঘটনার পর সারি সারি লাশ আর অন্ধকারে ভেসে আসা আর্তনাদে ভড়কে গেছেন উদ্ধার কাজে হাত বাড়ানো ব্যক্তিরাও। ‘তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ বিকট শব্দের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন আমার উপড়ে এসে হুড়মুড়িয়ে পড়ে; কোনোভাবে সেখান থেকে বের হয়ে দেখি অনেকে আটকে আছে বেশকিছু কোচের নিচে, যাদের গগনবিদারী আর্তনাদ আর চিৎকার কেবল চারিদিকে,’ বলছিলেন ভারতে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া করমণ্ডল এক্সপ্রেসের যাত্রী স্বপন কুমার।

স্বপনের মতো অনেকে ভয়াবহ সেই মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছেন শুক্রবার রাতে; সারি সারি লাশ আর অন্ধকারে ভেসে আসা আর্তনাদে ভড়কে গেছেন উদ্ধার কাজে হাত বাড়ানো ব্যক্তিরাও।

রক্তদানের জন্য হাসপাতালে ভিড়

ওড়িশায় ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। আহত কমপক্ষে ৯০০ জনকে দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা। বিপুল এসব আহত মানুষের জন্য দরকার রক্ত। ভারতের সংবাদ সংস্থা এএনআই বলছে, আহতদের জন্য রক্ত দিতে স্থানীয় হাসপাতালগুলোয় ভিড় করছেন স্থানীয়রা। ওড়িশার মুখ্যসচিব প্রদীপ জেনা বলেন, ‘ মানুষ স্বেচ্ছায় রক্ত ??দিতে আসছেন। আমি অনেক জায়গা থেকে অনুরোধ পাচ্ছি। এটা একটা ভালো লক্ষণ। দুর্ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত স্থানীয় মানুষরা রক্ত ??দিচ্ছেন। দাতাদের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন সাধারণ ভারতীয়রাও। রবি দিয়োরা নামে একজন টুইটারে লেখেন, ‘এ কারণেই ভারত অন্যতম সেরা দেশ। আমাদের রক্তে সংস্কৃতি, নৈতিকতা রয়েছে। আপনারা যারা রক্ত দেয়ার জন্য লাইনে অপেক্ষা করছেন, তাদের জন্য আমরা গর্বিত। আরেকজন টুইটারে লেখেন, ‘তাদের জন্য শ্রদ্ধা। মানবতা যখন জেগে ওঠে, অন্ধকারে তখন আশার আলোর খোঁজ মেলে।’ পবন মালহোত্রা নামে একজন লেখেন, ‘ট্র্যাজেডির মধ্যে নিঃস্বার্থতা এবং সহানুভূতির জন্য বালাসোরের বাসিন্দাদের জন্য গর্বিত। আপনার এই রক্তদানে অনেক জীবন বাঁচাবে।’

রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব গতকাল বালাসোরে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখতে উচ্চ-পর্যায়ের তদন্ত পরিচালিত হবে। রেল নিরাপত্তা কমিশনারও একটি স্বাধীন তদন্ত করবেন।’

সূত্র : বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত