ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস

মাদক পাচারের নিরাপদ রুট!

মাদক পাচারের নিরাপদ রুট!

নতুন নতুন পদ্ধতি বের করে নানা মাধ্যমে মাদক পাচার নিয়ে সক্রিয় থাকে কারবারিরা। এর মধ্যে একটি জনপ্রিয় মাধ্যম কুরিয়ার সর্ভিস। দেশের বড়-ছোট বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করে মাদক পাচারের অভিযোগও পুরোনো। কিন্তু এর মধ্যে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস দিন দিন যেনো মাদক পাচারের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে।

মাদক নিয়ে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিরো টলারেন্সের কারণে কঠোর নজরদারির মধ্যে প্রায় মাদকের চালন আটক হয় বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসের সার্ভিস পয়েন্ট থেকে। এর মধ্যে অন্যতম সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস।

সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, বছরের পর বছর কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় পৌঁছে যাচ্ছে মাদকদ্রব্য। কুরিয়ার থেকে মাদকের একাধিক চালান আটকের মধ্যদিয়ে সংশ্লিষ্টরা নড়ে চড়ে বসেন। দৃষ্টি রাখছেন এসব মাধ্যমেও।

কুরিয়ারে মাদক পাচারের ঘটনায় মাঝেমধ্যে মাদকের কিছু চালান ও চালানদার ধরা পড়লেও মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কুরিয়ার সার্ভিসগুলোকে আরো সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিশেষ করে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের নাম উঠে আসে বার বার। কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি- যখনই তাদের কোনো এজেন্ট বা কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পাচ্ছে, দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে।

কুরিয়ার সার্ভিসে কোনো পণ্য পাঠানোর আগে ভালো করে যাচাই করার কথা থাকলেও কুরিয়ার কোম্পানিগুলোর কিছু অসাধু কর্মচারী ও কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে মাদকপাচার বন্ধ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন কুরিয়ার সংশ্লিষ্ট ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। গত কয়েক বছরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফেনী, কক্সবাজার, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশালে সুন্দরবনসহ বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিস থেকে ইয়াবা, হেরোইন ও গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকের চালান আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসব ঘটনায় প্রাপক গ্রেপ্তার হলেও প্রেরক সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে। প্রেরকদের ঠিকানাগুলো সবসময় ভুয়া থাকে। এমনকি মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে খুঁজেও প্রেরককে পাওয়া যায় না।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে অভিযোগ রয়েছে, কুরিয়ারের কর্মী বা তাদের এজেন্টরা মাদক পাচারে জড়িত। আরো অভিযোগ রয়েছে- সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে একাধিকবার মাদকসহ নানারকম অবৈধ পণ্য ধরাপরলেও শাস্তি না হওয়ায় অন্যরা সাহস পায়। ফলে প্রতিষ্ঠানটি মাদক পাচারের অন্যতম নিরাপদ বাহন হিসেবে জমজমাট ব্যবসা করছে।

এদিকে সর্বশেষ গত ৫ মে মতিঝিলের ৫ নম্বর দিলকুশা এলাকার সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে অভিযান চালিয়ে ৫০ হাজার পিস ইয়াবাসহ এক মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। গ্রেপ্তারকৃত মাদক কারবারি সাইফুল ইসলাম সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে স্কুল ব্যাগের আড়ালে ইয়াবা সরবরাহ করছিলেন। জানা গেছে, আগেও তিনি নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে কুরিয়ার সার্ভিসে মাদক আনা-নেয়া করেছেন।

২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর দারুসসালাম থানাধীন কল্যাণপুরের সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস থেকে বিপুল পরিমাণ মাদক এবং অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় আটক করা হয় নারায়ণগঞ্জের গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবদুল জলিল মাতবরকে। সুন্দরবন কুরিয়ারের পার্সেল থেকে একটি দেশি পিস্তল, ৪০ রাউন্ড পিস্তল ও রাইফেলের গুলি, ৫ হাজার ২৮৯ পিস ইয়াবা, ১ কেজি ৩০০ গ্রাম গাঁজা, ৯ ক্যান বিয়ার ও ৪০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করা হয়।

২০২০ সালের ৩১ আগস্ট সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আসবাবপত্রের আড়ালে কুমিল্লা থেকে ৫১ কেজি ৯০০ গ্রাম গাঁজা রাজশাহী পৌঁছলে র‌্যাবের হাতে সেগুলো জব্দ হয়। অভিযান চালিয়ে আটক করা হয় ছয়জনকে।

গত ২০১৮ সালের ২৬ আগস্ট রাজধানীর মতিঝিলে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস থেকে ৪০ হাজার পিস ইয়াবা রিসিভ করার সময় র‌্যাব-১০ এর অভিযানে ধরা পড়ে চার ইয়াবা চোরাকারবারি। আটক চারজন হলো- আরিফ, ফোরকান, রুবেল ও আবু নাইম। তারা কক্সবাজার থেকে পাঠানো ইয়াবা মতিঝিলে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস থেকে রিসিভ করতে এসে গ্রেপ্তার হয়। ক্রিমের ৪০টি কৌটায় করে ইয়াবাগুলো ঢাকায় আনা হয়েছিল। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিশেষ অভিযান চালিয়ে মতিঝিলে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস থেকে ইয়াবাগুলো জব্দ করেছিল র‌্যাব।

তখন র‌্যাব জানায়, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ইয়াবাগুলো পাঠানো হয়েছে চট্টগ্রাম থেকে। প্যারাশুট ও ভাটিকা কসমেটিক্সের কৌটার মধ্যে কৌশলে ইয়াবার প্যাকেট রেখে পাচার করা হয়েছিল। প্রতিটি কৌটায় রাখা হয়েছিল ১ হাজার পিস ইয়াবা। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব সদস্যরা আগে থেকেই কুরিয়ার অফিসের সামনে অবস্থান নেন এবং ইয়াবার ওই চালান গ্রহণ করার সময় হাতেনাতে চারজনকে আটক করেন তারা।

২০২০ সালের ১৫ জুন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকায় আনা হয় আমভর্তি কার্টন। আমের আড়ালে হেরোইনের বড় চালান আসার খবর পেয়ে এলিফ্যান্ট রোডে তল্লাশি চৌকি বসায় র‌্যাব-২। সেখানে আটক করা হয় হাবিবুর রহমান (২৯) ও দিলরুবা দিপা (২৯) দম্পতিকে। উদ্ধার করা হয় আধা কেজি হেরোইন।

এর আগে ২০১৯ সালে ৯ এপ্রিল কক্সবাজার থেকে ইয়াবার বড় একটি চালান রাজশাহী আসে এসএ পরিবহন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। জয়পুরহাটের দুই ভাই সেই ইয়াবা কুরিয়ার সার্ভিস থেকে তুলে নেয়ার সময় নগরীর ভদ্রা বাসস্ট্যান্ড থেকে তাদের আটক করে র‌্যাব।

ওই বছরের ১৯ মে রাজধানীর উত্তরায় এসএ পরিবহনের অফিস থেকে ১ লাখ পিস ইয়াবা জব্দসহ দুই মাদক কারবারিকে হাতেনাতে আটক করে র‌্যাব।

একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর রাজধানীর কাকরাইল থেকে ৯ হাজার ২০০ পিস ইয়াবাসহ আন্তঃজেলা মাদক ব্যবসায়ী চক্রের দুই সদস্যকে আটক করে র‌্যাব।

কুরিয়ারে মাদক পাচার বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সরকারী পরিচালক মো. মেহেদী হাসান জানান, বিভিন্ন সময় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযানে কুরিয়ার সার্ভিসে মাদকের চালান আটক করা হয়ে থাকে। তিনি জানান, গত ৫ মে মতিঝিলের ৫ নম্বর দিলকুশা এলাকার সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে অভিযান চালিয়ে ৫০ হাজার পিস ইয়াবাসহ এক মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। গ্রেপ্তারকৃত মাদক কারবারি সাইফুল ইসলাম সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে স্কুল ব্যাগের আড়ালে ইয়াবা সরবরাহ করছিলেন। জানা গেছে, আগেও তিনি নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে কুরিয়ার সার্ভিসে মাদক আনা নেয়া করেছেন। সন্ধ্যার পর থেকে রাতে চালানো অভিযানে এসব ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। একটি বস্তায় করে আসা ৫০টি স্কুলব্যাগ তল্লাশি করে উদ্ধার করা হয় ইয়াবাগুলো। এ ঘটনায় সাইফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে স্কুল ব্যাগের আড়ালে এসব ইয়াবা আনা হয়। মেহেদী হাসান আরো বলেন, বস্তার ভেতর ব্যাগের মাঝখানে বিশেষভাবে লুকায়িত অবস্থায় স্বচ্ছ পলিথিনের বড় প্যাকেটের মধ্যে ২৫০টি নীল রঙের জিপার, প্রতি প্যাকেটের ভেতর ২০০ পিস করে মোট ৫০ হাজার পিস মিথাইল অ্যামফিটামিনযুক্ত ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়েছে, যার ওজন ছিল ৫ হাজার গ্রাম।

সুন্দরবন কুরিয়ারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা জানান, ‘সারাদেশে তাদের পাঁচশ’র বেশি এজেন্ট ও ব্রাঞ্চ রয়েছে। যখনই যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদের এজেন্ট থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এমনকি একজন জিএমের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তাকেও চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের শতভাগ সত্যতা মেলেনি। তারপরও তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।’ তিনি জানান, তাদের কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী ও সোনাইমুড়িতে অনেক এজেন্টকে বাদ দেয়া হয়েছিল।

সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান পুলকের বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত