নতুন কারিকুলাম

সঠিক মূল্যায়ন পদ্ধতি বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা

ইচ্ছামতো চলছে শিক্ষকদের মূল্যায়ন কার্যক্রম

প্রকাশ : ১২ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  রকীবুল হক

নতুন কারিকুলাম সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন শুরু হয়েছে ৭ জুন থেকে। কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গতকাল থেকে শুরু হয়েছে। নতুন পদ্ধতির এ মূল্যায়নের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষকদের জন্য বিষয়ভিত্তিক গাইডলাইন প্রকাশ ছাড়াও অনলাইনে ওরিয়েন্টেশন কোর্স সম্পন্ন করার জন্য তাগিদ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। তবে বাস্তবে অধিকাংশ শিক্ষকই এসব কোর্স বা গাইডলাইন আয়ত্ত করতে পারেননি বলে জানা গেছে। যে কারণে বিভিন্ন ¯ু‹লে শিক্ষকদের ইচ্ছামতোই মূল্যায়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। নতুন কারিকুলাম সম্পর্কে শিক্ষকরা পুরোপুরি দক্ষ না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা এর সুফল পাবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

সূত্রমতে, গত ২৫ মে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) এক বিজ্ঞপ্তিতে নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়। একইসঙ্গে শিক্ষকদের ওরিয়েন্টেশন কোর্স সম্পন্ন করারও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী ৭ জুন থেকে ষান্মাসিকের সামষ্টিক মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। অবশ্য এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র সংশ্লিষ্ট কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ মূল্যায়ন শুরু হয়েছে গতকাল থেকে। এদিকে মূল্যায়নের বিষয়ে গত ২৬ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত অনলাইনে শিক্ষকদের ওরিয়েন্টেশন কোর্স সম্পন্ন করতে বলা হয়। তবে বাস্তবে বহু শিক্ষক অনলাইনে এ ওরিয়েন্টেশন সম্পন্ন না করায় পরে ৭ জুন পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে নতুন করে নির্দেশনা দেয়া হয়। এরপরও বহু শিক্ষক এখনো এই কোর্সের বাইরে এবং অনেকেই মূল্যায়ন গাইডলাইন আয়ত্ত করতে পারেননি বলে জানা গেছে। এছাড়া বিভিন্ন স্কুলে মাউশির গাইডলাইনের বাইরে ইচ্ছামতো মূল্যায়নের উদ্যোগ নেয় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সতর্ক নোটিশ জারি করে মাউশি।

গত ৫ জুন ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বিষয়ভিত্তিক ষান্মসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন সংক্রান্ত মাউশির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সম্প্রতি টাঙ্গাইল জেলার বাসাইল উপজেলার কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ষান্মাসিক মূল্যায়নের পরিবর্তে গতানুগতিক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে পরীক্ষা নেয়ার আয়োজনের বিষয়টি মাউশি অধিদপ্তরের গোচরীভূত হওয়ায় তাৎক্ষণিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে তা বন্ধ করে দেয়া হয়। নতুন কারিকুলাম বিস্তরণ ও মূল্যায়নের সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও তা লঙ্ঘন করে এহেন অনভিপ্রেত কাজ করার পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এমতাবস্থায়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ষান্মাসিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নতুন কারিকুলাম বিস্তরণ ও মূল্যায়নের নির্দেশিকা যথাযথভাবে অনুসরণ করার জন্য অনুরোধ করা হয় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে।

এদিকে ৫ জুন মাউশির পক্ষ থেকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন সহায়তায় শিক্ষক ওরিয়েন্টেশন ও বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে আরেক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এনসিটিবি কর্তৃক প্রেরিত ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির সব শিক্ষককে ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন পরিচালনায় সহায়তার জন্য মুক্তপাঠে (যঃঃঢ়ং://হপঃন.সঁশঃড়ঢ়ধধঃয.মড়া.নফ) ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের একটি অনলাইন ওরিয়েন্টেশন কোর্স ৩০ মের মধ্যে সম্পন্ন করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়। ওই নির্দেশনার আলোকে যেসব শিক্ষক এখন পর্যন্ত ওরিয়েন্টেশন কোর্সটি সম্পন্ন করেননি তাদের আগামী ৭ জুনের মধ্যে কোর্সটি সম্পন্ন করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হলো।

এছাড়া ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির নতুন কারিকুলাম যথাযথ বাস্তবায়নে নিম্নোক্ত নির্দেশনা প্রতিপালন করতে শিক্ষকদের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে নিয়মিত তথ্য আদানপ্রদান, জেলা-উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের মনিটরিং এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে তা মাউশিতে প্রেরণসহ নানা নির্দেশনা প্রদান করা হয়।

তবে বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে সরকারি একটি স্কুলের একজন শিক্ষক জানান, অনলাইন কোর্স করার কথা বলা হলেও অনেকেই এই কোর্স করেননি। যারা করেছেন তারাও ঠিকমতো না বুঝেই বা অন্যকে দিয়ে কোর্স সম্পন্ন করে সার্টিফিকেট নিয়েছেন। তাছাড়া মূল্যায়নের যে গাইডলাইন দেয়া হয়েছে তাও অনেক শিক্ষক ডাউনলোড দেননি বা আয়ত্ত করতে পারেননি। তাই শিক্ষকদের অনেকে দায়সারাভাবেই এই মূল্যায়ন করছেন।

তিনি আরো জানান, নতুন কারিকুলামের প্রশিক্ষণের সময় এর মূল্যায়নের জন্য একটি অ্যাপস দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা দেয়া হয়নি। এখন মূল্যায়ন তথ্য সংরক্ষণ করা নিয়ে শিক্ষকদের বিপাকে পড়তে হবে। তাছাড়া অনেকে ধারাবাহিক মূল্যায়নই করেননি। তাই সার্বিকভাবে নতুন কারিকুলামের সুফল পাওয়া অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।

এদিকে রাজধানীর একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রথম দিনের মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে জানা গেছে, তিন ঘণ্টা সময় ধরে ক্লাসে বসিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে দুই পাতা কাগজ দিয়ে যা ইচ্ছা লিখতে বলা হয়। এছাড়া আরো কিছু কাজ দেয়া হয়। এসব কাজ করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা অনেকটাই হৈহুল্লোড় করে সময় পার করে। এতে শিক্ষার্থীদের মাঝে পরীক্ষাভীতি কেটে গেলেও শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা।

তাছাড়া পরীক্ষার সময়েও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন গ্রুপ ওয়ার্ক চলছে। আর এসব গ্রুপ ওয়ার্ক কোথায় করা হবে তা নিয়ে বিপাকে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। অনেকে বাসায় গিয়ে গ্রুপ ওয়ার্ক করছে বলে জানা গেছে। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে নানা মনোমালিন্যও দেখা দিচ্ছে।

মূল্যায়ন বিষয়ে একজন অভিভাবক জানান, পরীক্ষা শেষে বাচ্চারা সবাই হাসিমুখে হল থেকে বের হচ্ছিল। সবাই বলছিল পরীক্ষা খুবই ভালো হয়েছে কিছুই লিখতে হয়নি। ওদের অবস্থা দেখে এত কষ্ট হচ্ছিল যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। ওরা তো আসলে জানেনা ওদের কত বড় ক্ষতি হচ্ছে। এইভাবে বাচ্চাদের মেধাকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে কি না?

এদিকে সামষ্টিক মূল্যায়নের জন্য সাধারণ পরীক্ষার মতো ফি নেয়া যাবে কি না সে সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা পায়নি স্কুলগুলো। যে কারণে কোনো স্কুলে ফি নেয়া হচ্ছে আবার কোনো স্কুলে ফি না নিয়ে শিক্ষার্থীদের বাসা থেকে কাগজ আনতে বলা হচ্ছে। মূল্যায়ন নিয়ে শিক্ষকদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ ও সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান এবং মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।