কোরবানির পশু সংগ্রহে এখন ব্যস্ত পাইকাররা

প্রকাশ : ১১ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচএম ফারুক

কোরবানির ঈদ সামনে রেখে পশু সংগ্রহে ব্যস্ত পাইকাররা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন গ্রাহকের চাহিদানুযায়ী কোরবানির পশু সংগ্রহে। এদিকে কোরবানি ঈদে পশুর চাহিদা মাথায় রেখে গরুসহ কোরবানির অন্যান্য পশুর খামারিরা স্বপ্ন দেখছেন লাভের। সে লক্ষ্যে পশু পালন এবং মোটাতাজাকরণে ঝুঁকেন অন্তত ৭ লাখ খামারিসহ ২০ লাখ কৃষক পরিবার। তবে কিছু কিছু খামারি কোরবানির পশুর ভালো দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন। মূল্যস্ফীতির কারণে পশুর খাবারের দামের কারণে হৃষ্টপুষ্ট করতে খরচ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। এ অবস্থায় সঠিক দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত খামারিরা।

কোরবানির পশু পালন, বিক্রি ও মনিটরিংয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এবং ঢাকার বাইরে কয়েকটি জেলায় খোঁজখবর নিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে।

আব্দুল জব্বার নামে একজন পাইকার জানান, তিনি বেশ কয়েক বছর গ্রাম এলাকার প্রান্তিক কৃষক ও খামারিদের কাছ থেকে ও গরুসহ কোরবানির অন্যান্য পশু সংগ্রহ করে ঢাকায় বিক্রি করেন। তিনি এবার ময়মনসিংহ এলাকায় বেশি সময় দিচ্ছেন। সেখান থেকে অন্তত ১০ ট্রাক গরু (প্রতি ট্রাকে ১০-২০টি) আনার টার্গেট নিয়ে খামারে খামারে ছুটে যাচ্ছেন। তার দেয়া তথ্যানুযায়ী এমন আরো অর্ধশতাধিক পাইকারি পশু ব্যবসায়ী ছুটে বেড়াচ্ছেন ময়মনসিংহ এলাকায়। তারা কেউ ১-২ ট্রাক, আবার কেউ ৫-৭ ট্রাক, কেউ আবার ১০-২০ ট্রাক পশু ঢাকার বাজারে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন খামারে এবং প্রান্তিক কৃষকদের কাছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত রমজানের ঈদের পর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তদর থেকে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তারা খামারিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোরবানির পশুর উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি তালিকা তৈরির কাজ করছেন।

তাদের দেয়া তথ্যানুয়ায়ী আসন্ন কোরবানির ঈদ সামনে রেখে সারা দেশে প্রায় সাত লাখ খামারি গবাদি পশু পালন করেছেন। তারা জানিয়েছেন- ১৪০০ টাকার পশুখাদ্য এখন ৩২০০ থেকে ৩৩০০ টাকা। পশুর খাদ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় এবার কোরবানি পশুর দাম বেশি হতে পারে। একই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও।

দেশের উত্তরের জেলা নীলফামারীর খামারিরা জানিয়েছেন তাদের অধিকাংশ প্রান্তিকসহ বড় খামারের পশুগুলো হৃষ্টপুষ্ট হয়ে বাজারে তোলার উপযুক্ত হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে অনেকে তাদের পশু বাজারে তুলেছেনও। এবার পশুর দাম বেশি হওয়ায় লাভের পরিমাণ কম হবে। তবে শেষ মুহূর্তে বেচাকেনা ভালোই হবে বলে জানান খামারিরা। নীলফামারীতে প্রতিবারের মতো এবারও চাহিদার চেয়ে বেশি গরু রয়েছে খামারিদের কাছে। প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার গরু দেশের অন্যান্য জেলায় পাঠানো হবে। খামারিরা আরো জানান, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে খুদের ভাত, আলু, খেসারি, মসুর, চিটাগুড়, লবণ, খড় ও ধানের গুঁড়া খাইয়ে গরু মোটাতাজাকরণ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এবার জেলায় প্রায় ২ লাখ ৯৮৯টি গরু পালন করেছেন খামারিরা। এসব গরু পালনে তাদের কর্মীরা মাঠপর্যায়ে খামারিদের পরামর্শ দিয়েছেন। তারা খামারিদের নিয়ে নিয়মিত উঠান বৈঠক করেছেন।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মোনাক্কা আলী বলেন, কোরবানির ঈদে নিরাপদ মাংস যাতে মানুষ পায়, সেজন্য আমরা মাঠপর্যায়ে খামারিদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। তিনি জানান- নীলফামারী জেলায় প্রান্তিকসহ ছোট-বড় খামারি রয়েছেন ৩০ হাজার ৬৮৮ জন। লক্ষ্মীপুর জেলার একজন পশু খামারি জানান, তাদের বাড়িতে কোরবানির জন্য ৩০টির বেশি গরু আছে। তবে পশু খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় তারা দুশ্চিন্তায় আছেন। ১৪০০ টাকার পশুখাদ্য এখন ৩২০০ থেকে ৩৩০০ টাকা। আবার পশু চিকিৎসার ওষুধের দামও আকাশছোঁয়া। তাই গরুর দাম এবার অনেকে বেশি হতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। অপর একজন ব্যবসায়ী জানান, পার্শ্ববতী দেশ বা চোরাই পথে পশু না আনা হলে ক্ষুদ্র খামারিরা লাভবান হবেন। তারা স্বাভাবিক খাবার দিয়ে পশু মোটাতাজা করছেন।

ঠাকুরগাঁওয়ে প্রান্তিক কৃষক ও ছোট খামারিরাও কিছুটা বাড়তি লাভের আশায় গরু লালন-পালন করেছেন। জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্য মতে, জেলার পাঁচটি উপজেলায় ৪ হাজার ৩১৭ জন পারিবারিক ও বাণিজ্যিকভাবে খামারে গবাদিপশু পালন করছেন। আর এ থেকে ৬৯ হাজার পশু উৎপাদিত হবে যা চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত। তবে ভালো দিক হলো ক্ষতিকর ইনজেকশন ও ট্যাবলেট ব্যবহার না করে দেশীয় পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজা করছেন খামারি ও কৃষকরা।

খামারি শামীম মিয়া বলেন, ‘আমি বহুদিন যাবত খামার করে আসছি। এ বছর ভালো করে প্রস্তুতি নিয়েছি। আমার খামারে এখন দেশি গরু ১০-১১টি রয়েছে। আমরা যারা ছোটখাটো খামারি আছি, তারা খুব বেশি একটা লাভবান হতে পারি না। কারণ সব জিনিসের দাম বেশি। বেশি দাম দিয়ে খাবার কিনে খাওয়ালে বেশি একটা লাভবান হওয়া যায় না। এজন্য আমরা প্রাকৃতিক সব খাবার খাওয়াচ্ছি।

অনন্যা ফার্মের স্বত্বাধিকারী হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ বলেন, ‘এখানে আমি তিনটি গরু নিয়েছি চার মাস আগে মোটাতাজা করার জন্য। এক একটা গরু প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা করে কেনা। ঈদের আগে শেষ মুহূর্তে গরু মোটাতাজা করছি। যদি ইন্ডিয়ান গরু না আসে তাহলে আমরা একটু লাভবান হতে পারব। সরকারের কাছে আবেদন ঈদের আগে যেন ইন্ডিয়ান গরু বাংলাদেশে না ঢুকে, তাহলে ছোটখাটো খামারিরা লাভবান হতে পারবে।

আরেক খামারি সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘এ এলাকায় বেশিরভাগ খামারি দেশীয় পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজা করছেন। সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতিতে ঘাস-খড়ের পাশাপাশি খৈলগুঁড়া ও ভুসি খাওয়ানো হচ্ছে। গোখাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে গরুতে লাভ কিছুটা কমে গেছে। গতবার চারটি গরু বিক্রি করে প্রায় ৫০ হাজার টাকা লাভ হয়েছিল। এ বছর কোরবানি উপলক্ষে সাতটি গরু পালন করছি। আশা করি এবারও ভালো দাম পাবো।’

ঠাকুরগাঁও জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে ঠাকুরগাঁও জেলায় ৪ হাজার ৩১৭ জন পারিবারিক ও বাণিজ্যিকভাবে খামার পরিচালনা করছেন। এই খামারগুলোকে আমরা প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে ভ্যাকসিন এবং চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে থাকি।’

নাটোরেও প্রায় ১৮ হাজার খামারি পশু পালন করেছেন বলে জানিয়েছে জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্র। প্রতিবছরের মতো এবারও জেলার চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত কোরবানির পশু দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হবে। এছাড়া বাণিজ্যিক ও পারিবারিকভাবে প্রস্তুতকৃত পশু বিক্রি করে যৌক্তিক দাম পেয়ে লাভবান হবেন খামারিরা বলে আশা করা হচ্ছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে জেলার ৭টি উপজেলায় প্রায় ৫ লাখ ২০ হাজার ২৩৮টি কোরবানির পশু প্রস্তুত করা হয়েছে। জেলাজুড়ে পশুর চাহিদা রয়েছে প্রায় ২ লাখ ৫১ হাজার। এছাড়া প্রস্তুতকৃত উদ্বৃত্ত পশুর সংখ্যা ২ লাখ ৬৯ হাজার ২৩৬।

জেলার চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত এই পশু জেলার বাইরে বিক্রি করা হবে। প্রস্তুতকৃত এসব পশুর মধ্যে গরুর সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ১১ হাজার ২৩৪টি, মহিষ ২ হাজার ৮২২টি, প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার ছাগল এবং ভেড়া প্রায় ৪৬, ১৬৯। জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. গোলাম মোস্তফা জানান, কোরবানির পশু সঠিকভাবে প্রস্তুত করতে খামারিদের সব ধরনের পরামর্শ ও সহায়তা করা হচ্ছে।

জেলার চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত পশু জেলার বাইরে বিক্রি করা সম্ভব হবে। আশা করা হচ্ছে খামারিরা এবার যৌক্তিক দাম পেয়ে লাভবান হবেন। তবে কোরবানির পশুর ভালো দাম পাওয়া নিয়েও শঙ্কায় রয়েছেন কিছু কিছু খামারি। যশোরের খামারিরা কোরবানির ঈদ সামনে রেখে পশু পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। গতবারের মতো এ বছরও জেলায় চাহিদার তুলনায় বেশি পশু পালন করা হয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতির কারণে পশু হৃষ্টপুষ্ট করতে খরচ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। এ অবস্থায় সঠিক দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত খামারিরা। আর কয়েকদিন বাদেই কোরবানির ঈদ। তাই শেষ মুহূর্তে পশুর পরিচর্যায় যশোরের খামারিরা ব্যস্ত সময় পার করছেন।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে যশোর গরু হৃষ্টপুষ্টকরণে বেশ এগিয়ে।

বিশেষ করে ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হওয়ায় এ জেলায় গরু পালন বেড়েছে। এ বছর জেলার ৮টি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে প্রায় ৯ হাজার ছোট-বড় খামারে দেশি পদ্ধতিতে হাজার হাজার গরু-ছাগল পালন করা হচ্ছে। কাজেই ঈদের বাজারে ভালো দাম পাওয়ার আশা করছেন খামারিরা। এক খামারি বলেন, বর্তমানে আমাদের খামারে ২৮টি গরু আছে। আশা করছি, কোরবানির সময়ে ভালো দাম পাব। তবে খামারিদের দাবি, এ বছর গরু পালনে খরচ বেড়েছে। গরু পালনের খরচ উঠানো নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে এক খামারি বলেন, এবার খরচ শুধু বেশি নয়, অনেক বেশি হয়েছে। যা আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। যে গরুগুলো তিন লাখ টাকায় বিক্রি করার আশা করছি আমরা।

সেগুলোর পেছনে এরইমধ্যে আমাদের ২ লাখ ৮০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়ে গেছে। আরেকজন খামারি বলেন, গরুর পেছনে যা খরচ বেড়েছে, গরু বিক্রি করে তা উঠবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

অবশ্য প্রাণিসম্পদ বিভাগ বলছে, কোরবানির পশুর বাড়তি চাহিদা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির কারণে অন্যান্য জেলাতে পশু পাঠানোর সুযোগ থাকায় লোকসান হওয়ার আশঙ্কা নেই।

এ বিষয়ে যশোর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা রাশেদুল হক বলেন, এখন দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ উন্নত। পদ্মা সেতু দিয়ে হোক বা অন্য কোনোভাবে হোক খামারিরা বেশ সহজেই তাদের গরু দেশের অন্যত্র নিয়ে যেতে পারবেন। তাছাড়া আমি প্রত্যাশা করছি যে খামারিরা ন্যায্যমূল্য পাবেন। প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্যমতে, জেলায় এ বছর কোরবানির জন্য পশুর চাহিদা রয়েছে ৮৬ হাজার। যার বিপরীতে পরিচর্যা করা হচ্ছে ৯৬ হাজার পশু।