ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আইনি জটিলতায় রাজউক

উদ্ধার করা যাচ্ছে না ৫৫৬ কাঠা জমি

উদ্ধার করা যাচ্ছে না ৫৫৬ কাঠা জমি

আইনি জটিলতার কারণে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ৫৫৬ কাঠা জমি উদ্ধার করা যাচ্ছে না। মামলা সংক্রান্ত জটিলতায় দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে থেমে আছে দখলবিরোধী অভিযান। কিছু জমি উদ্ধার হলেও দফায় দফায় নিলামের দরপত্র আহ্বান করেও উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ায় নিলামেও জমি বিক্রি করতে পারছে না রাজউক। ফলে সেই উদ্ধার করা জমিও এখন বেদখল হয়ে গেছে। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বেদখল রয়েছে ওইসব জমি।

রাজউকের চেয়ারম্যান মুখলেচুর রহমান মিয়া বলেছেন, আইনি নানা জটিলতার কারণে উদ্ধার অভিযান চালানো যাচ্ছে না ওই জমিতে। তবে জমি উদ্ধারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমরা আশা করছি খুব দ্রুতই উদ্ধার অভিযান শুরু করব।

রাজউকের হিসাব অনুযায়ী, বেদখল হওয়া জমির দাম হাজার কোটি টাকার উপর। তবে স্থানীয়রা বলছেন, বাস্তবে ওই জমির দাম ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

রাজউক বলছে, ৫৫৬ কাঠা জমির মূল্য ১ হাজার ৬৭০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এ হিসাব করা হয়েছে প্রতি কাঠা ৩ কোটি টাকা মূল্য ধরে। তবে মতিঝিলের প্লট মালিকরা জানিয়েছেন, বাস্তবে ওই এলাকায় জমির দাম ১০-১৫ গুণ বেশি। অর্থাৎ প্রতি কাঠা জমির দাম অন্তত ৩০-৪০ কোটি টাকা। এ হিসাব ধরলে মতিঝিলে রাজউকের বেদখল জমির মূল্য দাঁড়ায় ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা। প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলে রাজউকের ওই ৫১টি বাণিজ্যিক প্লট আদৌ অবৈধ দখলমুক্ত হবে কি না এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

সরেজমিন দেখা যায়, বেদখল প্লটগুলো রয়েছে মতিঝিলের সম্প্রসারিত এলাকায়। বিভিন্ন আকৃতির মোট ৫৩টি প্লট রয়েছে সেখানে। এর মধ্যে কেবল দুটি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বাকি ৫১টি প্লটই বেদখলে চলে গেছে; যেখানে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ দোকানপাট, বিভিন্ন অফিস ও গাড়ির গ্যারেজ। বেদখলকৃত প্লটগুলোতে বিভিন্ন নামে সাইনবোর্ড লাগানো রয়েছে। প্রায় ১৫০ স্থাপনা রয়েছে রাজউকের ওই জমিতে। এগুলো থেকে মূলত রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতারা ভাড়া তোলেন। বরাদ্দ দিতে না পারা প্লটগুলো কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়াই বছরের পর বছর ফেলে রেখে রাজউকই অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের সুযোগ করে দিয়েছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে এতগুলো প্লট বেদখলের পেছনে রাজউক কর্মকর্তাদের অসাধু মানসিকতাই দায়ী। শিগগিরই সেগুলো দখলে নিয়ে সরকারকে আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানোর তাগিদ দিয়েছেন তারা। তবে রাজউকের দাবি, কাঙ্ক্ষিত দর না পাওয়ায় প্লটগুলো বরাদ্দ দেয়া হয়নি।

রাজউকের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের হিসাবসংক্রান্ত কমপ্লায়েন্স অডিট প্রতিবেদনে বেদখল প্লট নিয়ে আপত্তি তুলেছে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল বাংলাদেশ (সিএজি)। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে, তারা জানিয়েছে, মতিঝিলে রাজউকের ৫৫৬ দশমিক ৮১ কাঠা বাণিজ্যিক প্লট বেদখল অবস্থায় রয়েছে। এসব জমিতে অবৈধ দোকান, স্থাপনা, গাড়ির গ্যারেজ, বাস কাউন্টার ইত্যাদি নির্মাণের সুযোগ করে দেয়ায় প্রতিবেদনে রাজউক কর্মকর্তাদের দায়ী করে বলা হয়েছে, প্লটগুলো দখলমুক্ত করার জন্য রাজউক যথাসময়ে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান রাজউক। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মতিঝিলে প্লট বেহাতের বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়টির সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘নিরীক্ষা প্রতিবেদনের আলোকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় বেদখল প্লটগুলো উচ্ছেদের ব্যাপারে শিগগিরই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

স্থানীয় একজন দোকানি জানান তারা স্বাধীনতা লাভের আগে ঢাকায় এসেছেন। সেই থেকেই মতিঝিলেই থাকেন। এক সময় এখানে (রাজউকের পড়ে থাকা প্লট) নৌকা দিয়ে চলাচল করতাম। এদিকে যে জমিগুলো আছে, প্রকৃত ম্যাপে দেখা যাবে বেশিরভাগই খাস। অবৈধভাবে দখলে নিয়ে দোকানপাট তুলে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন স্থানীয় নেতারা। সরকার অভিযান চালালে প্রায় সব দোকানই ভাঙা পড়বে।’

বেদখল প্লট উদ্ধার করে পরিকল্পিতভাবে ভূমি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. খন্দকার সাব্বির আহমেদ। তিনি বলেন, ‘গত দেড় দশকে রাজধানীর অন্যান্য এলাকায় বাণিজ্যিক এরিয়া বাড়ায় মতিঝিলের একক নির্ভরতা অনেকটাই কমে আসে। হয়তো সে কারণে প্লট বরাদ্দ না দেয়ার যুক্তিটা আমরা মেনে নিতে পারি। কিন্তু সেই প্লটগুলো বেদখল থাকবে, স্থাপনা নির্মাণ করে অন্যরা আর্থিকভাবে লাভবান হবে এটা কোন যুক্তিতে মেনে নেব? রাজউককে অবশ্যই অতিদ্রুত প্লটগুলো দখলমুক্ত করে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করতে হবে। ভালো হয় এখানে যদি মিশ্র ভূমি ব্যবহার করা যেতে পারে।’

এত বিশাল অঙ্কের জমি বেদখল থাকা রাজউকের সক্ষমতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে বলে মন্তব্য করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ‘রাজউকের নাকের ডগায় যদি তারা বেদখল প্লট উদ্ধার করতে না পারে তাহলে বৃহত্তর ঢাকার দায়িত্ব পালন করবে কীভাবে? সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি অবশ্যই নতুন করে ভাবতে হবে। তাছাড়া রাজউকের হিসাবে যে প্লটের মূল্য ৩ কোটি টাকা, সেটার মূল্য কীভাবে ৪০ কোটি পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে, এটাও ভাবার বিষয়।

রাজউকের একজন কর্মকর্তা বলেন, জমি উদ্ধারে ব্যর্থ রাজউক বেশ বিপাকেই পড়েছে। নিলামের মাধ্যমে প্লট বিক্রির উদ্যোগ নিলেও ক্রেতা পাওয়া যায়নি। বরং এই জমিতে ক্ষমতার দাপটে যে যেভাবে পারছে দোকানপাট তুলে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, এক সময় মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার পূর্বদিকে (ওয়াপদা ভবন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে) ডোবা-নালা ও সেগুনবাগিচা খাল ছিল। নব্বই দশকে খালের ওপর বক্স কালভার্ট তৈরি করে ঢাকা ওয়াসা। এই বক্স কালভার্টের দুই পাশের জমি নিজেদের দাবি করে ‘মতিঝিল সম্প্রসারিত বাণিজ্যিক এলাকা’ প্রকল্প হাতে নেয় রাজউক। সে অনুযায়ী প্রায় অর্ধশত বাণিজ্যিক প্লটের লে-আউট প্ল্যানও তৈরি করা হয়। কিন্তু মূল্যবান এই জমি বেদখল হয়ে যাওয়ায় রাজউকের প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি।

সরেজমিন দেখা গেছে, ‘মতিঝিল সম্প্রসারিত বাণিজ্যিক এলাকা’ প্রকল্পের বেশিরভাগ জমি বেদখল হয়ে আছে। শতাধিক টিনের দোকানে গাড়ি মেরামতের ওয়ার্কশপ খোলা হয়েছে। সাদেক হোসেন খোকা কমিউনিটি সেন্টারের বিপরীতের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক বলেন, ‘ঢাকা শহরের এত দামি এলাকায় রাজউকের জমি কারা দখল করতে পারে বোঝেন না? ১০ বছরেও বেশি সময় ধরে এখানে ব্যবসা করছি। এ জমি রাজউকের। কিন্তু নেপথ্যে অনেক ক্ষমতাবান লোক থাকায় রাজউক তার জমি দখলে নিতে পারছে না।’

জানা গেছে, কয়েকবার চেষ্টা করেও জমি উদ্ধার করা যায়নি। সর্বশেষ ২০১৫ সালে প্রকল্পের প্লটগুলো বিক্রির জন্য নিলামের উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। সে বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ৩৯টি বাণিজ্যিক প্লট বাংলাদেশি আবাসিক ও অনাবাসিক নাগরিকদের মধ্যে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিতে সংবাদপত্রে নিলামের বিজ্ঞাপন দেয় রাজউক।

রাজউক সূত্র আরো জানিয়েছে, নিলামে ডাকা জমির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রতি কাঠা প্রায় আড়াই কোটি টাকা। ৫৫৬ কাঠা জমির মধ্যে ৪১৩ কাঠা জমির নিলামের জন্য দরপত্র ডাকা হয়ে ছিল। তখন কাঠাপ্রতি মূল্য আড়াই কোটি হিসাবে দাম হাজার কোটি টাকার ওপর ছিল। কিন্তু বর্তমানে এ জমির দাম আরো বেশি বলে মন্তব্য করেছেন রাজউকের ভূমি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

মতিঝিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় প্লট নিয়ে মানুষের অনাগ্রহ সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা অনুসন্ধান করে জানতে পেরেছি, প্লটগুলো বেদখল থাকার কারণেই কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছে না।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত