জাপানি মায়ের শিশুদের জিম্মা নিয়ে মামলা চলবে

প্রকাশ : ১৩ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

জাপানি মায়ের দুই শিশু জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনা কার জিম্মায় থাকবে- এ সংক্রান্ত আপিল শুনানির জন্য আদালত পরিবর্তন চেয়ে শিশুদের বাংলাদেশি বাবা ইমরান শরীফের আবেদন সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মামনুন রহমানের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল এ আদেশ দেন। আদেশে আদালত বলেছেন, আপিল বিভাগের নির্দেশনা অনুসারে এই আপিল মামলা জেলা জজ আদালত নিষ্পত্তি করবেন। আদালতে শিশুদের বাবা ইমরান শরীফের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট নাসিমা আক্তার লাভলী এবং শিশুদের মা নাকানো এরিকোর পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কেউসি, অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম ও অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। এর আগে গত ১ জুন জাপানি দুই শিশু জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনা কার জিম্মায় থাকবে, এ সংক্রান্ত আপিল শুনানির আদালত পরিবর্তন চেয়ে শিশুদের বাবা ইমরান শরীফের আবেদন কার্যতালিকা থেকে বাদ দেন হাইকোর্ট। পরে এই আবেদন নতুন বেঞ্চে উপস্থাপন করেন শিশুদের বাবার আইনজীবী অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ শিশির মনির। আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, জাপানি দুই শিশু জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনা কার জিম্মায় থাকবে এ সংক্রান্ত আপিল ঢাকার জেলা জজকে তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। এই আপিল ঢাকার জেলা আদালতে শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। কিন্তু শিশুদের বাবা ইমরান শরীফ আপিল জেলা জজের আদালতে শুনানি না করে হাইকোর্টে শুনানির জন্য আবেদন করেছিলেন। হাইকোর্ট আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। গত ৯ মার্চ জাপানি দুই শিশু জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনাকে বিদেশে নিয়ে যেতে জাপানি মায়ের আবেদন নাকচ করে আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে দুই শিশু কার জিম্মায় থাকবে এ সংক্রান্ত আপিল জেলা জজ আদালতকে তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন আদালত। এ সময় পর্যন্ত দুই শিশু জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনা যেভাবে আছেন সেভাবেই থাকবে। প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে আপিল বিভাগ এ আদেশ দেন। আইনজীবীরা জানান, আপিল বিভাগের অনুমতি ছাড়া দুই সন্তানকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া যাবে না, এই আদেশের বিরুদ্ধে একটি সিভিল রিভিউ পিটিশন ও একটি এক্সপাঞ্জ চেয়ে আবেদন করেছিলেন জাপানি মা। আপিল বিভাগের আগে একটি আদেশ ছিল আপিল বিভাগের অনুমতি ছাড়া দুই সন্তানকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া যাবে না। এটা যেন আদেশ থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়, সেজন্য আবেদন করেছিলেন জাপানি মা। ইমরান শরীফ নাকানো এরিকোর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার আবেদন করেছিলেন। কারণ, জাপানি ওই মা শিশুদের দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুবার চেষ্টা করেন। মা নাকানো এরিকোও একটা আদালত অবমাননার আবেদন করেছিলেন। কারণ, বাবা ইমরান একটি শিশুকে তার কাছে নিয়ে এসেছিলেন। এই চারটি আবেদনের শুনানি শেষে আপিল বিভাগ আদেশে বলেছেন, মা নাকানো এরিকো যেন শিশুদের দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করে। একইসঙ্গে জেলা জজ আদেশ দিলেন শিশুদের জিম্মায় রাখা সংক্রান্ত আপিল তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করার। এছাড়া আরেকটা নির্দেশনা দিয়েছেন, সেটা হলো স্ট্যাস্টাকো (স্থিতিবস্থা) মেনে চলার। যার অর্থ- যতদিন পর্যন্ত জেলা জজ আদালতে থাকা আপিলটা নিষ্পত্তি না হয়, ততদিন পর্যন্ত এখন যে অবস্থায় আছে, সে অবস্থাটাই মেনে চলতে হবে। এর অর্থ- দুই শিশুকে দেশের বাইরেও নেয়া যাবে না। তারা যে যার কাছে আছে, তার কাছেই থাকবে। এর আগে গত ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশি বাবা ইমরান শরীফ ও জাপানি মা নাকানো এরিকোর দুই শিশুকে জাপানি মা নাকানো এরিকোর জিম্মায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। নাবালিকা দুই শিশু জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনা কোথায় থাকলে কল্যাণ হবে, সেদিক বিবেচনায় রেখে এ রায় দেয়া হয়। ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালত এ রায় দেন। রায়ে আদালত বলেন, মামলা করার কারণ আদালতের কাছে প্রমাণ করতে পারেনি বাদীপক্ষ। বরং আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে, জাপান থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা দুই শিশুর বেড়ে ওঠা জাপানে। সেখানে তারা লেখাপড়া করেছে। তাদের মা নাকানো এরিকো পেশায় একজন চিকিৎসক। তিনটি সন্তান জন্মের পর মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে সন্তানদের পাশে ছিলেন। পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, জাপানে বেড়ে ওঠা দুই শিশুর প্রাথমিক যত্নকারী তাদের মা নাকানো এরিকো। অথচ তাকে কিছু না জানিয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়া হঠাৎ অন্য একটি দেশে নিয়ে আসাটা মাতৃত্বের বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন রূপটিকে অসম্মান করার নামান্তর। রায়ে আদালত আরো বলেছেন, বাবা হিসেবে ইমরান শরীফ নাবালিকা দুই সন্তানের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার পূর্ণ হকদার। তবে, জাপানি মায়ের কাছে দুই নাবালিকার হেফাজত তাদের শারীরিক, মানসিক ও পারিপার্শ্বিক, তথা সার্বিক মঙ্গলজনক বলে আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এই রায়ের বিরুদ্ধে জেলা জজ আদালতে আপিল করেন বাবা ইমরান শরীফ। এরিকোর আইনজীবী শিশির মনির জানান, ২০০৮ সালের ১১ জুলাই জাপানি নাগরিক ডা. এরিকো নাকানো (৪৬) ও বাংলাদেশি আমেরিকান নাগরিক শরীফ ইমরান (৫৮) জাপানি আইনানুসারে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তারা টোকিওতে বসবাস শুরু করেন। ১২ বছরের সংসারে তিনজন কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে। তারা হলো- জেসমিন মালিকা (১১), লাইলা লিনা (১০) ও সানিয়া হেনা (৭)। এরিকো পেশায় একজন চিকিৎসক। তিন মেয়ে টোকিওর চফো সিটিতে অবস্থিত আমেরিকান স্কুল ইন জাপানের (এএসজেআই) শিক্ষার্থী ছিল। ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি ইমরান তার স্ত্রী এরিকোর সঙ্গে ডিভোর্স আবেদন করেন। এরপর ২১ জানুয়ারি ইমরান স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে তার মেয়ে জেসমিন মালিকাকে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেন। কিন্তু তাতে এরিকোর সম্মতি না থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষ তার প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। পরে স্কুলবাসে বাড়ি ফেরার পথে বাস স্টপেজ থেকে ইমরান তাদের বড় দুই মেয়ে জেসমিন ও লিনাকে অন্য একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান। চার দিন পর ২৫ জানুয়ারি ইমরান তার আইনজীবীর মাধ্যমে এরিকোর কাছে সন্তানদের পাসপোর্ট হস্তান্তরের আবেদন করেন। কিন্তু এরিকো তা প্রত্যাখ্যান করেন। এর মধ্যে ২৮ জানুয়ারি এরিকো টোকিওর পারিবারিক আদালতে তার সন্তানদের জিম্মার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ চেয়ে মামলা করেন। আদালত ৭, ১১ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি পারিবারিক সাক্ষাতের আদেশ দেন। ইমরান আদালতের আদেশ ভঙ্গ করে মাত্র একবার মায়ের সঙ্গে দুই মেয়ের সাক্ষাতের সুযোগ দেন। ৯ ফেব্রুয়ারি মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ইমরান তার মেয়েদের জন্য নতুন পাসপোর্টের আবেদন করেন এবং ১৭ ফেব্রুয়ারি নতুন পাসপোর্ট নেন। পরে ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি দুই মেয়ে জেসমিন ও লিনাকে নিয়ে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। ৩১ মে টোকিওর পারিবারিক আদালত এরিকোর অনুকূলে জেসমিন ও লিনার জিম্মা হস্তান্তরের আদেশ দেন। পরে ছোট মেয়ে সানিয়া হেনাকে মায়ের কাছে রেখে ১৮ জুলাই এরিকো শ্রীলঙ্কা হয়ে বাংলাদেশে আসেন। পরে তিনি হাইকোর্টে রিট করেন। তারই ধারাবাহিকতায় আদালত গুলশানে একটি ভাড়া বাসায় সবাইকে আলাদা কক্ষে বসবাসের অনুমতি দেন। পাশাপাশি সমঝোতা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। কিন্তু উভয়পক্ষের আইনজীবীরা কয়েকবার বৈঠকেও সমঝোতায় আসতে পারেনি।